জল দিয়ে হয়েছিল লেখা

চারদিকে বৈশাখের আগমনী গান। দীর্ঘ শীতের শেষে নিউইয়র্কের প্যাকেটবন্দী মানুষেরা যেন খোলস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কনকনে শীতের এই দেশে বৈশাখ এলে মানুষ ভুলে যায় বিগত দিনের অতৃপ্ত দিবস রজনীর কথা। শীতের সময় শুধু কাজ আর কাজ। একঘেয়েমি জীবন। কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জায়গা নেই। দর্শনীয় স্থানগুলো এ সময় বন্ধ থাকে। তাই বৈশাখ যখন দোরগোড়ায়, ভার জ্যাকেটের পরিবর্তে রং-বেরঙের পোশাকে দেখা যায় সবাইকে।

এমন দিনে আলখাল্লা পরিহিত গাল ভর্তি দাড়িতে শৈবালকে দেখে চমকে উঠে মাহতাব। প্রথমে চিনতে পারেনি। গলার স্বর বড় বেশি চেনা লাগায় ঘুরে তাকায়। মাহতাব উচ্ছ্বসিত হয়ে ভিড় ঠেলে ছুটে যায় কাছে। জড়িয়ে ধরে শৈবালকে। দোস্ত, কী খবর রে! সেই যে বিয়ে করলি, বাসা বদল করলি, তারপর তো আর কোনো খবর নাই তোর। হরহর করে এতগুলো কথা বলে থামে মাহতাব। একটু ইতস্তত করে শৈবাল। বলে, ‘আর বলিস না, সংসার, সন্তান, কাজ আর ব্যস্ততায় সব মিলিয়ে সময় হয়ে উঠে না।’ অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় মাহতাবকে। হিজাব পরিহিতা নারীর দিকে ফিরে তাকায় মাহতাব। দারুণ সুন্দরী আর স্মার্ট। ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক, চোখে গাঢ় কালো কাজল, আইশ্যাডো। এক পলকে মনে হবে কোনো অ্যারাবিয়ান নারী। পাশেই হাত ধরে দাঁড়িয়ে তিন-চার বছরের ফুটফুটে কন্যা। তার মাথায়ও হিজাব। যেন এক পরির ছানা! ‘একদিন আয় না বাসায়। নিউজার্সি তো খুব বেশি দূরে নয়’, বলে মাহতাব। শৈবাল সম্মতি জানায়। ফোন নম্বর বিনিময় করে দুই বন্ধু।

মাহতাব এসেছে নিউজার্সি থেকে। মাসে একদিন ছুটির দিনে নিউইয়র্ক এসে বাজার সদাই করে নিয়ে যায়। খুব তো আর দূরে নয়। টানেল পেরোলেই নিউজার্সি। সেখানকার তুলনায় নিউইয়র্কে জিনিসপত্রের দাম অনেক কম। মাহতাব প্রতিবার নিউইয়র্ক আসে অনেকগুলো পরিকল্পনা হাতে নিয়ে। স্ত্রী মহুয়া আর একমাত্র কন্যাকে নিয়ে আসা বৈশাখের অনুষ্ঠান উপলক্ষে। মহুয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্রী ছিল। ভালো গান করে। বিশেষ উৎসবের দিনগুলোতে নিউইয়র্কে আসে অনুষ্ঠান দেখতে, গাইতে নয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ম্যাচিং করে শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে। চুড়ি, টিপ, খোঁপায় ফুল, সব মিলে বেশ টিপটপ মহুয়া। এই বিদেশে এসেও একেবারে খাঁটি বাঙালি সে। আজ পরেছে লাল-শাদা রং। নিউইয়র্ক এলে অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়, বেশ চমৎকার সময় কাটে তাঁদের। রাতে বাঙালি রেস্তোরাঁয় ভাত, মাছ, ভাজি, ভর্তা দিয়ে ডিনার সারে।

বাড়িতে নিজের হাতের রান্না খেতে খেতে একঘেয়েমি লাগে। তাই নিউইয়র্ক এলে বাঙালি রেস্তোরাঁয় খাওয়া চাই তাঁদের। এ ছাড়া মাসে একবার এমন আনন্দময় গোটা একটি দিন কাটানোর পর কঠোর পরিশ্রম করলেও ক্লান্ত লাগে না। অপেক্ষা থাকে মাস শেষে আবারও এমন দিনের। খাবার শেষে লিস্ট অনুযায়ী বাজার করে একটু রাত করেই বাড়ির দিকে রওনা হয় মাহতাব পরিবার। মাহতাব ড্রাইভ করছে। মহুয়া বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আছে। রেকর্ডারে বেজে যাওয়া গানে নিমগ্ন। প্রকৃতির এই নিকষ অন্ধকার দেখতে ভালো লাগে তাঁর। হাইওয়ে ধরে শাঁ শাঁ শব্দে গাড়িগুলো ছুটে চলছে। গাঢ় অন্ধকারে গাড়িগুলোর হেডলাইটের আলো অনেকটা বিড়ালের চোখের মতো মনে হচ্ছে। যেন শত শত হুলো বিড়াল দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

কিন্তু মাহতাব ভাবছে অন্য কথা। গানের দিকে মোটেও মনোযোগ নেই তাঁর। এমন করে জনমানুষের ভিড়ে বৈশাখ মেলায় এই বেশে শৈবালকে পেয়ে যাবে ভাবেনি সে। শৈবালকে ক্লিনসেভ, হাতে একগোছা ব্রেসলেট, গলায় রকমারি চেইন কিংবা কাইতনে ঝোলানো লকেট পরা যার শখ, জিনস, বডি ফিটিংস শার্ট কিংবা টি-শার্টে যাকে পাংকু এবং স্মার্ট দেখে অভ্যস্ত। যে কি না গার্লফ্রেন্ড বদল করত জামা বদলের মতোই, সে-ই বছর সাতেকের ব্যবধানে আমূল বদলে গেল! মাহতাবের মনে পড়ে, শৈবাল যেবার দেশে গিয়ে বিয়ে করে আসল, সেবার তাঁর মাঝে এক রকম আতঙ্ক বিরাজ করছিল। স্ত্রীকে এ দেশে আনার আগে বাসা নিল দূরের কুইন্স ভিলেজে। যেখানে তাঁর কোনো বাংলাদেশি প্রতিবেশী ছিল না বললেই চলে।

ট্যাক্সি চালানো পেশা ছেড়ে দিয়ে ওষুধের কোম্পানিতে তুলনামূলক কম আয়ের কাজ নিয়েছিল। স্ত্রী এ দেশে এসে যদি দেখে স্বামী ক্যাব ড্রাইভার, এটা নাকি চরম মান সম্মানের ব্যাপার হবে তাঁর জন্য। এ ছাড়া বেশি স্বদেশি মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করলে কখন কে কোন কুবুদ্ধি দেয় কে জানে! এসব শৈবাল নিজেই বলেছিল মাহতাবকে। সেই আতঙ্কেই দূরে, নিরিবিলিতে বাসা নিয়েছে সে। কিন্তু এমন করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করবে, তা কে ভেবেছিল? শৈবালের এমন মানসিকতা হুট করেই হয়নি। এর পেছনে বন্ধু মাহতাবের অতীত জীবন অনেকটাই ভাবিয়েছে তাঁকে।

বন্ধুদের মধ্যে সবার আগে বিয়ে করেছিল মাহতাব। কেএফসিতে এক সহকর্মীকে ভালো লেগে যায় তাঁর। ভালো লাগা থেকে প্রেম ও পরিণয়। সেই সংসার টেকেনি বেশি দিন। স্ত্রীর অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করতে দেখা, একা ঘুরতে যাওয়া, রাত করে বাড়ি ফেরা—এসব সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি মাহতাব। কে-ই বা মেনে নেবে? সংসার মানেই তো কম্প্রোমাইজের ব্যাপার। দুজন দুজনকে সম্মানের চোখে দেখবে। মানিয়ে নেবে। তাই না? মাহতাব এসবে বাঁধা দেওয়ায় বিবাদ চরমে পৌঁছায়। অতঃপর কথা-কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়িয়েছে। সেদিন নিজের রাগটা দমন করতে পারেনি মাহতাব। বিবাদের একপর্যায়ে স্ত্রীকে একটু জোরেই ধাক্কা দিয়েছিল সে। টেবিলের কোনায় গিয়ে পড়েছিল স্ত্রীর কপালের একপাশ।

কিছুটা রক্তাক্ত হয়েছে যদিও। মাহতাব পর মুহূর্তেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে অস্থির হয়ে উঠেছিল। ব্যান্ডেজ এনে ক্ষতস্থান চেপে ধরেছিল বরফ দিয়ে। কিন্তু স্ত্রী তাঁর বন্ধুকে ফোন করায় ওই বন্ধু দ্রুত ছুটে আসে। ওই বন্ধু ৯১১-এ কল করার পরামর্শ দেয়। পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স আসে। মাহতাবকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তারপর সেই সংসারে আর ফিরে আসেনি স্ত্রী। মাহতাব প্রায়ই ভাবে সংসার তো ছেলেখেলা নয়! মান অভিমান, রাগ, ক্রোধ থাকবেই। ভুল হবে, ভুল থেকে সংশোধন হওয়ার সুযোগ থাকবে। তাই বলে ডিভোর্সের মতো কঠিন এবং যন্ত্রণাদায়ক সিদ্ধান্ত নিতে হবে!

একসময় মাহতাব, শৈবাল আর মাহিন এক বাড়িতে সাবলেট হিসেবে থাকত ব্যাচেলর হিসেবে। দিলটা যারপরনাই ভালো হলেও মাহতাব ছিল বেশ রাগী প্রকৃতির। রাগ আয়ত্তে রাখতে পারত না। মেজাজ গরম হলে কী করতে কী করে ফেলে নিজেও জানে না। রাগ পড়ে গেলে নিজেই অনুতপ্ত হয়, ক্ষমা চায়। শৈবাল উড়া ধুরা। ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য নিয়ে সে মাথা ঘামাত না। কাজের শেষে বান্ধবী নিয়ে টাইম পাস করতে ভালোবাসতো। দেশে তাঁর কোনো পিছুটান ছিল না। মাস শেষে ডলার পাঠানোর চিন্তা ছিল না।

কিন্তু মাহিনের অবস্থা পুরোই উল্টো। ভালো ছাত্র ছিল বলে জমিজমা বিক্রি করে স্টুডেন্ট ভিসায় এ দেশে এসেছিল। কিন্তু পড়াটা বেশি দিন চালিয়ে যেতে পারেনি। কাজ আর পড়া, দুটো এক সঙ্গে চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তার মধ্যে আবার নিজের থাকা খাওয়ার খরচও বহন করতে হতো। দেশে মা এবং ছোট ভাইবোনের জন্য ডলার পাঠানোর চিন্তাও বেশি দূর পড়া চালিয়ে যেতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল। মাহিন পরহেজগার। বয়স বাড়ছে অথচ কাগজপত্র না থাকায় দেশে গিয়ে বিয়ে করা কিংবা স্ত্রীকে এ দেশে নিয়ে আসা, কোনোটারই সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি তাঁর। যা আয় রোজগার, তার বেশির ভাগই বৈধ কাগজপত্র তৈরির কাজে ব্যয় হয়ে যায়। কেউ গ্রিন কার্ড করে দেওয়ার আশ্বাস দিলে সে বিশ্বাস করে। মানুষের মন যখন কোনো বিষয়ে দুর্বল থাকে, তখন সম্ভবত সে নির্বোধের মতো কাজ করে। চিন্তা কিংবা বিবেচনা, বোধ-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। কেউ তো চাইলেই কাউকে গ্রিন কার্ড করে দিতে পারে না। সবকিছুর একটা সিস্টেম আছে। আইন আছে। কিন্তু তবুও মাহিন এই বৈধ কাগজ পাওয়ার প্রশ্নে যেন একটু বেশিই বোকা। কর্মক্লান্ত দিনের শেষে রাতে নিজের রুমে ফিরে সে প্রার্থনায় বসে রোজ। স্রষ্টার কাছে একটাই চাওয়া তাঁর। কতকাল মাকে দেখেনি! ছোট ভাইবোন দুটি নিশ্চয়ই এত দিনে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে! মা কি বুড়ো হয়ে গেছে? মা, ভাইবোনসহ পাঁচ

সদস্যের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারটিতে অভাব ছিল অর্থের, কিন্তু সুখের অভাব ছিল না মোটেও। প্রিয় মানুষদের মায়া ভরা মুখ ভেসে ওঠে একে একে। মাঝে মাঝে রাতে চার দেয়ালের এই রুমে দম বন্ধ হয়ে আসে তাঁর। মনে হয় সব ছেড়ে ছুড়ে ফিরে যায় দেশে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে দেশে গেলে মা, ভাইবোনের কী হবে? বাবা তো বেঁচে নেই। সংসারের হাল কে ধরবে? আয় রোজগার না থাকলে যে পুরো পরিবারকে পথে বসতে হবে! ছোট ভাইবোনের পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। এই সব মনে হলে সে আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। সপ্তাহের সাত দিনই কাজ করে। দেশে কিছু ডলার পাঠিয়ে, নিজের থাকা খাওয়ার খরচ মিটিয়ে বাকি ডলার বৈধ কাগজপত্র তৈরির আশায় ব্যয় করে। ছোটে ল’ইয়ারের চেম্বারে।

ইদানীং আবার কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের ধরপাকড় শুরু করেছে ‘আইস’ (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট)। তারা নিউইয়র্কের বাসা বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে। কী ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে মাহিনের তা কেবল সে-ই জানে। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণ। বার্ষিক এই ভাষণে অবৈধ অভিবাসীদের তাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন পদ্ধতিতে সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ‘আইস’ ও পুলিশের কার্যক্রমের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে কিছু সংগঠন। মাহিন সেখানে গিয়ে জানতে পারে এমন লোকজন বাড়িতে নক করলে কোনোভাবেই দরজা না খোলার পরামর্শ দিচ্ছেন। এমন সংকটের দিনে শঙ্কা আর প্রার্থনায় দিন কাটে মাহিনের।

তখন গ্রীষ্মের ছুটি চলছিল স্কুলে। গরমের মৌসুম হলেও চমৎকার আবহাওয়া নগরীতে। তিন বন্ধু অনেক দিন পর মাহতাবের নিউজার্সির বাড়িতে এক সঙ্গে হতে যাচ্ছে। মাহতাবের স্ত্রী মহুয়া বেশ শৌখিন। বাড়িটি সাজিয়েছে শৈল্পিকভাবে। ছায়া সুনিবিড় বৃক্ষ পথের দুই ধারে। সবুজ ঘাসের লন পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই গেটের দুপাশে বিশালাকৃতির দুটি লোহার অ্যান্টিক কালারের বক দাঁড়িয়ে। লম্বা পা বিশিষ্ট বক দুটির একটির মাথা আকাশের দিকে। অন্যটি মাথা নুইয়ে কিছু খুঁজছে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। কী যে নান্দনিক দৃশ্য!
বাসার ভেতরে আরও অবাক হওয়ার পালা। দেয়ালের অনেকখানি অংশজুড়ে বাংলাদেশের গ্রামীণ পটভূমির চিত্র আঁকা। বয়ে চলা নদী, বাতাসে একদিকে হেলে পড়া ধানখেত, পাশেই কিছু শালিক।

ছবিটি দেখলেই যে কারও মনে হবে সে বুঝি বাংলাদেশের কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে নদীর কাছে বসে আছে, কান পাতলেই শোনা যাবে মেঘনার কুলকুল ধ্বনি। বাঁ দিকের দেয়ালে মোনালিসার রহস্যময় হাসির ছবি। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার পথে মাহতাব-মহুয়ার সাদাকালো ছবি টাঙানো। ছবিটি দেখলে মনে হবে ১৯৫৭ সালের কোনো সুপারহিট চলচিত্রের নায়ক-নায়িকার পোস্টার। সব মিলিয়ে পুরো বাড়ি যেন কোনো শিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্সসহ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর বেশ অনেক দিন দেশে মায়ের কাছে ছিল মাহতাব। মন খারাপের সেই সময়ে বিয়ের কথা ভাবাটাও যেন পাপ! এমনই সময়ে মায়ের হুমকি আর জোরাজুরিতে মহুয়াকে বিয়ে করেছিল মাহতাব। মহুয়া তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্রী। সেদিন মায়ের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না, ভাবে মাহতাব। নইলে এমন গুণী, উচ্ছল, প্রাণবন্ত মহুয়াকে পাওয়া হতো না তাঁর। 

কলিং বেলের শব্দে সম্বিৎ ফেরে মাহতাবের। সদর দরজায় এগিয়ে যায়। সস্ত্রীক এসেছে শৈবাল। অদূরে মাহিন হেঁটে আসছে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে। কাছাকাছি সময়ে এসে গেছে অতিথিরা। অতিথি বলতে বন্ধু শৈবাল, তাঁর স্ত্রী, কন্যা আর বন্ধু মাহিন। মোটে চারজন। তবুও যেন ঘরভর্তি মানুষ। কিছু মানুষের উপস্থিতিতে ঘরকে ভরা কলসের মতোই পরিপূর্ণ মনে হয়। পুরো বাড়ি হেসে ওঠে যেন! কুশল বিনিময় শেষে শৈবাল মাহতাবকে উদ্দেশ্য করে বলে, দোস্ত দরজায় এই যে বক দাঁড় করিয়ে রেখেছিস, এতে গুনাহ হবে। এদের তো প্রাণ দিতে পারবি না! দেয়ালের সাদাকালো ছবির দিকে চোখ পড়তেই বলে, ভাবি আপনার ঘরে তো ফেরেশতা আসবে না। যে ঘরে মানুষ, প্রাণীর ছবি থাকে, সে ঘরে ফেরেশতা আসে না। অনেক তো হলো, এবার আল্লাহর পথে চলা উচিত। মাহতাবের স্ত্রী মহুয়া খানিক অপ্রস্তুত হলেও দ্রুতই সামলে নেয় নিজেকে। হাসিমুখে অতিথিদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে নিয়ে যায় লিভিং রুমে। দুপুরের খাবার শেষ হতে হতে প্রায় বিকেল। ব্যাকইয়ার্ডে এসে বসে সবাই। চমৎকার উত্তাপহীন একটি বিকেল। হালকা বাতাস এসে ছুঁয়ে যায় গা। কত শত গল্প তাঁদের! ব্যাচেলর থাকার সময় কার কী দোষ ছিল কিছুই বাদ যায়নি। যেদিন মাহতাবের রান্নার দিন আসতো, সেদিনই ঝামেলা হতো। কখনো লবণ কম বা বেশি হতো। কখনো বা ঝাল। এ নিয়ে হুলুস্থুল বিবাদ হতো শৈবালের সঙ্গে।  মাহিন অবশ্য বরাবরই নিরিবিলি, শান্তিপ্রিয়। তাঁর একটাই সমস্যা, শৈবাল নিজের বিছানার পাশের ওয়ালে নিজের খালি গায়ের সালমান খান স্টাইলের বিশাল এক ছবির পোস্টার টাঙিয়ে রেখেছিল। এতে মাহিনের নামাজের ব্যাঘাত ঘটতো। কখনো উচ্চ স্বরে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলত বলে মনোযোগ দেওয়া যেত না। এ নিয়ে শৈবালকে বলেও কোনো লাভ হতো না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্প এগোয়। কিছু অতীত সামনে আসুক কেউ চায় না। এলে বিব্রত হতে হয়। মাহতাব এবং শৈবালের এমন বিব্রতকর অতীত থাকলেও, এইদিক থেকে মাহিন অনেকটাই নিরাপদ। 

মাহতাব এবং শৈবালের মেয়েরা ব্যাকইয়ার্ডের একপাশে দোলনায় দুলছে। স্ত্রীরা নিজেদের মাঝে গল্পে মশগুল। বাগানজুড়ে নানান রকম ফুল ও সবজি। মহুয়ার নিজের হাতে লাগানো। মাহতাবও রোজ বিকেলে সহযোগিতা করে। পানি দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার করা সব। শৈবালের স্ত্রী আমিনা মহুয়াকে যতই দেখছে শুধু মুগ্ধ হচ্ছে। এত প্রাণশক্তিতে ভরপুর নারী সে জীবনে কমই দেখেছে। মুখ ফুটে বলেই ফেলে, ‘ভাবি, কীভাবে সামলান এত কাজ? বাইরে কাজ করছেন, বাচ্চাকে নিজেই পড়াচ্ছেন, আবার এত বড় বাড়ি টিপটপ পরিপাটি রাখা। সপ্তাহ শেষে শতভাগ বাঙালি নারী হয়ে শাড়ি পরে সেজেগুজে বেড়াতে যাওয়া...খুব হিংসে হয়।’ মহুয়া হাসে। বলে, ‘স্বামী যদি স্বামী না হয়ে বন্ধু হয়, মন ভালো থাকে। মন ভালো থাকলে প্রাণশক্তি আপনা থেকেই শরীরে ভর করে। একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত।’ আমিনার মন খারাপ হয় নিজের স্বামীর কথা মনে করে। বলে, ‘বিয়ের আগে রং-বেরঙের জামা পরে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতাম। এ দেশে আসার পর শৈবালের মন রাখতে হিজাব পরতে হচ্ছে। কোথাও নিয়ে যেতে চায় না। বলে পরপুরুষের সঙ্গে কথা বললে গুনাহ হবে। অথচ যতটুকু জেনেছি সে তো এমন ছিল না বিয়ের আগে! একেবারেই বিপরীত মেরুর ছিল।’ দীর্ঘশ্বাস নেয় আমিনা। 

মাহতাবের ডাকে দুজনেই ফিরে তাকায়। ওঁদের পাশে গিয়ে বসে। গল্পে যোগ দেয় মহুয়া ও আমিনা। শৈবাল প্রসঙ্গ পাল্টে মহুয়াকে বলে, ‘ভাবি, মুসলমান হিসেবে সব নারীর পর্দা করা উচিত না? বয়স তো আর কম হলো না! আমাদের সবার মৃত্যু ভয় থাকা উচিত। পরপারে গেলে তো জবাবদিহি করতে হবে, কী বলেন?’ মহুয়া কথা না বাড়িয়ে শুধু বলে, ‘পর্দা করা মানেই যদি শুধু হিজাবে চুল ঢেকে রাখা হয়, তবে আমি তাঁকে পর্দা বলি না। মনের পরিচ্ছন্নতা আগে। তারপর খাস দিলে নিজের আগ্রহে কখনো যদি মনে হয় সেভাবে চলা উচিত, চলব। কাউকে দেখানোর জন্য, খুশি করার জন্য তো আর পর্দা করা ঠিক না, কী বলেন?’ মাহতাব এবং মাহিনও সায় দেয় মহুয়ার কথায়। 

গল্পে গল্পে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। একঝাঁক পাখি উড়ে যায় আকাশের অনেকটা নিচ দিয়ে। নীড়ে ফিরছে হয়তো। অতিথিদেরও বাড়ি ফেরার তাড়া। শেষ বিকেলের রক্তিম আলো এসে পড়ে মহুয়ার মুখে। তাঁকে খুব কাছের চেনা কোনো মায়াবী রমণী মনে হয়। কখনো মনে হয় পাশের বাড়ির অতি আপন কেউ। অতিথিদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেয় মাহতাব-মহুয়া দম্পতি। মাহতাব ভাবে সময়ের ভেলা মানুষকে কখন কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কেউ জানে না। শুধু জানে মহুয়ার মতো একজন ভালোবাসার মানুষ থাকলে আর কিচ্ছু চাই না তাঁর এই জীবনে। মহুয়া তাঁর জীবনে মায়ের দেওয়া উপহার, আশীর্বাদ। মহুয়া তাঁর ভালোকে যেমন ভালোবেসেছে, তেমনি মন্দকেও। অনেকটা রবি ঠাকুরের শেষের কবিতার লাইনগুলোর মতো, ‘যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায়, ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি...’। চারপাশে সন্ধ্যার রক্তিম ঘন অন্ধকার। মাহতাব মহুয়ার হাত ধরে লনের দুর্বা মাড়িয়ে হাঁটছে বাড়ির দিকে। দক্ষিণের চেরি গাছের দিকে আঙুল তুলে মহুয়া বলে ওঠে, এত শখে আর যত্নে সাজানো এই বাড়ি, যদি তোমার আগে মৃত্যু হয় আমার, তবে ওই চেরি গাছের নিচে সমাধিস্থ করো। তোমাদের কাছাকাছি রেখো। সমাধিফলকে লিখে দিয়ো যা মন চায় তোমার। মাহতাব এই চমৎকার সন্ধ্যায় বিষণ্ন হতে চায় না। মজা করে বলে, ‘কিটসের এপিটাফে যা লেখা আছে, তাই লিখে দেব, চলবে? Here lies one whoes name was written in water’, এখানে শুয়ে আছে একজন, যার নাম জল দিয়ে হয়েছিল লেখা।