অমর একুশ এল যে পথ বেয়ে

(মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জননেতা পীর হাবিবুর রহমান ২০০৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম এ সৈনিক জননেতা পীর হাবিবুর রহমান মৃত্যুর কিছুদিন আগে অমর একুশে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার জন্য পাঠিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক অনুরাগী সুব্রত বিশ্বাস।)

‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তাঁর শ্রেষ্ট সময়।’ কথাটার ধার যেমন আছে তেমনি ভারও আছে। আর এক মনীষী লেনিন বলেছেন, ‘পুট দ্য ওল্ড হেড অন ইয়াং শোল্ডার।’ অর্থাৎ যৌবনকালের বাহুবলের সঙ্গে বয়স্ক লোকের বুদ্ধিবলের সমন্বয় ঘটলেই জংফতেহ বা যুদ্ধজয় নিশ্চিত। চল্লিশ দশকের মধ্যভাগ। ইতিহাসের বর্বরতম, জঘন্যতম, নৃশংসতম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ খতম হলো। ফ্যাসিবাদের ঘৃণ্য ছোবলে এ যুদ্ধে কোটি লোক আত্মাহুতি দিল। আর ধ্বংসযজ্ঞের তো কোনো হিসাব-কিতাব নেই। কিন্তু এই মহাবিধ্বংসী যুদ্ধ শুধু অনাসৃষ্টি করেই যায়নি। যুদ্ধের ফলে তৃতীয় দুনিয়া তথা পরাধীন বিশ্বে মরা গাঙ্গে দু’কুলপ্লাবী মুক্তির জোয়ার জীবন জাগানো ঢেউ, জানবাজি লড়াই-সংগ্রামের বৈপ্লবিক চেতনা ও উন্মাদনা জাগিয়ে দেয়। আমার তখন যৌবনকাল। মানুষকে ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ পথ দেখানোর ইলম হাসিলের জন্য বাপ-মা আমাকে মাদ্রাসায় পড়তে পাঠিয়েছিলেন। দেশের স্বাধীনতার ডাক, গরিব-দুঃখী মজলুম মানুষের মুক্তির আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমি এক স্বাধীন সুখী সুন্দর সমাজ ও দেশ গঠনের সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করলাম। যদিও আমরা স্বাধীনতার মুক্তির লক্ষ্যে একতার সঙ্গে জীবন উৎসর্গ করার ওয়াদায় জোটবদ্ধ হয়েছিলাম, বার্ধক্যের কারণে তাদের অনেক নামই হারিয়ে গেছে। যাদের কথা মনে আছে এর মধ্যে প্রথম ব্যক্তি ভাদেশ্বর নিবাসী তসদ্দুক আহমদ। তিনি বর্তমানে বাক-শক্তিহীন অবস্থায় ব্রিটিশ সরকারের বিশেষ যত্নে-হেফাজতে লন্ডনের একটি স্বাস্থ্য নিবাসে আছেন। তার পর শামসুদ্দিন আহমদ (শহীদ অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমদ), এমদাদুর রহমান (কর্নেল ডা. এমদাদুর রহমান), আখলাকুর রহমান (ডা. আখলাকুর রহমান), আকরাম হোসেন, আবদুল মালিক (আসাম জোড়হাট), মহিউদ্দিন আহমদ (ইঞ্জিনিয়ার মহিউদ্দিন আহমদ), ওয়াহিদ উদ্দিন চৌধুরী (ইঞ্জিনিয়ার ওয়াহিদ উদ্দিন আহমদ), দেওয়ান আবদুর রশিদ, আব্দুল ছালাম চৌধুরী, আব্দুল খালিক পাইলট, মকসুদ আহমদ চৌধুরী (অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব) সৈয়দ আহমদ হোসেন, হাসমত আলী (আসাম গোয়ালপাড়া), সৈয়দ শাহাদত হোসেন, শাহেদ আলী (অধ্যাপক শাহেদ আলী), শফাত আহমদ চৌধুরী, আসদ্দর আলী, আব্দুর রশিদ, আলী হায়দর খান, আবদুস সবুর, আবদুল মজিদ, আফতাব উদ্দিন, জাহেদ উদ্দিন চৌধুরী, আব্দুল মালিক চৌধুরী, আবদুস সালাম প্রমুখ। ১৯৪৮ সাল। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে করাচিতে।
বৈঠকের শুরুতেই উর্দু ও ইংরেজিকে গণপরিষদের সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হয়। গণপরিষদে সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত (কুমিল্লা) সভায় একটি মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাতে তিনি উর্দু-ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবি জানান। পূর্ব বাংলার সব মুসলিম সদস্যসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যরা এক জোটে এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। পূর্ব বাংলায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে ছাত্র সমাজের বৈপ্লবিক পদক্ষেপে ঢাকার রাজপথ সরগরম হয়ে ওঠে। হালুয়া-রুটির হিস্যা থেকে বঞ্চিত একদল মুসলিম লীগ এমএলএ বিক্ষুদ্ধ ছিলেন। তাঁরা এবার মওকা পেয়ে গেলেন। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিতে তারা এগিয়ে এলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ছাত্রদের সঙ্গে আপস করেন। কিন্তু পাকিস্তানের আসল শাসক খানজাদারা তাতে রাজি হননি। তারা যুক্তি করে বড়লাট জিন্নাহ সাহেবকে ঢাকায় পাঠালেন। জিন্নাহ বিদ্রোহী এম এল এ মোহাম্মদ আলী (বগুড়া), তফজ্জুল আলী, ডা. এ এম মালিক, খাজা নসরুল্লাহ প্রমুখ ওজারতি, দূতগিরি ইত্যাদি নামে ভূষিত করলেন। বললেন, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। ২১ মার্চ এই হিটলারি ফরমান। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন। তৎসাথে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর সরকারি দমন-পীড়নের স্টিমরোলার এবং মুসলিম লীগ গুন্ডাদের লাঠিপেটার সাঁড়াশি আক্রমণ নেমে এল। এই ফ্যাসিবাদী হামলার মুখে আন্দোলন পরিচালনাকারী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারশেন রাস্তা থেকে উধাও হলো। আর ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ল। প্রকৃতির বিধানে কোনো স্থান শূন্য থাকে না। এক বস্তু নিঃশেষ হলে আর এক বস্তু সেই শূন্যস্থান পূরণ করে। তেমনি বাংলা ভাষার শূন্যস্থান পূরণে ‘তমদ্দুন মজলিশ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে। তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৮ সালের ৮ মার্চ প্রদেশব্যাপী ‘বাংলা রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের আহ্বান জানায়।
সিলেট শহরের শেখঘাট মহল্লা। দেওয়ান আবদুর রহিম চৌধুরী পিপি সাহেবের বাসা। তাঁর স্ত্রী বেগম জোবেদা খাতুন চৌধুরী আসাম প্রদেশ মুসলিম মহিলাদের মধ্যে স্বদেশি আন্দোলনে ছিলেন অগ্রপথিক। রাজনৈতিক কর্মীর সুবাদে বেগম সাহেবা আমাকে জায়গির দেন। আমি তখন এমসি কলেজের ছাত্র। একদিন রাতের বেলা বেগম সাহেবার বড় ছেলে মোয়াজ্জম আহমদ চৌধুরী আমাকে ডেকে পাঠান। তাঁর কামরায় গিয়ে দেখি আমাদের পুরোনো বন্ধু শাহেদ আলী বসে আছেন। শাহেদ আলী ঢাকায় তমদ্দুন মজলিশের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক। মোয়াজ্জম সাহেব এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে আমাকে ফরমাশ করলেন। আমি খুশি মনে রাজি হলাম। বাস শাহেদ আলী সাহেবও দায়িত্ব আনজাম করে খুশি মনে সেখান থেকে ঢাকার গাড়ি ধরতে বেরিয়ে পড়লেন। নদী ভাঙায় যেমন মানুষের খেত-খামার, রাস্তা-ঘাট আর বাপ-দাদার ভিটাটুকুও যায়, তেমনি আমাদের ঘরে ধস নেমেছে। পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী ছিলাম। সিলেট আমাদের পদভারে টালমাটাল ছিল মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায়। আমরা ‘ভারতের দালাল’ কমিউনিস্ট লক্কড় পেয়েছি। সবই সুনসান। কর্মী বলতে আমি আর মকসুদ মাত্র এই দুজন। এখন তো ‘বাংলা রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করে বসে আছি। পরদিনই মকসুদের বাসায় গেলাম। আমরা দুজনে আবার বেগম জোবেদা খাতুন চৌধুরীর কাছে এলাম। ভাষা আন্দোলনের তিনি অগ্রণী সৈনিক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনায় সিলেটে তমদ্দুন মজলিশের একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হলো। আর কমিটির নামেই গোবিন্দ পার্কে ৮ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবসের জনসভা আহ্বান করা হলো। আমরা দু’লক্ষীন্দরে মিলে সভার ইশতেহার লিখলাম। জালালাবাদ প্রেসে ছাপালাম। তারপর রিকশায় চড়ে স্লোগান দিয়ে সভার এলান দিলাম। আর ইশতেহার বিলি করলাম।
গোবিন্দ পার্কে সভা। বর্মণ কোম্পানির সাইকেলে আমরা দুজন ৩টায় পার্কে হাজির হলাম। বিশিষ্টরা সভায় হাজির হলেন, মাহমুদ আলী (সাবেক আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সেক্রেটারি), দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ (অধ্যাপক), এ জেড আবদুল্লাহ (মোতাওয়াল্লি দরগাহে শাহজালাল), মো. নুরুল হক দশঘরি (সেক্রেটারি কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ), দেওয়ান ওহিদুর রাজা চৌধুরী, ছাত্রনেতা আবদুস সামাদ (সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী), শাহ শামসুল কিবরিয়া (সাবেক অর্থমন্ত্রী), আফসার উদ্দিন (অধ্যাপক) প্রমুখ। সভার নির্বাচিত সভানেত্রী বেগম জোবেদা খাতুন চৌধুরী। তিনি না আসায় সভা শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে। কিছু লোক বাঁশের ছাতা মাথায় এক পাগল নিয়ে সভাস্থলে হাজির হয়। সে নাচে আর গান গায়, ‘বাংলা ভাষা হিন্দুর ভাষা, বাংলা ভাষা কাফেরের ভাষা, উর্দু ভাষা মুসলমানের-উর্দু ভাষা মুমিনের ভাষা।’ এই দৃশ্য দেখে আমি আতঙ্কিত হলাম। হঠাৎ আমাদের এক সময়ের সহকর্মী বাহাউদ্দিন এম এ বারীর (ধলা বারী) নাম সভাপতিত্ব করার জন্য প্রস্তাব করে বসল। আমি তাড়াতাড়ি সভাপতির আসন জুড়ে ফেলার জন্য মাহমুদ আলী সাহেবের নাম প্রস্তাব করলাম। কিন্তু মাহমুদ আলী চেয়ারে বসলেন না। অপরদিকে এম এ বারী সভাপতির চেয়ারে বসতে উদ্যত হলেন। আমি চেয়ার আসনে দাঁড়ানোর ফলে বারী সাহেব বসতে পারলেন না। ইত্যবসরে বাহাউদ্দিন নিজের নাম নিজেই প্রস্তাব করে চেয়ারে এসে বসে পড়ল। আমি তাঁকে ধাক্কা দিতেই সে উঠে সরে গেল। ইত্যবসরে আমার বোঝা হয়ে গেল যে, মুসলিম লীগ আমাদের সভা করতে দেবে না। আর সে শক্তির মোকাবিলা করার সামর্থ্য তো নেই। একমাত্র ভরসা জেলা মুসলিম লীগ সেক্রেটারি মনির উদ্দিন সাহেব। তিনি যদিও উর্দুরই সমর্থক। আমাকে খুব স্নেহ করেন, কারণ আমি মুসলিম লীগের ভালো কর্মী ছিলাম। আমার বিশ্বাস তিনি আমার বিপদে আমাকে বিমুখ করবেন না। আমি মকসুদসহ বন্ধুদের বুঝিয়ে বললাম, ‘আপনারা এখন সভা শুরু করবেন না। আমি নদীর দক্ষিণ পারে লীগ সেক্রেটারীর কাছে সাহায্যের জন্য যাচ্ছি।’ বলেই আমি দ্রুত চলে গেলাম। জনাব মনির উদ্দিন আমার কথা শুনে দ্বিরুক্তি না করে ঝটপট ময়না মিয়াকে ডেকে দু’গাড়ি লাঠিয়াল নিয়ে আমার সভা রক্ষায় যাওয়ার আদেশ দিলেন। আমি হাতে আসমান পেয়ে গেলাম। এ কথা শোনার পর আর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে আবার সভাস্থলে রওনা দিলাম।
কিনব্রিজে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় একজন সাইকেলের ব্রেক টেনে আমাকে সম্বোধন করে বলেন, হবিব মিয়া সাহেব আপনার মিটিং ভেঙে ফেলা হয়েছে। আর খুব সম্ভব মকসুদ মারা গেছে। ‘মকসুদ মারা গেছে’ তারপর আমার আর কোনো জ্ঞান, হুঁশবুদ্ধি নেই। আমি গোবিন্দ পার্কে কেমনে এসে পড়েছি বলতে পারব না। দেখছি একটা বড় মিটিং চলছে। সিলেটের সর্বজনপ্রিয় নেতা আজমল আলী চৌধুরী বক্তৃতা করছেন। আমার কিন্তু আর কিছুতেই মন নেই, সভার চতুর্দিকে ঘুরছি আর চেনা মুখ খুঁজছি। উদ্দেশ্য মকসুদের খবর শোনা। হঠাৎ নয়াসড়কের আমার চেনা এক লোক খপ করে আমার হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে পার্কের বাইরে নিয়ে গেল। আমি বলি মকসুদের খবর বলেন, সে শুধু টানে বাইরের দিকে। বাইরে আসার পর সে বলল, আপনি কোন্ সাহসে এখানে ঢুকেছেন। লেংড়া মৌলভি দলেবলে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে আর বলছে, একটাকে খতম করেছি। আর একটা বাকি রয়েছে তাকেও খতম করতে হবে। সেই লোকের মুখে আদ্যেপান্ত সব বিবরণ শুনলাম। জানা গেল, আমি চলে যাওয়ার পর পার্কের পশ্চিম প্রান্তে আজমল আলী চৌধুরী সাহেব সভা শুরু করেন। তিনি বাংলার দাবিদারদের ভারতের দালাল, হিন্দুর গোলাম, কাফের, বেইমান ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করছিলেন। তখন আমাদের বন্ধুরা বিক্ষুব্ধ হয়ে এখানেই সভা শুরু করে। এই সভার মাইকের আওয়াজ শুনে আজমল আলীর সভার বেশির ভাগ লোক এই সভায় চলে আসে। তখন সেখানে থেকে লাঠিসোঁটা, ইটপাটকেল নিয়ে এই সভায় আক্রমণ চালানো হয়। সভার মাইক ভেঙে ফেলা হয়। লোকজন আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে যায়। তারপর আজমল আলী সাহেব সভায় বক্তৃতা শুরু করেন। সব পালালেও মকসুদ মিয়া পালায়নি। সে আস্তে আস্তে লাইট পোস্টে গিয়ে আমাদের লটকানো পাকিস্তানি পতাকা খুলে নিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল। কয়েকজন পতাকা আঁকড়ে ধরে। টানাটানিতে পতাকা ছিঁড়ে যায়। মকসুদ মিয়া পতাকার ছেঁড়া অংশ হাতে নিয়ে পার্কের গেটে পৌঁছে গেছে। এমন সময় আজমল আলী সাহেব কমিউনিস্ট মকসুদ ‘পাকিস্তানি পতাকা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে ধর ধর’ বলে হুংকার ছাড়েন। সভাস্থল থেকে কয়েকশ লোক মকসুদ মিয়ার ওপর চড়াও হয়। মকসুদ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। তাকে মেরে ফেলবে দেখে আমাদের বন্ধু মনির মিয়া মকসুদের ওপর শুয়ে পড়েন। তার দেখাদেখি বাঘার সুমপুরের মাহমুদ মিয়া নামক এক লোকও শুয়ে পড়েন। মারপিট তখনো বেদম চলছে। এমন সময় এক লোক চিৎকার করে বলে, তোমরা কাকে মারছ? এ তো আমাদের বরইকান্দির হাফিজ সাহেবের মিয়া মনির মিয়া। তখনই মারপিট বন্ধ হয়ে যায়। অজ্ঞান অবস্থায় মকসুদ মিয়াকে মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের এক দোকানে নিয়ে রাখা হয়।
ইতিমধ্যে তার জ্ঞান ফিরেছে। আমি তাকে বাসায় যাওয়ার কথা বলতেই সে কেঁদে ফেলল। বুঝলাম সে মায়ের কাছে যেতে চায়। রিকশা এনে তাকে রিকশায় তুলে বাসায় নিয়ে গেলাম। তার বাবা ছিলেন সিলেটের অতিরিক্ত এসপি ইরশাদ আলী। গিয়ে দেখি গেট বন্ধ। সাস্ত্রী জানাল, মকসুদের মা তাকে বাসায় ঢুকতে দিতে বারণ করেছেন। সাব পিস্তল নিয়ে বসে আছেন। বাসায় গেলে গুলি করবেন। অগত্যা তাকে নিয়ে মুসলিম লীগ অফিসে গেলাম। মনিরুদ্দিন সাহেব ডাক্তার ডাকলেন। তারপর মকসুদকে তার ভগ্নিপতি কোতোয়ালি থানায় ওসির বাসায় পৌঁছে দিলাম। এ তো গেল মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠের কথা বলতে হয়। না হলে মনে হবে ’৪৮ এ বুঝি সিলেটের এলিট সমাজ আইয়ামে জাহেলিয়াতের শরাব পান করে একদম হুঁশজান হারিয়ে নাদান বনে গিয়েছিল। বাংলা ভাষার সভায় বেগম জোবেদা খাতুন আসেননি, এ কথা ঠিক নয়। আসলে শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি আসতে পারেননি। তার স্বামী দেওয়ান আব্দুর রহীম চৌধুরী সেদিন কোর্টে বসেই মুসলিম লীগওয়ালাদের সভায় হামলা করার সংবাদ পান। তিনি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যান। হাতে বন্দুক নিয়ে বেগম সাহেবাকে বলেন, তোমার আজ সভায় যাওয়া চলবে না। যদি আমার কথা অমান্য করে সভায় যাও, তাহলে বন্দুক দিয়ে নিজের বুকে গুলি করে আমি আত্মহত্যা করব। আর বড় ছেলে মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন। কাজেই জোবেদা খাতুনের সভায় যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তিনি তার এই ব্যর্থতার জন্য যারপরনাই অনুতপ্ত হন। পরদিনই মকসুদ প্রতিবাদ সভার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়। জোবেদা খাতুন তাতে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই সাড়া দেন। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি।
আমার মাথায় ছিল, লোক মোটে আমরা দু’জন। লীগের গুন্ডাদের সামাল দেব কীভাবে? কিন্তু দু’জন সভার পক্ষে এক পায়ে খাড়া। অগত্যা আমার রাজি না হয়ে উপায় ছিল কি? ঠিক হলো মহিলা মুসলিম লীগের নামে সভা ডাকা হবে। জোবেদা খাতুন ছিলেন মহিলা লীগের সভানেত্রী। তিনি ২০০/৩০০ মহিলা মবিলাইজ করবেন। আবার ইশতেহার ছেঁপে মেগাফোন নিয়ে দু’জন প্রতিবাদ সভার প্রচারে নেমে পড়লাম। আমাদের প্রচারের কথা ছিল, মুসলিম লীগের গুন্ডামির প্রতিবাদ ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গোবিন্দ পার্কে জনসভা। সভার তারিখ বেলা ৩টায় চেয়ার টেবিল নিয়ে আমরা দু’জন গোবিন্দ পার্কে ঢুকতে যাচ্ছি এমন সময় পুলিশ আমাদের বাধা দিল। বলল, গেটে কি লেখা আছে? পড়লাম, ‘এতদ্দ্বারা সর্বসাধারণকে জানানো যাচ্ছে অনির্দিষ্টকালের জন্য গোবিন্দ পার্কে ১৪৪ ধারা জারি করা হলো।’ স্বাক্ষর অতিরিক্ত এসপি আবদুল হক। আমরা থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। এমন সময় কাঁধে লাঠি নিয়ে দেখি পশ্চিম দিক থেকে এক মিছিল। কাছে এলে তাদের অনেককেই চিনলাম। দক্ষিণ সুরমার জঙ্গিদের ভয়ে শুধু পাবলিক নয় প্রশাসনও কাঁপে। দেখি তারাই এই মিছিল করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। সবার আগে ধরাধরপুরের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্যক্তি আখতার হোসেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘হবিব মিয়া আজ আমরা আপনাদের সভা রক্ষার কসম খেয়ে এসেছি। দেখি কোনো বান্দির বাচ্চা বাংলা ভাষার দাবির সভা ভাঙতে আসে।’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। এই ব্যক্তিবর্গ বাংলার জন্য জান কোরবান করতে আসবে যা আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল। শুধু পবিত্র কোরআনের বাণী মনে পড়ল যার অর্থ : সত্য এসেছে। অসত্য বিদায় নিয়েছে। অসত্যের পরাজয় হবেই হবে।