ফেলনা নয় নারিকেলের মালা

নারিকেলের মালা। ইংরেজি নাম কোকোনাট শেল (coconut shell)। নারিকেলের বাই প্রোডাক্টস (By products)। সেই নারিকেল গাছ ও ফলের ইতিহাসের কিয়দংশে আলোকপাত না করলেই নয়। ভারত মহাদেশে নারিকেলের উপস্থিতির উল্লেখ আসে ৫৪৫ খ্রিস্ট পূর্বে। কসমস আলেকজান্দ্রিয়া রচিত থপগ্রাপিয়া ক্রিশ্চিয়ানা নামে দলিল সংগ্রহে নারিকেল ফলের কথা জানা যায়। পরে ১২৮০ সালে পরিব্রাজক মার্কো পলো সুমাত্রা ভ্রমণকালে আরব কথিত jaws Hindi নামের ফল দেখতে পান। যা সেই অতীতকালে ইন্ডিয়ান নাট বলে পরিচিত ছিল। আরও পরে প্রথম ইউরোপীয় হিসাবে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেওয়া ইতালীয় নাগরিক অ্যান্টোনিও পিগফিতা তাঁর লেখা বইয়ে এই অঞ্চলের অনেক দেশে ইন্ডিয়ান নাট নামে পরিচিত নারিকেলের কথা উল্লেখ রয়েছে। তখন ইন্ডিয়ান নাটের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের পুরো সমুদ্রতট এবং মূল ভূখণ্ডে নারিকেল গাছ রোপণ, পরিচর্যা ও ফল আহরণের বিরাট কর্মযজ্ঞ চলে আসছে শত শত বছর ধরে। আপন স্মৃতিপটে নারিকেল গাছ ছিল একটি প্রাত্যহিক বিষয়। ছোট বেলা থেকে দেখেছি বাসার আশপাশে ছিল কমপক্ষে ১০/১৫টি গাছ। আকার ফলন দুটোতে ছিল অনেক ভিন্নতা যার আদ্যোপান্ত জানতেন আমাদের মা। বছরে গাছের পরিচর্যার যাবতীয় আয়োজন চলতো মায়ের তত্ত্বাবধানে। কচি ডাব ও ঝুনা নারিকেলের ছিল সমান কদর, শুধু রকম ছিল ভিন্ন।
গ্রীষ্মের তাপদগ্ধ দিনে কচি ডাবের ভেতরের মিষ্টি জল সেরা। পানীয় হিসাবে পান করলে শরীর মন দুটোই জড়িয়ে যেত। পরে ডাবকে এক কোপে দুভাগ করে চায়ের চামচ দিয়ে ডাবের ভেতরের সাদা নরম শাঁস খেয়ে নারিকেলের খালি অংশকে এখানে–ওখানে ছুড়ে ফেলে দিলে মা রাগ করতেন, ধমক দিতেন। বারান্দার এক কোণে রাখা টুকরি দেখিয়ে সবাইকে বলতেন, এখানে–সেখানে না ফেলে টুকরিতে জমা করে রাখবে সবাই। ওখানে কেন রাখতে হবে, তা মাকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। পরে জেনেছি সেই জমা করা খালি নারকেলের মালার পরিত্যক্ত এক অংশ মাটির নিচে পুতে রাখতেন, যা পরে প্রাকৃতিক সারে রূপান্তরিত হতো।
রমজান মাসের মাঝামাঝি এলেই শুরু হয়ে যেতো ঝুনা নারিকেল সংগ্রহ ও বিতরণ পর্ব। কাজের ছেলেকে দিয়ে গাছ হতে পাড়া শ খানেক ঝুনা নারিকেল জমিয়ে রেখে খবর দিতেন জুবিলি স্কুলের পিয়ন প্রয়াত আলখাছ আলী মামাকে। তাঁর বাড়ি ছিল নানা বাড়ির পাশের গ্রামে। নানা উৎসব অনুষ্ঠানে আম্মা খবর পাঠালেই বাসায় আসতেন। আমাদের যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। ঈদের দুই সপ্তাহ আগে বাসায় আসতেন জুবিলি স্কুল বন্ধ হওয়ার পর। সঙ্গে থাকত বিশেষ আকারের দা। রান্নার ঘরের বারান্দায় বসে ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে সুনিপুণভাবে পাকা নারিকেল ছুলিয়ে দিতেন। খোসা ছড়ানো নারিকেলের সিংহ ভাগ পাড়ার বিভিন্ন বাসায় পাঠিয়ে মা শুরু করতেন ঈদ আনন্দের সূচনা পর্ব। বিতরণ পর্ব শেষ করে আখলাস মামা বাসায় ফিরে যাওয়ার সময় মা হাতে ধরিয়ে দিতেন ২ জোড়া নারিকেল, সঙ্গে কয়েক কেজি সুগন্ধি চাল। আরও দিতেন ছোট বয়ামে আখের রসালো দানাদার গুড়। সিলেট অঞ্চলে যাকে বলা হয় মরচা গুড়। পিঠা পুলি বানাতে চিনির বিকল্প। নগদ কিছু টাকা ও দিতেন হাতে গুঁজে।
কথিত গুড় আসত কুমিল্লা, চাঁদপুর অঞ্চল থেকে। বোশেখ মাসে সুনামগঞ্জে বোরো ফসল কাটতে ওই সব অঞ্চল থেকে বড় বড় নৌকা করে দল বেঁধে দাওয়ালিরা আসতেন। নৌকায় থাকত ছোট ছোট হাঁড়িতে রসালো বাদামি কালচে রঙের দানাদার গুড়। আরও থাকত তিসি, সরিষা দানা, পাতায় মোড়ানো তেঁতুল, নানা আকারের মাটির পাতিল, থালা–বাসন। তাঁরা ধান কাটতেন ভাগে। তার ওপর সঙ্গে আনা ওই সব ব্যবহার্য সামগ্রী ভালো দামে গ্রামবাসীর কাছে বিক্রি করতেন। কখনো টাকা নয়তো সদ্য তোলা বোরো ধানের বিনিময়ে।
গ্রামের বাড়িতে আমাদের জন্য কেনা সে সব সামগ্রী শহরের বাসায় আসত বড় বড় নৌকায় ধানি ফসলের সঙ্গে। সুনামগঞ্জ শহরের দক্ষিণে বিশাল দেখার হাওর পাড়ি দিয়ে শহর লাগোয়া শিয়াল মারা হাওর হয়ে মরা টিল্লার পাশের খাল বেয়ে বড় নৌকাগুলো একেবারে চলে আসত আমাদের বাসার পেছনে। ধান চাল নিয়ে আসা নৌকা অনায়াসে ভিড়তে পারত বাসার পেছনে বিল আর ঝিলে। প্রাকৃতিক সেসব জলের আঁধার আজ জলশূন্য। সব বিল আর ঝিল ভরাট করে বানানো হয়েছে ইট পাথরের সারি সারি ঘর বাড়ি। কোথায়ও ধুলার আস্তরণসহ ধু ধু মাঠ। পাড়ার ছেলেরা খেলছে টি–২০ ক্রিকেট। দৃষ্টিহীন নাগরিক দৈত্যের আগ্রাসী কালো থাবা আজ শহরের সর্বত্র।
নারিকেলের খালি মালার কয়েক ধরনের পুনর্ব্যবহার করতে দেখতাম আমার মাকে। সব কটি খালি মালাকে পরিষ্কার করে ভিজিয়ে রাখা হতো কয়েকদিন। পরে ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যবহার করা হতো চালের ড্রামে, দানাদার মসুরি বা ছানার ডালের পাত্রে। কয়েকটি বিলিয়ে দিতেন বোনদের রান্না–বাড়া ও খেলার জন্য। আরেকটি ব্যবহার ছিল পিঠা তৈরিতে। মালার দুদিকেই ফুটো করে কাঠি লাগিয়ে বানানো হতো গোলাকৃতির চামচ, যা দিয়ে তেলের পিঠা ভাজা হতো। আর ভাপা পিঠা বানাতে নারিকেলের মালার তো কোনো বিকল্প নেই।
অবাক বিস্ময়ে ছোট বেলা দেখা নারিকেলের মালার পুনর্ব্যবহার দেখলাম শ্রীলঙ্কার কলম্বোয়। ১৯৮৯/৯০ সালে সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘরের বাসিন্দা সৈয়দ শফিক ভাইয়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা, যিনি আজ না ফেরার দেশে। একসময় শহরের সবচেয়ে মেধাবী ও ফ্যাশন সচেতন মানুষ। শহরের প্রবীণ বয়োজ্যেষ্ঠ আইনজীবী মরহুম সৈয়দ আওসাফ হোসেন মোক্তারের দ্বিতীয় সন্তান। সুশিক্ষিত সৈয়দ শফিক ইউনিসেফে কর্মরত অবস্থায় একদিন সুনামগঞ্জ এলেন অফিসের জরুরি কাজে। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্মেলন কক্ষে মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে চাইলেন। সভা শেষে ডাকলেন আমাকে। বললেন, জেলা শহরের একটি স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক প্রকল্প চালাতে তোমাকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা করতে চাই। কাজটি জনকল্যাণমূলক। আশা করি তুমি রাজি হবে। সবকিছু শুনে রাজি হয়ে গেলাম। প্রকল্প ছিল স্বল্প মূল্যে টয়লেট বিতরণ ও ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
কাজ শুরু করার এক মাসের মধ্যে ভারতের বেঙ্গালুরু ভ্রমণ। উদ্দেশ্য ভারতে এর কার্যক্রম দেখে হাতে–কলমে শিক্ষা নেওয়া। যা দেখেছি সংক্ষিপ্তভাবে বলি। স্থানীয় ভাষায় হাজার হাজার প্রচারপত্র বিতরণ, বেতারে, মাইকে প্রচারণা চালানোর পরও শহরের অধিকাংশ মানুষকে আধুনিক টয়লেটে নেওয়া খুবই কষ্টকর কাজ ছিল। ঘুরে ফিরে শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রেল বা সড়ক পথের পাশে বসে পাশের মানুষটির সঙ্গে গল্প করে প্রাকৃতিক কাজ সারতে অনেকের উৎসাহ ছিল খুব বেশি। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ আমাদের সবাইকে ভোরে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে সেই দৃশ্য দেখিয়ে এনেছেন। ব্যতিক্রমী এই অভিজ্ঞতায় সেই দিন চমকে উঠেছিলাম। তেমনি আরেক অভিজ্ঞতা হয়েছিল এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলঙ্কা ভ্রমণকালে। সার্কভুক্ত দেশগুলো ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি ছিলেন সেই দলে। ঢাকা-দিল্লি-কলম্বো ফ্লাইট। এক রাত দিল্লিতে থেকে পরদিন সকালে গেলাম কলম্বো। সুন্দর পরিচ্ছন্ন সুসজ্জিত বিমানবন্দর।
স্থানীয় ইউনিসেফ প্রতিনিধি বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়ে আমাদের নিয়ে গেলেন বিমানবন্দরের সুসজ্জিত ক্যাফেটেরিয়ায়। দেয়ালের পুরোটা নানা রঙের পোস্টার সাঁটা। সবগুলোতেই একটি ছবি আছে। আর তা হচ্ছে, সোজা নয়তো হেলানো নারিকেলের লম্বা গাছ। প্রাতরাশ সেরে উঠলাম ১৫/২০ আসনের মিনিবাসে। ঘণ্টা খানিকের কম সময় পর বাস থামল শহরের উপকণ্ঠে সুন্দর একটি ভবনের সামনে। এটি সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ও ব্যবস্থাপনায় একটি কমপ্লেক্স। বাস থেকে নেমে চোখে পড়ল প্রধান তোরণ। পুরোনো নারিকেল গাছ দিয়ে দুপাশে খুঁটি হতে শুরু করে পুরো তোরণে ব্যবহৃত হয়েছে শুধু নারিকেল গাছের নানা অংশ ও শুকনা ফল। তখনো চিন্তাও করিনি, ভেতরে আরও কী পরিমাণ বিস্ময় অপেক্ষা করছে। লবিতে গিয়ে দেখলাম দলের সবার নামের পাশে রুমমেট ও রুম নম্বরসহ। সব তথ্য নিয়ে শ্রীলঙ্কার তরুণ–তরুণীরা অপেক্ষমাণ। রুমে গিয়ে চারদিকে চোখ বুলাতে গিয়ে দেখি, সব আসবাবপত্র যেমন খাট, টেবিল, ড্রেসিং টেবিলসহ সবকিছুই নারিকেলের গাছের তৈরি।
এমনকি খাটের কোণে ইংরেজিতে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা, খাটের তোষকে ব্যবহার হয়েছে নারিকেলের পরিত্যক্ত ছোবড়া। তোশকে ঘুমাতে গিয়ে বেশ আরামদায়ক মনে হলো। পরদিন সকাল বেলা তড়িঘড়ি করে নাশতার টেবিলে। সারা দিন ঘোরাঘুরি, চলমান কয়েকটি প্রকল্প দেখাতে নিয়ে যাবে আমাদের সব প্রতিনিধিকে। নাশতার টেবিলে বসে তৈজসপত্রের দিকে তাকিয়ে হতবাক। সিরিয়ালের বাটি হতে শুরু করে ছোট ছোট পিরিচসহ চায়ের কাপ সব নারকেলের ফেলে দেওয়ার উপযোগী মালার তৈরি। বিশেষ করে বিখ্যাত সিলন টি–এর মন মাতানো কালচে লাল রঙের লিকার রাখা হয়েছে। কাচও নারিকেলের মালার তৈরি বিশেষ কেটলিতে। দারুণ সুন্দর দেখতে। চায়ের কাপ, চা চামচ সর্বত্রই শুধু নারিকেল আর নারিকেলের পরিত্যক্ত মালা। সব দেখে মায়ের সেই ধমক দেওয়ার কারণ উপলব্ধি করতে মোটেই কোনো সমস্যা হলো না। তাই বুঝি বারবার বলতেন, নারিকেলের মালা ওই টুকরি ছাড়া বাইরে ফেলো না। এসবও কাজে লাগানো যায়। যদি সামান্য পরিশ্রম করে নিজেকে তৈরি করতে পারো। এই পৃথিবীতে কোনো জিনিস ফেলনা নয়। শুধু জানতে হয়, কীভাবে তা ব্যবহার করবে। ভাবলাম শ্রীলঙ্কানরা যদি আমার মাকে দেখত, যিনি আজ হতে ৩০/৩৫ বছর আগেই শুরু করেছিলেন নারিকেলের মালার পুনর্ব্যবহার যা আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতিকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসার পুরস্কার হিসেবে হয়তো এই বিষয়ে একটি দামি পদক পেয়ে যেতেন আমার মা।