নির্জন বাতিঘর হয়ে আছে যে বাড়ি
সিলেটের হাউজিং এস্টেট। সিলেট নগরীর প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। অভিজাত এলাকা বলেও পরিচিতি এই হাউজিং এস্টেট। প্রধান ফটক মূল সড়ক লাগোয়া। না চেনার কসরত নেই। প্রধান ফটক পেরিয়ে কিছু দূর এগোলেই একটি দৃষ্টিনন্দন নির্জন বাড়িতে চোখ থমকে যায়। বাড়িটির কাঠামোতে ঐতিহ্যের ছাপ। আসাম কাঠামোর বাংলাবাড়ির আদল। বাড়ির সামনে নাম না জানা বৃক্ষশোভায় কেমন জানি একটা দুঃখ-দুঃখ ভাব। মনে হয় এই বাড়িতে পাখিদের শোকসভা চলছে। জনারণ্যে জনশূন্য এই বাড়ি হাউজিং এস্টেটের নতুন প্রজন্মের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অনেকেই জানে না এই বাড়ির বাসিন্দাদের গল্প। যে গল্প প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের জন্য গর্বের।
আমাদের গর্বের ধন এই বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসা সেবায় অবিচল থাকা শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমদের। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (বর্তমানে শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমদ সদর হাসপাতাল) শল্য বিভাগের প্রধান ছিলেন শামসুদ্দীন আহমদ। সুদর্শন, নীতিপরায়ণ, মিষ্টভাষী হলেও কিছুটা গুরুগম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী শামসুদ্দীন আহমদের পেশাগত দায়িত্ববোধ, কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল অসীম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিরাপত্তা নেই বলে মেডিকেল কলেজের অনেক অধ্যাপক, শিক্ষার্থী ও নার্স হোস্টেল ও হাসপাতাল ছেড়ে যেতে থাকেন। এ সময় বয়ঃকনিষ্ঠ চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিকেল কর্মীদের প্রতি শামসুদ্দীন আহমদ অনুরোধ করেন আহত ব্যক্তিদের সেবা করতে। সবার হাতে ওষুধ ও চিকিৎসার সরঞ্জাম তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাইরে গিয়ে মানবতার সেবা কর।’ যাঁদের সেবা করতে বলেছিলেন, তাঁরা আহত, আমাদেরই প্রতিবেশী, পরিবার-পরিজনের পরম আত্মীয় সর্বোপরি বাংলাদেশের মানুষ। সিলেটে পাক সেনাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে কিংবা পাকিস্তানিদের অতর্কিত হামলায় আহতেরা। চারপাশে হত্যা ও ধ্বংস দেখেও শুধু পেশার প্রতি অঙ্গীকার ও মানবতার কারণে কর্মস্থল ছেড়ে যাননি শামসুদ্দীন আহমদ। তাঁকে অনেকেই বলেছিলেন হাসপাতাল থেকে চলে যেতে। কিন্তু চিকিৎসাসেবাব্রতী শামসুদ্দীন আহমদের সারল্য ভরা এক কথা—চলে গেলে আহতদের চিকিৎসা দেবে কে?
৮ এপ্রিল, ১৯৭১। ইতালীয় সাংবাদিক ও সাহায্যকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল ভারত থেকে তামাবিল হয়ে সিলেট শহরে আসে। শামসুদ্দীন আহমদ তাঁদের গোটা হাসপাতাল ঘুরিয়ে নিরীহ নাগরিকের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নগ্ন হামলার প্রত্যক্ষ প্রমাণ তুলে ধরেন। এই ঘৃণ্য আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বক্তব্যও দেন। তাঁর বক্তব্য দলটি রেকর্ড করে, যা পরে ইতালিতে প্রচারিত হয়। পরদিন ৯ এপ্রিল মেডিকেল কলেজের পাশে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হয়। হাসপাতালের অদূরবর্তী টিলা থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি কনভয়ে আক্রমণ করে। এতে কনভয়ের সামনের জিপ উল্টে যায় এবং তিনজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী হাসপাতাল এলাকা ঘিরে ফেলে। কিছুক্ষণ পর মেজর রিয়াজের নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি সেনা হাসপাতালে প্রবেশ করে।
আন্তর্জাতিক আইনে চিকিৎসক ও নার্স হত্যা অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু এই আইন গ্রাহ্য করেনি পাকসেনারা। হাসপাতালে কোনো মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান না পেয়ে তারা যাঁকেই সামনে পেয়েছে, তাঁকেই বাইরে এনে দাঁড় করাতে থাকে। শামসুদ্দীন আহমদ ও তাঁর সহকারী ডা. শ্যামল কান্তি লালাকেও টেনেহিঁচড়ে সীমানা প্রাচীরের কাছে দাঁড় করায় তারা। এ সময় শামসুদ্দীন আহমদ নিজের পরিচয় দিয়ে তাদের ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করেন। পাকিস্তানি সেনারা প্রথমেই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তিনটি গুলি লাগে তাঁর শরীরে। একটি বাঁ ঊরুতে, দ্বিতীয়টি পেটে ও তৃতীয়টি বুকে। ১৩ এপ্রিল কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ শিথিল হলে কয়েকজন নিকটাত্মীয় এসে তাঁর ক্ষতবিক্ষত মরদেহ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ছোট গর্ত করে দ্রুততার সঙ্গে সমাহিত করেন। অন্যদের মরদেহও পাশে সমাহিত করা হয়। বর্তমানে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে এখানেই বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে।
শামসুদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভারতের আসাম প্রদেশের করিমগঞ্জ শহরের বৃন্দাশীল গ্রামে। বাবা ইমাম উদ্দিন আহমদ, মা রাশেদা বেগম। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ১৯৩৯ সালে সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে বৃত্তি ও লেটার পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক, ১৯৪১ সালে সিলেট মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করে ভর্তি হন কলকাতা মেডিকেল কলেজে। ১৯৪৬ সালে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৬২ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন থেকে এফআরসিএস করেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে। উনসত্তরের গণ-আন্দোলন চলাকালে তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজে কর্মরত ছিলেন। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা হত্যার মিথ্যা সনদ দিতে তিনি রাজি হননি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ড. জোহার অস্ত্রোপচার করেছিলেন শামসুদ্দিন আহমদ; বাঁচাতে পারেননি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলেছিলেন, শামসুজ্জোহাকে প্রথমে কাছ থেকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে জখম করার পর গুলি করা হয়। যদিও পাকিস্তান সরকার এটাকে ক্রসফায়ার বলে চালাতে চেষ্টা করেছিল। শামসুদ্দীন আহমদ সেই ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন সব পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন। শহীদ শামসুজ্জোহার মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত প্রথম শোকসভায় তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন। সে সভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষক সরকারি রোষানলের ভয়ে আসেননি । ১৯৬৯ সালেই তিনি সিলেট ফিরে আসেন।
১৯৬৭ সালে গঠিত সিলেট জেলা পরিষদ আবাসিক এলাকা বা হাউজিং এস্টেটের তিনি প্রথম পর্যায়ের বসতি স্থাপনকারী। তাঁর ছায়াঘেরা মায়াময় বাসাটির হোল্ডিং নম্বর ‘৬৯’। ১৯৬৯ সালে ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ হাউজিং এস্টেট অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠাকালে প্রথম সভাপতি মনোনীত হন। তিনি আম্বরখানা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর কথাতেই সিলেটের তৎকালীন বরেণ্য দানবীর ছুন্নত চৌধুরী স্কুলের জন্য ভূমি দান করেছিলেন।
শহীদ চিকিৎসক শামসুদ্দীন আহমেদের সহধর্মিণী অধ্যক্ষ হোসনে আরা ছিলেন সিলেটের নারী শিক্ষার অগ্রদূত। সিলেটের নারী শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নে ১৯৫০ সালের দিকে কাজ শুরু করেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে সিলেট মহিলা কলেজ ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। দীর্ঘ ৩২ বছর তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠকে এগিয়ে নিতে মেধা-শ্রম দিয়ে কাজ করেছেন। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ ওই অঞ্চলে, তথা সমগ্র দেশের নারী প্রগতিতে ধারাবাহিক অবদান রেখে চলেছে।
বিদ্যায়তনিক শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নের পাশাপাশি নীতিবোধ ও মূল্যবোধের উৎকর্ষ সাধনে অধ্যক্ষ হুসনে আরা আহমেদের অবদান অনন্য। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকজুড়ে সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক-সাংগঠনিক উদ্যোগের আয়োজন ও নেতৃত্বদানে তিনি রেখেছেন বলিষ্ঠ ভূমিকা। ২০১৮ সালের ১৬ জুলাই অধ্যক্ষ হুসনে আরা আহমেদ নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। অধ্যক্ষ হোসনে আরার উদ্যোগে ও সহযোগিতায় আম্বরখানা শিশু স্কুল যাত্রা করে। এই স্কুলে আমার শিক্ষার হাতেখড়ি। শহীদ চিকিৎসক শামসুদ্দীন আহমেদ ও অধ্যক্ষ হোসনে আরা পরিবার শুধু হাউজিং এস্টেট নয়, সমগ্র সিলেটবাসীর গর্ব। তাঁদের কাছে আমাদের ঋণের কোনো শেষ নেই।
শহীদ চিকিৎসক শামসুদ্দীন আহমেদের দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলে সালাহউদ্দীন আহমদ (প্রকৌশলী) ও জিয়াউদ্দীন আহমদ (চিকিৎসক)। মেয়ে ফরহাত জামান, রাহাত হোসেইন ও মালেকা আহমদ। তাঁরা দীর্ঘ কয়েক দশক থেকে আমেরিকায় বসবাস করছেন। সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করলেও দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন তাঁরা। পাঁচ ভাই-বোনই দেশে বিভিন্ন জনহিতকর কাজে সম্পৃক্ত। সম্প্রতি উপশহরে অস্থায়ীভাবে যাত্রা করা সিলেট কিডনি হাসপাতাল গঠনের সাহসী উদ্যোগে তাঁদের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। প্রচারবিমুখ এই পরিবারের সন্তানদের গৌরবের কথা তাঁদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রকাশিত হয়। ফুলের সৌরভ যেমন লুকিয়ে রাখা যায় না, তেমনি বরেণ্য মানুষদের অবদানও লুকানো যায় না। ২০১৮ সালের ১৩ মে শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদ ও অধ্যক্ষ হোসনে আরা পরিবারের ছোট ছেলে ডা. জিয়াউদ্দীন আহমদ আমেরিকায় এমন এক সম্মাননা লাভ করেন, যা আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের মুখ উজ্জ্বল করে। মূলধারার সংবাদপত্রে সে সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়। জিয়াউদ্দিন আহমেদ ওই দিন আমেরিকার সম্মানজনক এলিস আইল্যান্ড মেডেল অব অনার পদক লাভ করেন। আমেরিকার পর্যটকদের রক তীর্থস্থান এলিস আইল্যান্ড অনার সোসাইটি ১৯৮৬ সাল থেকে মেডেল অব অনার চালু করেছে। অভিবাসী বা মার্কিন নাগরিক সমাজ তাঁদের কর্মের জন্য এই সম্মাননা পেয়ে থাকেন।
এই সম্মান পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন আমেরিকার সাবেক সাতজন প্রেসিডেন্ট। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সান্দ্রা ওকানোর, নোবেল পদক পাওয়া ইলাই ওয়াসেল, মালালা ইউসুফজাই, করেটা স্কট কিং, জন সচুলেই, মোহাম্মদ আলী, রোজা পার্ক প্রমুখ। এই পদকপ্রাপ্তদের সামরিক বিভাগের যৌথ দল গার্ড অব অনার দেয়। ভাবগম্ভীর এক অনুষ্ঠানে পরিবার-পরিজনের সামনে সম্মাননা নেন পদকপ্রাপ্তরা। মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন করা এই সম্মাননা আমেরিকার মূলধারার একটি সম্মাননা হিসেবে স্বীকৃত।
ডা. জিয়াউদ্দীন আহমদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, আর দেশপ্রেম পরিবারের কাছ থেকেই অর্জন করেছিলেন তিনি। তাই ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় দুর্গত মানুষদের সহায়তা করতে সেই দুর্গম চর জব্বারে তিনি চলে যান। জিয়াউদ্দিন আহমেদ আমেরিকায় সিলেটী কমিউনিটির অন্যতম অভিভাবক। ২০১৭ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সিলেট সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি ফিলাডেলফিয়ার ডেক্সসেল ইউনিভার্সিটি অব মেডিসিনের অধ্যাপক।
সিলেটের হাউজিং এস্টেটের প্রধান ফটক পেরোলেই যে বাড়িটি, তা শুধু আর বাড়ি নয়। গৌরবজনক ইতিহাস লেপ্টে আছে এর পরতে পরতে। এই বাড়ির একসময়ের বাসিন্দারা সাধারণের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ। এই অসাধারণ হয়ে ওঠার পথে তাঁদের এই আবাসস্থলটি হয়ে উঠেছে এক বাতিঘর, দুর্যোগে-দুর্বিপাকে মেধা, নিষ্ঠা ও সততা দিয়ে পথ দেখানোটাই যার ব্রত।