কবি সমুদ্র গুপ্তের অন্যরূপ

কবি সমুদ্র গুপ্ত
কবি সমুদ্র গুপ্ত

এই শোনো, আমাদের একজন কনসালট্যান্ট আছেন, খুব বড় কবি। তুমি নিশ্চয়ই তাঁকে চেনো। আমি তাঁকে তোমার কথা বলেছি। তিনি তোমার লেখা পড়েছেন।
কে তিনি?
সমুদ্র গুপ্ত।
আমি তাঁকে চিনলাম। তখনো তাঁর গোঁফ পুরোপুরি সাদা হয়নি। চুল অত লম্বা হয়নি। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পুরুষ পৃথিবী’ পড়ে দাদা আমার স্ত্রীকে বলেন, ‘আমি এর একটি রিভিউ লিখব’। তিনি রিভিউ লিখলেন এবং তা দক্ষিণবঙ্গের কোনো একটি লিটল ম্যাগাজিনে ছাপাও হলো। আমি অবশ্য সেই ম্যাগাজিন কোনো দিন দেখিনি। এভাবেই সমুদ্র গুপ্তের সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। একদিন ফোনে আমাকে তাড়া দিয়ে বলেন,
কাল সন্ধ্যায় টিএসসিতে আসিস।
আমি বললাম, কয়টায়?
তিনি কোনো চিন্তা না করেই বলেন, ছয়টায়। একটা জিনিস দেব।
আমার ঘড়িতে ছয়টা বাজতে ১০ মিনিট বাকি। জানুয়ারির শেষ সূর্য বিদায় নিয়েছে একটু আগে। ফ্রোস্টেড গ্লাসের মতো সন্ধ্যা নামে টিএসসিতে। সড়কদ্বীপে উৎসবের আমেজ। তরুণ-তরুণীরা শিশির-সন্ধ্যায় শীতটাকে পাত্তা না দিয়ে জম্পেশ আড্ডায় মেতে উঠেছে। জাতীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন চলছে। টিএসসির ভেতরে কবিদের মুখর পদচারণা। চায়ের কাপগুলো নিমেষেই খালি হয়ে যাচ্ছে।
সঙ্গে ঝালমুড়ি, পাকুড়া, বেগুনি নিমিষেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। কবি জাহিদ হায়দার এক কোনায় চেয়ার-টেবিল পেতে মফস্বল থেকে আসা কবিতার পাহাড় সম্পাদনা করছেন। কবি রবিউল হুসাইন, কবি রফিক আজাদ একদল মুগ্ধ তরুণ পরিবেষ্টিত। চায়ের কাপে আড্ডার ঝড়। আমাকে এদিক-ওদিক তাকাতে দেখে এক কবি প্রশ্ন করেন,
কারে খোঁজেন? বলেই পাঞ্জাবির খুট দিয়ে ঝালমুড়ির মুখ মোছেন। আমি একটু মজা করে বললাম,
কবি সমুদ্র গোঁফতকে। তিনি আমাকে ছয়টায় আসতে বলেছেন।
আর আপনি ছয়টায় চলে এসেছেন? আপনার কমপক্ষে এক ঘণ্টা পরে আসা উচিত ছিল। অবশ্য যদি তাঁর মনে থাকে যে আপনাকে আসতে বলেছেন।
পাঞ্জাবিঅলা কবির কথায় আমি খুব আহত হলাম। আমি কাউকে সময় দিলে তা রাখার চেষ্টা করি এবং প্রত্যাশা করি আমার সঙ্গেও সবাই একই আচরণ করবে।
সমুদ্র গুপ্তকে আমি শুধু কবি হিসেবেই চিনি না। তিনি একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর কনসালট্যান্ট। ‘যদি তাঁর মনে থাকে’ কথাটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
এই লোকের কথা ঠিক হয়নি। কাঁটায় কাঁটায় ছয়টায় সমুদ্র দা এসে হাজির। আমার হাতে একটি ব্রাউন খাম তুলে দিলেন। আমি খামটা খুলে দেখি ‘সাত সমুদ্র’। মলাটের ভাঁজ খুলে দেখি অতি যত্নে লেখা—
‘আমার বোন মুক্তি শরীফ ও বন্ধু কাজী জহিরুল ইসলাম। জীবন হোক দীর্ঘ। যাপন হোক সুখের।
সমুদ্র গুপ্ত। ৩১ জানু ২০০০।’
সমুদ্র গুপ্তকে আমার কখনোই অগোছালো মানুষ মনে হয়নি। সব সময়ই মনে হয়েছে তিনি অত্যন্ত গোছানো এবং একজন আধুনিক মানুষ। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সেই কাজটা তিনি আর করলেন না। ছেড়ে দিলেন। কেন ছেড়ে দিলেন জানি না। তাঁর কিছু কিছু বিষয় আমার কাছে খুব রহস্যময় মনে হয়। সমুদ্র গুপ্তের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি সৈয়দ আবদুস সাদিক প্রায়শই আমাদের কাছে সমুদ্র দা’র আর্থিক অসচ্ছলতার কথা বলেন। বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়নি গত ছয় মাস। এসব কথা বলেন। কিন্তু আমি জানি, যখন ঢাকা শহরে হাতেগোনা কয়েকজনের বাড়িতে কম্পিউটার আছে, তখনই সমুদ্র গুপ্তের ঘরে ইন্টারনেট কানেকশনসহ কম্পিউটার ছিল। সমুদ্র দা’র বাসায় যখন টেলিফোন লাগে, তখন খুব কম কবির বাসায়ই টেলিফোন ছিল। তবে কি তাঁর এই আর্থিক অসচ্ছলতা জীবনকে কবিসুলভ যাপনের এক দুঃখবিলাসী প্রক্রিয়া?
কবি সমুদ্র গুপ্তের মধ্যে একজন বোহিমিয়ান কবি এবং একজন আধুনিক মানুষ একসঙ্গে বাস করে। অনেকে তাঁর মধ্যে এই কম্বিনেশনের কন্ট্রাস্ট প্রতিফলন খুঁজে পেলেও তিনি নিজে তা কখনোই মনে করেন বলে আমার মনে হয় না। তাঁকে দেখলে একজন সুখী মানুষকে দেখার আনন্দে আমার মন ভরে ওঠে। শিশুর মতো অকপট একজন মানুষ।
এবার তাঁর কবিতা নিয়ে দু–একটি কথা বলি। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা এবারের মেলায় বই হবে না?
বললেন, প্রকাশক কই?
আমি বলি, স্ক্রিপ্ট কি তৈরি আছে?
তিনি বলেন, একটি বইয়ের কবিতা তো এক রাতেই লেখা যায়।
এইখানেই তিনি আর সবার চেয়ে আলাদা। আর এখানেই তিনি কবি। অগোছালো, স্বাধীনচেতা। লালনের গান মনে পড়ে যায়, ‘এমন মানব জনম আর কি হবে/মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে’।
যখন সমুদ্র গুপ্তের কবিতার ভেতরে ঢুকি, তখন দেখি তিনি এক তুখোড় বিপ্লবী। শ্রেণিসংগ্রাম তাঁর রক্তে ঝড় তোলে। প্রচণ্ড খেদ ঝরে পড়ে তাঁর পঙ্‌ক্তিতে, ‘বড়লোক গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মানুষ আর/মানুষের সরল জীবন এটাই নিয়ম’ [কুকুর, সাত সমুদ্র, পৃষ্ঠা-১১]। ‘আমার স্বপ্ন এখন প্রচণ্ড রক্তপাতের/অশান্ত অস্থির দু’বাহুতে পৃথিবীরে পিষ্ট করে/ভেঙে চুরে তছনছ করে দেয়ার একটি মিছিল চাই’ [আমার স্বপ্ন এখন, সাত সমুদ্র ১৯]। তাঁর বিপ্লবী মনোভাব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে বাইরে বেরোলাম/পিঠে ঝোলার মধ্যে যুদ্ধকালীন শৃঙ্খলার নোট/কবিতার বই, প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি এবং/লক্ষ্যভেদের যাবতীয় সরঞ্জাম’ [রণকৌশল, সাত-সমুদ্র পৃষ্ঠা-২২]।
কবিতায় নান্দনিকতার চেয়ে সমুদ্র গুপ্ত বক্তব্যকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ কারণে তাঁর কোনো কবিতাই লক্ষ্যহীন মনে হয় না। কবিতাকে তিনি শ্রেণিসংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। তাঁর কবিতায় স্বপ্ন আছে, আবেগ আছে, তবে স্বপ্নাচ্ছন্নতা নেই, আবেগের ভারে নুয়ে পড়েনি কবিতা। উপমা, উৎপ্রেক্ষাহীন তাঁর কবিতার শব্দেরা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে সরাসরি। তারপরেও তাঁকে কখনো কখনো উপমার আশ্রয় নিতে দেখা যায়।
রাত্রির বিদীর্ণ হৃদয়
তার মধ্যে বেঁধেছে বাসা চিল
শকুনের কুর্নিশ শুধুই কপট বিনয়
এ দেশে গভীর আঁধার সবগুলো দরোজায় খিল
[গণতন্ত্রের ভাঙা দেয়াল টপকে, সাত সমুদ্র, পৃষ্ঠা-৬০]
বদ্বীপের আকাশে উড়ে বেড়ানো চিল-শকুনের বিনয়ের মধ্যে যে কেবল কপটতা, এটা যে আমাদের কপট এবং নীতিভ্রষ্ট রাজনীতির এক নিপুণ চিত্রকল্প, তা তিনি অন্তমিল সমৃদ্ধ এই চার পঙ্‌ক্তিতে অত্যন্ত সফলভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। ষাটের দশকের এই কবি যখন একই কবিতায় বলেন,
প্রখর জ্যোৎস্নার পোশাক
ঠুকরে ঠুকরে ছেঁড়ে হাহাকার কাক
এ দেশে গভীর নিশীথ দ্বি-প্রহর রাত
তখন আমরা দেখি এই চিত্রকল্প, এই উৎপ্রেক্ষা, সহস্রাব্দের কবিতার টেবিলেও এক কাপ ধূমায়িত তাজা কফি। এই চিত্রকল্প আজও সময়ের প্রতিভূ হয়ে বিবেকের দরজায় কড়া নাড়ে। ‘গণতন্ত্রের ভাঙা দেয়াল টপকে’ কবিতাটিতে তিনি তাঁর বিষয়বস্তুর লক্ষ্যস্থির রেখেই কবিতার আঙ্গিক নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সমন্বয় ঘটিয়েছেন সব ছন্দের, দেখিয়েছেন উপমা ও অনুপ্রাসের দক্ষ প্রয়োগ, যা কবিতাটিতে যোগ করেছে বাড়তি ‘গতি’ মাত্রা। র‌্যাপ সংগীতের মতো আমাদের এক অনিন্দ্য হৃদমে দোলাতে দোলাতে নিয়ে যায় বিষয়বস্তুর গভীরে, যখন তিনি বলেন—
‘রাত্রির কোলে বসে/পেঁচকেরা ডন কষে/ছুঁচো গায় কীর্ত্তন/চামচিকে দিকে দিকে/ছড়ায় আধুলি সিকে/হাঁক ডাক করে ডাকে/ ঘুরপাক ঘুরপাকে/কুর্দন নর্ত্তন/দাঁড়ালাম বুক চিতে/আনো দেখি গজ ফিতে/মেপে দেখো নেই ফাঁকি/আমিই আসল পাখি/ সকালে ঘুমিয়ে পড়ি/সন্ধ্যায় চিঁ চিঁ ডাকি/আমিই আসল পাখি/চামচিকি চামচিকি/এই শুনে ধেড়ে খোকা/আরশোলা তেলাপোকা/ধুয়া তোলে টিকটিকি’
এরপরেই তিনি ছন্দ পাল্টে দিয়ে বলেন,
‘ক্ষমতা ফুলের গন্ধের লোভে কতো মাছি হলো মৌমাছি/ঘোড়ার ডিমের ব্যবসা ধরেছে/মেডেলের মালা গলায় পরেছে/ নাপতার পোলা কাপতান হলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুরি কাঁচি।’
কী চমৎকার অনুপ্রাস। যাদের ধারণা সমুদ্র গুপ্ত শুধু স্লোগান লেখেন, শুধু নিরেট গদ্যের মালা গাথেন, এই কবিতাটি আমি তাদের জন্য এই নিবন্ধে বিশেষভাবে উপস্থাপন করলাম। আশা করি কবি সমুদ্র গুপ্তকে অন্যভাবে চিনতে এই কবিতা সাহায্য করবে।
কবি সমুদ্র গুপ্ত আমার অতি কাছের মানুষ। তিনি মাঝে মাঝেই বলেন, ‘ওর সঙ্গে আমার অন্য সম্পর্ক’। ‘পুরুষ পৃথিবী’-এর প্রকাশনা উৎসবে কবি আল মাহমুদ, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন আর আমি এক মঞ্চে পাশাপাশি বসেছিলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, আরে আমাদের তিনজনের বাড়িই তো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেলতেই ফজল ভাই বললেন, ‘কবিদের একটাই ঠিকানা, একটাই গ্রাম, তার নাম কবিতাগ্রাম’। সমুদ্র দা’র সঙ্গে আমার যে সম্পর্কই হোক না কেন, সবচেয়ে বড় সম্পর্ক হলো কবিতার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক রক্তের চেয়েও লাল, আত্মার চেয়েও জীবন্ত। আর তাই আমি তাঁর কবিতারই জয়গান করি। কারণ কবিতা ‘অনন্ত নদীর স্রোতে ভাসমান বিশাল বেহালা/রক্তের নিপুণ আঙুলে বেজে ওঠে’।