লালমাটিতে কি স্মৃতিস্তম্ভ হবে?

লাল মাটি। এর মাটি কি লাল? ভালো প্রশ্ন। এ পথে অনেক হেঁটেছি, ট্রেনে-বাসে আসা-যাওয়া করেছি অসংখ্যবার, কখনো এই প্রশ্ন মনে জাগেনি। আজ যখন লালমাটি নিয়ে নিউইয়র্কে বসে লিখতে চাইলাম, অমনি প্রশ্নটা বারবার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল।
লালমাটি, জায়গাটা আপনারা অনেকেই চিনেন। ঢাকা-চট্টগ্রামমুখী ট্রেন সিলেট ছাড়ার মাইলখানেকের মধ্যে পড়বে গুটাটিকর গ্রাম, পাশেই গ্যাস-পেট্রোলিয়াম সংস্থার একটি ডিপো। এরপর প্রায় চার মাইল খোলা, প্রায় সমান্তরাল এগিয়েছে সড়কপথ। দুদিকে হাওর-বিল, কৃষি জমি, দূরে দূরে গ্রাম। অবশ্য মধ্যখানে ‘লম্বাবাক’ নামে একটা জায়গা আছে, পাশে দু-একটি বাড়িও আছে। এই লম্বাবাকে নিশিরাতে প্রায়ই ডাকাত পড়ত। পথচারী বা বাসযাত্রীদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিত। তাই রাতে এ পথে অনেকেই ভ্রমণ করতে চাইতো না। চার মাইল পরে পাওয়া যায় জনপদ খালেরমুখ বাজার। এর দুমাইল পর মোগলাবাজার, আমার গ্রামের বাড়ি। যে চিত্রটি এখানে তুলে ধরলাম এটা একাত্তর সালের। শুনেছি, ওই এলাকায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন রেলস্টেশন হয়েছে খালেরমুখ বাজার। নতুন থানা হয়েছে মোগলাবাজার। আগের কাঁচা-ভাঙা সড়ক এখন পাকা, ভাদেশ্বর-ফেঞ্চুগঞ্জ সহজে যাওয়া যায়। আগের মতো এত খোলা জায়গা চোখে পড়ে না, রাস্তার দুপাশে এখানে-সেখানে অনেক নতুন জনবসতি হয়েছে।
একাত্তরে গুটাটিকর গ্রামের পরেই সড়কের ওপর ছিল পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প। সিলেটের দক্ষিণের সবার শহরে ঢোকার একমাত্র রাস্তা। ক্যাম্পের পরের এলাকাটাই স্থানীয়ভাবে লালমাটি হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে আছে একটি ছোট্ট সড়কসেতু। এই সেতুর পাশেই পাকিস্তানি বিমানের বোমাবর্ষণে নিহত হন আমার আপন চাচাতো ভাই মুহিবুর রহমান বাবু।
একাত্তরে মার্চের শেষ অথবা এপ্রিলের প্রথম। অগ্রসরমাণ মুক্তিযোদ্ধাদের হটানোর জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে, নির্বিচারে চলছে বিমান হামলা। আমরা শহর ছেড়ে মোগলাবাজারে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উঠেছি। কী হচ্ছে শহরে, কোনো খবরই পাচ্ছিলাম না। এক বিকেলে সাইকেল নিয়ে আমি বের হয়ে পড়লাম। দুই মাইল সাইকেল চালিয়ে খালেরমুখ বাজারে এসে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে শহরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এ সময় উত্তরের আকাশে শুনলাম প্রচণ্ড গর্জন। দৃশ্যমান হলো দুটি হানাদার বিমান। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসছে, আসছে দক্ষিণ-পূর্বে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেই দিকে। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি বাস এই ভাঙা রাস্তায়ও সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে আসছে। হঠাৎ গোলা বর্ষণের বিকট শব্দ কানে এল। একটি বিমান নিচুতে নেমে কোনো এক লক্ষ্যবস্তুর ওপর গোলা ছুড়ছে। পরে শুনলাম, শহর থেকে দুটি বাস যাত্রী নিয়ে এই সড়ক ধরে আসছিল, হানাদার বিমান বাস দুটিকে ধাওয়া করে। একটি বাস রুদ্ধশ্বাসে ছুটে জনপদে গাছগাছালির আড়ালে চলে আসে, পিছু নেওয়া বিমানটি বাসটিকে আর দেখতে না পেয়ে এখানে খুঁজতে থাকে।
আমি দেখলাম, আমার মাথার ওপর দিয়ে শাঁ করে বিমানটি উড়ে গেল। ভয়ে আমার আধমরা অবস্থা। দ্রুত সাইকেল নিয়ে কয়েক গজ দূরে বাঁশঝাড়ের নিচে আশ্রয় নিলাম। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম, আমার লুকানোটা দেখা যায় কিনা। মনে হলো, ঠিক জায়গাতেই আছি। ওদিকে দুর্ভাগ্য অপর বাসটির। হানাদার বিমান সেটিকে পেয়ে যায়। সেটির ওপর গোলাবর্ষণ করে। এখানে কিছুক্ষণ লুকানোর পর যখন বিমানের কোনো আওয়াজ আর কানে এল না, বের হয়ে প্রাণপণ গতিতে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে এলাম। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এর একটু পরেই এল মর্মান্তিক খবর। বিমান হামলায় বাবু ভাই নিহত হয়েছেন। আমাদের পলাশের ঘর। বাড়িতে তখন কান্নার রোল।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি পাথর হয়ে গেলাম! ওই বিমানের গোলাবর্ষণের আওয়াজ নিজের কানে শুনেছি, ঘাতক বিমান যে বাবুর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, তা কে জানত! পরে শুনলাম, বিমানের তাড়া খেয়ে বাসটি ওই ছোট্ট সেতুর পাশে থেমে যায়। আমার চাচাতো ভাই বাবু ও খালেরমুখ বাজারের নিকটবর্তী ভাঙি গ্রামের এক বিলাত প্রবাসী—এই দুজন যাত্রীবাহী বাস থেকে নেমে আশ্রয় নেন বাসের নিচে। বাসের বাকি সব যাত্রী গিয়ে আশ্রয় নেন পলাশের সেতুর নিচে। ঘাতক বিমানটি এসে গোলা বর্ষণ করে বাসের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে নিহত হন তাঁরা দুজন। আর সেতুর নিচে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা সবাই প্রাণে বেঁচে যান। শুনেছি, বাবুকে সেতুর নিচে যাওয়ার জন্য সঙ্গী যাত্রীরা ডাকলেও তারা সেখানে যাননি। মৃত্যু তাঁদের টেনে নিয়ে যায় বাসের নিচে।
রাতে একদল সাহসী গ্রামবাসী ঘটনাস্থল থেকে লাশ দুটি নিয়ে আসেন এবং পরদিন দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। আমি শুধু একবার বাবুর লাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস হয়নি।
এই ঘটনার দু-একদিন পর আমাদের শহরে ফেরা জরুরি হয়ে উঠল। কিন্তু কীভাবে ফিরব? ট্রেন-বাস নেই। যেতে হবে হেঁটে, পাকিস্তানি সেনাদের চেকপোস্টের মধ্য দিয়ে। শ্মশ্রুমণ্ডিত, পরহেজগার আমার প্রকৌশলী চাচার (আবিদুর রহমান) নেতৃত্বে আমাদের বাড়ির কয়েকজন হেঁটে রওনা দিলাম। চেকপোস্টে দীর্ঘ সারি। চাকরিজীবী, শ্রমজীবী মানুষ যাচ্ছেন শহরে। আমার পরনে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। বুকে ধড়ফড়, কি জানি কি হয়! এক পাকিস্তানি সৈনিক চেয়ার নিয়ে বসে আছে। তার সামনে দিয়ে যেতে হবে। কাছে যেতেই জিজ্ঞেস করল ‘নকরি’? মাথা নাড়লাম। হাতের ইশারায় বোঝাল, যাও। যেন ফুলসিরাত পার হলাম।
পরে আর কখনো এই চেকপোস্ট মোকাবিলা করতে হয়নি। কারণ ট্রেন চালু হওয়ায় আমরা ট্রেনেই মোগলাবাজার যাতায়াত করতাম। ট্রেন যাত্রীদের জন্য ছিল না কোনো চেকপোস্ট।
তবে একটি ভয়াবহ বিষয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। চেকপোস্টের কাছেই রেল লাইনের পশ্চিম পাশে বড় বড় গর্ত চোখে পড়ল। এগুলো গণকবর। হানাদারেরা মানুষ হত্যা করে এখানে পুঁতে ফেলে। ট্রেনে আসা-যাওয়ার পথে লালমাটিতে এই গণকবর দেখতাম। জানি না, কত বাঙালির রক্তে এই লালমাটি রঞ্জিত।
স্বাধীনতার পর বহুবার আলোচনা হয়েছে, লালমাটির গণকবরে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের যাতে নিহতদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানো যায়। আড়াই যুগ ধরে প্রবাসে আছি, নিশ্চিত নই, এ ধরনের কিছু হয়েছে কি না। কখনো শুনিনি এমন কোনো উদ্যোগের।
দেড় দশক আগের কথা। লালমাটি এলাকায় খোলা জায়গায় একটি আবাসিক বা হাউজিং প্রকল্প তৈরির উদ্যোগ নিয়ে প্লট বিক্রির উদ্দেশ্যে নিউইয়র্কে এসেছেন উদ্যোক্তারা। তাদের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমি উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করলাম, ভালো উদ্যোগ আপনাদের। আরও ভালো হতো যদি আপনারা এখানে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে দিতেন। তারা আমার প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করে বললেন, এখানে গণকবরের কথা আমরাও শুনেছি, আমরা চেষ্টা করব একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের। আমি তাদের ধন্যবাদ জানালাম।
সংবাদ সম্মেলন থেকে বের হওয়ার পর এক সহকর্মী আমাকে বললেন, বলেছেন তো ভালো কথা, কিন্তু কার কাছে বলেছেন। বললাম, কেন, ভুল জায়গায় বলেছি? ওরা করবে না?
বললেন, যত দূর জানি, উদ্যোক্তারা জামায়াত ঘরানার। তাই বলছি, ‘ভূতের মুখে রাম নাম’ কি সম্ভব? হয়তো তার কথাই ঠিক ছিল। আজও যখন কোনো কিছু হয়নি। তবে আশা ছাড়িনি, কেউ না কেউ এই শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে এগিয়ে আসবেন।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।