কারও পৌষ মাস, কারও হবে সর্বনাশ

আমেরিকার ফেডারেল সরকারে শাটডাউন শেষ হওয়ার পরপরই দেওয়া স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, তার একটি ফল অন্তত হাতেনাতে পাওয়া যাচ্ছে। গ্রিনকার্ডে কোটাপ্রথা বাতিল করে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন অভিবাসী আইন পাসে দুই দলই শক্তিশালী সমর্থন জানাচ্ছে। মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষেই এ সম্পর্কিত দুটি বিল উত্থাপন করা হয়েছে।
কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি জো লোফগ্রেন ও সিনেটর কমলা হ্যারিস বিল দুটি উত্থাপন করেছেন, যার প্রতি শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে রিপাবলিকান দলের। এই বিল পাস হলে প্রতিটি দেশের জন্য সংরক্ষিত কোটা প্রথা উঠে যাবে। দক্ষতা ও আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে তখন আমেরিকায় স্থায়ী বসবাসের অনুমতি মিলবে। আর এমনটি হলে তা বিশেষত চীন ও ভারতের অভিবাসীদের জন্য বড় সুখবর নিয়ে আসবে। বিপরীতে অন্য দেশগুলো, বিশেষত যেসব দেশের অভিবাসীদের উচ্চ দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে, তারা ভুক্তভোগী হবে। তবে এমন পদ্ধতি গ্রিনকার্ড পাওয়ার প্রক্রিয়ায় গতি আনবে।

আমেরিকায় এইচ-১বি ভিসাধারীদের ক্ষেত্রে প্রতি বছর ১ লাখ ৪০ জনকে গ্রিনকার্ড দেওয়া হয়। একবার গ্রিনকার্ড পেলে সারা জীবন আমেরিকায় নির্বিঘ্নে বসবাস ও চাকরি করতে পারেন একজন অভিবাসী। তবে বর্তমান আইনে একটি দেশের সর্বোচ্চ ৭ শতাংশের বেশি অভিবাসীকে গ্রিনকার্ডের অনুমোদন দেওয়া হয় না। সেই হিসাবে এক দেশের সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৮০০ জন গ্রিনকার্ড পেয়ে থাকেন। নতুন আইনে গ্রিনকার্ড অনুমোদনের মোট সংখ্যা বাড়ানো না হলেও তুলে দেওয়া হবে কোটা পদ্ধতি। ফলে কম জনসংখ্যার ও তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর অভিবাসীরা ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোর অভিবাসীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিক দুই দলেরই সমর্থন পেয়েছে এই প্রস্তাব। এমনকি সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ—উভয় কক্ষেই একই ধরনের দুটি বিল প্রস্তাব করা হয়েছে। সিনেটে কমলা হ্যারিসের সঙ্গে বিলটির সহ-প্রস্তাবক হিসেবে রয়েছেন রিপাবলিকান সিনেটর মাইক লি। ‘ফেয়ারনেস ফর হাইস্কিলড ইমিগ্রান্টস অ্যাক্ট’ নামে এই বিল প্রস্তাব করেন তাঁরা। এতে গ্রিনকার্ডের ক্ষেত্রে কোটা তুলে দেওয়ার কথা বলা হলেও পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রিনকার্ড পাওয়ার কোটা ৭ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করার কথাও বলা হয়েছে। ‘এইচআর ১০৪৪’ নামে একই ধরনের আরেকটি বিল আনা হয়েছে প্রতিনিধি পরিষদে। ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য জো লোফগ্রেন এবং হাউসের অভিবাসন ও নাগরিকত্ব-সংক্রান্ত বিচার বিভাগীয় উপকমিটির সভাপতি ও রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য কেন বাক এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

এই দুটি বিলের পেছনে শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে সিলিকন ভ্যালির। মাইক্রোসফট, গুগল, আইবিএমসহ টেকজায়ান্ট কোম্পানিগুলো ছাড়াও ইমিগ্রেশন ভয়েস, কমপিট আমেরিকা কোয়ালিশন, ইমিগ্রেশন টেকনোলজি ইন্ডাস্ট্রি কাউন্সিল, মার্কিন চেম্বার অব কমার্স, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ম্যানুফ্যাকচারার্স, হেরিটেজ ফাউন্ডেশনসহ অনেক সংগঠন এ নিয়ে কাজ করছে। মূলত উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর সরবরাহ বাড়াতেই এ ধরনের একটি আইনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

ন্যাশনাল ল রিভিউয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির কারণে অনেক উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তির গ্রিনকার্ড পেতে বিলম্ব হয়। ফলে তাদের নিয়োগ কর্তাদের এইচ-১বি ভিসা নিয়মিত বিরতিতে নবায়ন করতে হয়। ট্রাম্প প্রশাসন অনুসৃত কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে এই নবায়ন বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। নতুন আইনটি পাস হলে তাই বিশেষত উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, তাদের নিয়োগকর্তা ও পরিবারের সদস্যরা উপকৃত হবেন। তবে বিপাকে পড়বেন সাধারণ বা মাঝারি দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা। কারণ তখন তাঁরা গ্রিনকার্ডের জন্য উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবেন। এতে ভারত ও চীন ছাড়া অন্য দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের বর্তমানের চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গ্রিনকার্ডের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এসব দেশের নাগরিকদের সে ক্ষেত্রে গ্রিনকার্ড পেতে প্রায় ৭ বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি গ্রিনকার্ড প্রাপ্তির সম্ভাব্যতা বিচারে অন্য দেশের উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের এইচ-১বি ভিসা পেতেও অনেক কাটখড় পোড়াতে হতে পারে।

নতুন এই আইন পাস নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে আমেরিকার স্বাস্থ্য খাত। প্রযুক্তি খাতের উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের অধিকাংশই ভারত ও চীনের নাগরিক হলেও চিকিৎসা ক্ষেত্রে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন নার্সের বড় অংশই আসে অন্যান্য দেশ থেকে। এই পেশা আবার এইচ-১বি ভিসার তালিকাভুক্ত নয়। ফলে খাতটি কর্মী সংকটে ভুগবে।

নতুন এই আইন মূলত ভারত ও চীন থেকে এইচ-১বি ভিসায় আসা হাজার হাজার উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর বিড়ম্বনা কমাতে করা হচ্ছে। ফলে এটি অন্য দেশের অভিবাসীদের জন্য ইতিবাচক কোনো বার্তা নিয়ে আসবে না। একই সঙ্গে আরেকটি দুঃসংবাদ রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন এইচ-১বি ভিসাধারীদের জীবনসঙ্গীদের কাজের অনুমোদন বন্ধের বিষয়ে ভাবছে। ফলে ভারত ও চীনের বাইরে থেকে আসা এইচ-১বি ভিসাধারীদের গ্রিনকার্ড পেতে যেমন দেরি হবে, তেমনি তাদের সঙ্গীদের উপার্জনের পথও বন্ধ হয়ে যাবে।

ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন এই আইন পাস হলে এইচ-১বি ভিসা ছাড়া কোনো ব্যক্তির পক্ষে গ্রিনকার্ড পাওয়া একরকম অসম্ভব হয়ে উঠবে। এতে প্রযুক্তি খাত বিশেষ সুবিধা পেলেও স্বাস্থ্য খাতসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হবে। এই প্রক্রিয়া অন্য দেশগুলোর অভিবাসীদের জন্য বঞ্চনা নিয়ে আসবে। কারণ তাদের গ্রিনকার্ড পেতে অনেক লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে। ফলে তাদের পরিবার ও বিশেষত সন্তানদের আমেরিকায় স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়াটা পুরোপুরিই ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে।

এই সমস্যা নিরসনের জন্য বিশেষজ্ঞরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। নিউজার্সিভিত্তিক মানা টিভির সঞ্চালক ও অভিবাসন অধিকারকর্মী জ্যোৎস্না শর্মা বলেন, এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। কেউ গ্রিনকার্ডের আবেদন করলে তার পরিবারের সদস্যদের কাজের অনুমতি দিয়ে দিলে, গ্রিনকার্ডের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষাও তাদের ওপর তেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। এতে অনেক দক্ষ কর্মী স্বচ্ছন্দে আমেরিকায় কাজ করতে পারবেন, যা থেকে উপকৃত হবে আমেরিকাই।’