ফেসবুকের ভালো-মন্দ

আজকের বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাইটগুলোর মধ্যে ফেসবুক অন্যতম। বর্তমান যুগ হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগ। ঘরে বসে আমরা এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারি। এই অনলাইন যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম হলো ফেসবুক, যার মাধ্যমে দূরের মানুষকে একেবারে কাছে আনতে পারি। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনো একটি বিষয় নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করা, মত প্রকাশ করা, স্বাধীনভাবে চ্যাট করার ভার্চুয়াল মাধ্যম এই ফেসবুক। ফেসবুক অনেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর দৈনন্দিন জীবনের এমন একটি অংশে পরিণত হয়েছে, যা থেকে চাইলেও আমরা দূরে থাকতে পারি না।
এই ওয়েবসাইট ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মালিক হলো ফেসবুক ইনক, প্রতিষ্ঠিতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ। তার পুরো নাম মার্ক এলিয়ট জাকারবার্গ। তিনি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালে তাঁর রুমমেট ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র এডওয়ার্ডো সেভারিন, ডাস্টিন মস্কোভিৎস এবং ক্রিস হিউজেসের যৌথ প্রচেষ্টায় ফেসবুক নির্মাণ করেন। ওয়েবসাইটটির সদস্য প্রাথমিকভাবে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরে সেটা বোস্টন শহরের অন্যান্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রসারিত হয় এবং পরে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
ফেসবুক এমন একটি জায়গা যেখানে সম্পর্কের উন্নয়নের ক্ষেত্রটা বিশাল। প্রতিনিয়তই দেশ-বিদেশের অনেক অপরিচিত মানুষের সঙ্গে ফেসবুকের কল্যাণে সম্পর্ক স্থাপন করি আমরা। খুব কম মানুষ আছে যাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। জনপ্রিয় এই সাইটটির মাধ্যমে অনেকে যেমন উপকৃত হচ্ছেন, তেমনি সমস্যারও সম্মুখীন হচ্ছেন।
দেখা যায়, কোনো রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলো, এই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বন্ধুদের জানিয়ে দেয় এবং কয়েকঘণ্টার মধ্যেই দাতা পাওয়া যায়, এজন্য কতগুলো আলাদা পেজও আছে। কাউকে অযথা হেনস্তা করা হলো, প্রতিবাদের ঝড় উঠে এই ফেসবুকে। অন্যায়ভাবে নির্যাতন করা হলো, সেটা ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড করলে শেয়ার হয়, প্রতিবাদ হয় এবং যথারীতি বিচার হয়। ফেসবুক এখন একটি অনলাইন শক্তিশালী মাধ্যম। অনেকে আবার নিজের একাকিত্ব দূর করার জন্য ফেসবুক ব্যবহার করে। এর মাধ্যমেই অনেকে তাদের পুরোনো সেই স্কুল জীবনের বন্ধুদের খোঁজে পেয়েছে। কেউ বা পেয়েছে তাদের প্রিয়জনকে। যারা লেখালেখি করেন, তারা সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন অন্য লেখকদের সঙ্গে। প্রযুক্তি আমাদের সম্প্রীতির বন্ধনটাকে অনেক দূর থেকে অনেক কাছে নিয়ে এসেছে।
আবার উল্টো চিত্রও দেখতে পাই আমরা। দুষ্টরাও বসে নেই এই প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহারে। এই ফেসবুকের বিরুদ্ধেই বিভিন্নজনের অ্যাকাউন্ট থেকে তথ্য চুরি করে তা বিক্রির অভিযোগ উঠেছিল। খোদ মার্ক জাকারবার্গকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। এমনকি মার্কিন নির্বাচন এই ফেসবুকের মাধ্যমে প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠেছে।
তা ছাড়া দেখা যায়, একটি মেয়ের সঙ্গে অনেক দিন ফেসবুক চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে একটি ছেলের সম্পর্ক গড়ে উঠল এবং তা পরবর্তীতে কোনো কারণে ভেঙে গেলে ছেলেটি তখন প্রতিশোধের নেশায় বাজে রকম ছবি কিংবা স্ট্যাটাস দিতে থাকে মেয়েটির নামে। এতে করে মেয়েটি সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়। আবার বিপরীত ঘটনাও ঘটে।
আবার এই ফেসবুকের জন্য অনেকের দাম্পত্য জীবনে ফাটল ধরে। দেখা যায়, স্বামী অন্য কোন নারীর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যাট করছে, তখন স্ত্রী তাকে সন্দেহ করতে থাকে বা স্ত্রী অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে চ্যাট করে দীর্ঘসময়। এতে করে দাম্পত্য সম্পর্কে প্রভাব পড়ে। অনেকে তো পরকীয়ায় জড়িয়ে যায় এবং সম্পর্ক এত দূর চলে যায়, শেষপর্যন্ত সংসার ভেঙে যায়। দেশে-বিদেশে একই অবস্থা। আমেরিকার আইনি প্রতিষ্ঠান ‘আমেরিকান একাডেমি অব ম্যাট্রিমনিয়াল লরিয়ারস’ জানায়, বিচ্ছেদ মামলাকারী ৮০ শতাংশ আইনজীবীই স্বীকার করেছেন, সামাজিক যোগযোগের মাধ্যমের কারণে বিচ্ছেদের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটছে।
এ ছাড়া কেউ কেউ মিথ্যে অসুস্থতার কথা বলে সাহায্য চায়। বিভিন্ন সংগঠনের নাম করে অনেকে সাহায্য চেয়ে নিজে মেরে দেয়। এতে করে সমস্যায় পড়ে সত্যিকার যারা অসহায়, যাদের সত্যি সাহায্য বা সহযোগিতা প্রয়োজন। মিথ্যার ফাঁদে পড়ে এখন অনেকে সত্যি হলেও বিশ্বাস করতে চায় না। আমাদের দেশের অনেক ছেলে ফেসবুকের মাধ্যমে বিদেশি মেয়েদের সঙ্গে প্রণয় গড়ে, যা অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ পর্যন্ত গড়ায়। অবশ্য এতটুকু পর্যন্ত খবরে থাকে। পরবর্তীতে কী পরিণতি হয়, তা থেকে যায় অজানা। এই মাধ্যমে ভুয়া আইডির দাপটও কম নয়।
দেখা যায়, সরাসরি অনেকে কিছু বলতে পারে না। তখন পরিচয় গোপন রেখে মতামত প্রকাশ করতে চাইলে তখনি ভুয়া আইডির সাহায্য নেয়। সেসব আইডি আবার ব্লক করে দেয় অনেকে। মতামতের মিল না হলে অনেক কাছের বন্ধুর সঙ্গেও সম্পর্ক নষ্ট হয়। প্রেমিক-প্রেমিকারাও পিছিয়ে নেই, তারা খেয়াল রাখে কার লেখায়, কোনো মেয়ের স্ট্যাটাসে, কোনো ছেলের স্ট্যাটাসে লাইক দিল, কমেন্ট করল এসব। এতে করে ছোট ছোট অভিমান থেকে দূরত্বের সৃষ্টি হয়, সম্পর্ক ভেঙে যেতেও দেখা যায়। আজকাল তো অনেকে প্রোফাইল লক করে রাখে। ফেসবুকের গুরুত্ব অনেক। প্রথমদিকে মানুষ এতটা আগ্রহী না হলেও এখন অনেকে নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করেন নিজের প্রয়োজনে।
ভালো-মন্দ মিলিয়ে ফেসবুক এখন এক জনপ্রিয় মাধ্যম সারা বিশ্বে।