বৃষ্টি ও বিভ্রম

বাস ফেরিতে ওঠার পর পরই লাবণ্য আর বাদল ফেরিতে নেমে পড়েছিল। নদীতে তখন বৃষ্টি ঝরছে। কখনো জোরে কখনো থেমে থেমে, বাতাসে একেকবার তেরসা হয়ে ফেরির ভেতর ঢুকে পড়ছে, বৃষ্টির ছাঁট। সেই বৃষ্টির ঝাপটা খারাপ লাগছিল না বাদলের। সে বলল, “মনে হচ্ছে ছোট বেলার মতো ছোঁয়াছুঁয়ি খেলি। কত দিন পর এমন বৃষ্টিতে তোকে পেলাম।”
লাবণ্য বলল, “বেশি ছুঁতে এসোনা, বাসের জানালায় মায়ের চোখ ক্যামেরা হয়ে ঘুরছে।” জানালার দিকে তাকাতেই লাবণ্যের মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল বাদলের। একই পাড়ায় বসবাসের সূত্রে বাদলের তিনি খালা। সে বলল, “খালা আমাকে অতি ভালো ছেলে বলে জানেন, আমার ঢাকায় যাওয়ার কথা শুনে তোদের টিকিট কাটতে দিলেন।”
লাবণ্য বলল, “ওই পর্যন্ত ঠিক আছে।”
তাহলে বেঠিক কোনটা?
ওই যে, তোমাকে ভালো ছেলে ভাবা!
তার মানে কী হলো?
আরে হাঁদারাম, বিবাহযোগ্য কন্যার মায়েরা পাড়ার চ্যাংড়াদের অত ভালো চোখে দ্যাখে না।
আমি কি পাড়ার চ্যাংড়াদের দলে পড়ি? লাবণ্য হাসতে হাসতে বলল, “তা ছাড়া কি! আপনি আমার কে হন জনাব?”
প্রশ্নটি অভাবিত নয়, তবে আচমকা। বাদল বহুদিন ধরেই এ ধরনের একটি প্রশ্নের উত্তর মনে মনে তৈরি করে রেখেছিল। মাস তিনেক পর সে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বুয়েট ছাড়বে। ছাত্র হিসেবে তার সুনাম আছে। ভালো কিছু বন্ধু বান্ধবীও তার মনের কথা জানে। শুধু যার জানার কথা সেই লাবণ্যকে সে এখনো কিছু বলতে পারেনি। এখন সুযোগ পেয়েও সে কিছু বলতে পারল না।
বলল, “তোর কিছু হতে হবে কেন?”
-“তাহলে এত ছোঁয়াছুঁয়ির দরকার নেই, দূরে থাক।”
বাদল বলল,
“বৃষ্টি তোমায় ছুঁয়ে যেতে পারে,
ছুঁয়ে যায় জল হাওয়া
আমার জন্য বরাদ্দ শুধু
অনিমেষ পথ চাওয়া।”
তার কণ্ঠে অভিমান না অভিযোগ জড়িয়েছিল লাবণ্য বুঝতে পারল না। সে অস্ফুট স্বরে বলল, “মজা করছ?”
আকাশে বিদ্যুতের চমক তখন প্রবল শব্দে চরাচর আলোকিত করে আবার মেঘের আড়ালে চলে গেল। বিদ্যুৎ চমকের সেই চকিত আলোয়, লাবণ্যের নাকটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠতে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল বাদল। মুখে বলল, “এই কবিতার সঙ্গে তোর কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তোকে কি তুমি করে বলি?”
মন খারাপ হয়ে গেল লাবণ্যর, সে বলল, “তুমি থাকো, আমার ভাল্লাগছেনা। আমি গেলাম।”
বৃষ্টির তেজ তখন একটু বেড়েছে, একেকবার একেকদিক থেকে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাদল বলল, “ভিজে একেবারে একশা হয়ে যাবি। খালার যেটুকু গুডবুকে ছিলাম সেটাও আর থাকতে পারব না।” লাবণ্য বলল, “তুমি গুড বুকে থাকলে আমার লাভ? তুমি তো আর আমার জন্য কবিতা লিখবে না!”
বাদল বলল, “ও রাজকন্যার গোস্বা হওয়ার কারণ বোঝা গেল, ওরে পাগল ও কবিতা আমি লিখিনি। ওটা আমাদের স্যারের লেখা।”
“তোমাদের স্যার কি ইয়াং নাকি? প্রেমে পড়ার মতো রোমান্টিক কবিতা!”
বাদল হাসতে হাসতে বলল, “কোনো সময়তো ইয়াং ছিলেন!”
লাবণ্য বলল, “ছোট বেলায় আমরা ছড়া বানাতাম মনে আছে?”
বাদল বলল, আমি কিছু ভুলিনি, সেই যে “আমার হলদে মোরগ ঝুঁটি, খায় মাছ পুঁটি।”
হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল লাবণ্য, এইটা আমি লিখেছিলাম, তুমি মনে রেখেছ?” বাদল বলল, “করিস কি? সবাই তাকাচ্ছে।” লাবণ্য সামলে নিয়ে বলল, “তুমি তো মায়ের মতো করছ। তাকায় তাকাক। আমরা তো শুধু হাসাহাসিই করছি।”
ফেরির এই অপ্রশস্ত বারান্দা একটু পর পর নানান রকম মানুষে ভরে যাচ্ছিল। কখনো ফেরিওয়ালা, কখনো ভিক্ষুক, কখনো টিকিট হাতে ফেরির লোক, কখনো অন্য গাড়ির যাত্রী। বাদলের মনের মধ্যে লাবণ্যের “আপনি আমার কে হন জনাব” প্রশ্নটি উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। সে একটু নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিল প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার জন্য। লাবণ্যের কথা মনে করে সে কয়েকটি কবিতা লিখেছিল, কিছুক্ষণ আগে আওড়ানো কবিতাটিও তার লেখা। প্রত্যাখ্যানের ভয়ে কখনো সে কথা বলা হয়নি।
লাবণ্যের ভাই বোন সেলিব্রিটি ধরনের না হলেও প্রায় সবারই দেশ জোড়া খ্যাতি। এ জায়গাটাতেই বাদলের বাঁধো বাঁধো ঠেকে। তার বাবা বলেন, মধ্যবিত্তের বিত্ত নাই, অহংকার আছে। তারা সব সময় ওপরের দিকে তাকায়। সারা জীবন সে লাবণ্যের যোগ্য হওয়ার চেষ্টা করেছে। অন্তত: লাবণ্যদের বাসার কেউ যেন বলতে না পারে, আরও ভালো পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হলে ভালো হতো। লাবণ্যর ভাই-বোনদের একজন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন আর্কিটেক্ট। লেখাপড়ায় ভালো হওয়া সত্ত্বেও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চেষ্টা না করে সে ইকোনমিকস পড়ে এম এম কলেজে। জিজ্ঞেস করলে বলে, না হলে মার সঙ্গে কে থাকত?
বাদলের মনে হয়েছে কথাটি, পুরোপুরি ঠিক নয়।
লাবণ্য ফেরির বারান্দা থেকে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানিতে হাত ভেজাচ্ছিল। আকাশের মেঘ, বৃষ্টির বেখাপ্পা আচরণ, বৃষ্টির ফোঁটা ঢেউয়ের ওপর ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাতাসের হুটোপুটি আর লাবণ্যের পানি নিয়ে বালিকাদের মতো খেলা করা, বাদলের মনের মধ্যে একটা ঘোরের সৃষ্টি করেছিল। সে লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে বলল:
তোমার বাবার আটতলা বাড়ি
আমি তো এখনো অসফল
ফোন করি আর বারবার কাটি
তুমি মনে কর মিসড কল।
ঝলমলিয়ে হেসে উঠল লাবণ্য। “আমাদের তো আটতলা বাড়ি নেই, এইটা নিশ্চয় আমার জন্য লেখা না! আমি ঢাকায় যাচ্ছি কেন জান? মেজ আপার বাসায় পাত্র আসবে আমাকে দেখতে। আমেরিকায় থাকে। ইঞ্জিনিয়ার।”
বিব্রত হয়ে গেল বাদল। কিছু বলল না। ফেরির আরেক দিকে একটা ছেলে কাঠি আর হাতে বকুল ফুলের মালা জড়িয়ে, যাত্রীদের পিছু পিছু বিক্রির জন্য ঘুরছিল। লাবণ্যের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সে মালা ওয়ালাকে দেখতে থাকল। একটু আগে একজন ভিক্ষুক, আম্মা ভাত খাইতাম, একটা টকা দ্যান বলতে বলতে লাবণ্যের কাছে টাকার কান্না কেঁদে গিয়েছে। তাকে নকল করে, বাদলের সামনে হাত পেতে লাবণ্য বলল, “স্যার আমার পাঁচটা টাকা দিতেন।” বাদলের বিব্রত ভাব কেটে গেল। সে পকেট হাতড়ে পাঁচ টাকার একটি কয়েন বাড়িয়ে দিল।
লাবণ্য বলল, “মালা ওয়ালাকে একটু ডাকা যাবে স্যার? ভিক্ষার টাকায় এক খান মালা কিনতাম চাই।”
অনেক দরাদরি করে লাবণ্য একটা মালা কিনে, মালাটিকে ভাগ করে ছোট ছোট মালা বানাতে লাগল। তারপর বাদলের দিকে রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বলল, “আমি মালার ব্যবসা করতে চাই। আছেন কোনো স্যার, আছেন কোনো ম্যাডাম!”
বাদলের একবার মনে হলো, লাবণ্য মালাটি তাকে দিতে চাইছে। আবার মনে হলো যদি তা না হয়? মালা নেওয়া মানে কি মালাবদল? আমেরিকা থেকে আসা সেই ইঞ্জিনিয়ার পাত্রটি কেমন? সে তো নিশ্চয়ই লাবণ্যকে আমেরিকায় নিয়ে যাবে। লাবণ্যের কি তখন তার কথা মনে পড়বে?
ও স্যার মালা নেবেন? বলতে বলতে লাবণ্যর চোখ ছল ছল করে উঠল। বৃষ্টির ঝাপটা তখন বাদলকে কাক ভেজা করে ফেলেছে। লাবণ্য তাকে কাছে টেনে নিয়ে তার এলোমেলো ভেজা চুল, ওড়না দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে ধরা গলায় বলল, মালা চাই স্যার? বাদল বুঝে উঠতে পারল না কি বলবে, সে বলল, খালা তাকিয়ে আছে।
মালাগুলি নদীতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, বাসে ফিরে যেতে যেতে লাবণ্য বলল, “আমার মালা নেওয়ার মতো কেউ নেই রে নদী। মালা তোর কাছেই থাক।”