প্রবাসীদের অবদান

‘বঙ্গ আমার জননী আমার/ ধাত্রী আমার, আমার দেশ/ কেন গো মা তোর শুষ্ক নয়ন?/ কেন গো মা তোর রুক্ষ কেশ?’ বহুকাল আগে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই বঙ্গভূমির পীড়া দেখে বিচলিত হয়ে এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। সে প্রশ্ন ও এর মীমাংসা আজও হয়নি। আর হয়নি বলেই এই বাংলার সন্তানেরা নিজ ভূমির দুঃখ ঘোচাতে ‘পৃথিবীর পথে’ বেরিয়ে পড়েছিলেন। নিজভূম থেকে পৃথিবীর পথে ছড়িয়ে পড়া এই প্রবাসীরা শুধু ব্যক্তিক প্রয়োজনেই যাননি। যাননি যে, তার প্রমাণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাঁদের অবদান।
উন্নত জীবনের আশায়, উচ্চশিক্ষার টানে কিংবা অন্য যে কারণেই বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে যাক না কেন, তাঁর মন পড়ে থাকে এই জল-হাওয়াতেই। আর এ কারণেই এখানে রেখে যাওয়া স্বজনদের, এখানকার মাটিকে তাঁরা কখনো ভুলতে পারেন না। নিজেদের কষ্টার্জিত উপার্জনের অর্থ নিয়মিত পাঠিয়ে তাঁরা এ দেশকে গড়ে তোলেন পরোক্ষে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরেই যেমন প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১ হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এই রেমিট্যান্সের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। এই অবদান এতটাই যে, ২০০৮ সালে আমেরিকায় শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা যখন পুরো বিশ্বকে চোখ রাঙিয়েছে, তখন বাংলাদেশের জন্য বর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছেন প্রবাসীরা। কোনো অনুমাননির্ভর কথা নয়, সম্পূর্ণ গবেষণালব্ধ ফলাফল এটি।
শুধু অর্থের বিচারেই প্রবাসীদের অবদান বোঝা সম্ভব নয়। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা এক কোটি বাংলাদেশি বেকারত্বের সংকট মোকাবিলাতেও সরাসরি অবদান রাখছেন। রয়েছে তাঁদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক সংগঠন। অথচ এই সবকিছুর পরও এই প্রবাসীদের নানা অবজ্ঞার মুখে পড়তে হয়। নিজ দেশে স্বজনদের কাছে যখন তাঁরা ফিরে আসেন, তখন থেকেই তাঁদের মুখোমুখি হতে হয় নানা হেনস্তার।
প্রবাসজীবন মানেই নিঃসঙ্গতা। তবু দেশ ও দেশের মানুষকে বুকে পুষে এই নিঃসঙ্গতা মেনে নিয়ে প্রবাসীরা করে যান কঠোর পরিশ্রম। কত ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তাঁদের। অথচ বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক থেকে শুরু করে, বাংলাদেশি দূতাবাস, বাংলাদেশে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রবাসীরা নানা বিড়ম্বনার মুখে পড়েন। অথচ বাংলাদেশ, এর সমাজ ও অর্থনীতিতে অবদানের বিপরীতে এটা কখনোই তাঁদের প্রাপ্য হতে পারে না। এটা সত্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার প্রবাসীদের কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে; কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।
না, প্রবাসীরা কোনো প্রতিদানের আশায় দেশের অর্থনীতি ও সমাজে অবদান রাখেন না। তাঁরা এই অবদান রাখেন দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্বশীলতা থেকে। তাঁরা শুধু চান বাংলাদেশ তাঁদের আপন বলে জানুক। বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের বুকে টেনে নিক। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রতিনিয়ত চলমান রাখা এই প্রবাসী জনগোষ্ঠী শুধু চায় প্রতিদান না হোক, অবজ্ঞা যেন না করা হয়।