স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানেরা

দাম্পত্য জীবনে সবাই সুখে থাকতে চায়। দেখা যায় বিয়ের এক বছর কিংবা দু বছর সুন্দর করে সংসার করে অনেকে। এরপর আস্তে আস্তে শুরু হয় সমস্যা। কারও ইগোর সমস্যা, কারও অর্থনৈতিক সমস্যা, তো কারও শারীরিক সমস্যা। আসলে সমস্যা যা-ই থাক না কেন, সেটা সরাসরি কথা বলে সমাধান করে ফেলা ভালো। আর যদি মনে হয়, না এই মানুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে চাই না, তাহলে আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো সন্তান নেওয়ার আগে। সন্তান নেওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদে তাদের হয়তো তেমন ক্ষতি হয় না। কিন্তু এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সন্তানদের। মানসিক যন্ত্রণায় থাকে সন্তানেরা। অনেক সময় আদালত নির্ধারণ করে দেন, কার কাছে কত দিন সন্তান থাকবে, বাবা কতটুকু ভরণপোষণ করবে ইত্যাদি। এতে করে শিশুটি এক ধরনের টানাহেঁচড়ার মধ্যে চলতে থাকে।
মাত্র দুদিন আগে কানাডাতে ঘটে গেল এক নির্মম ঘটনা। ঘটনাটি এগারো বছর বয়সী স্কুলছাত্রী রিয়াকে নিয়ে। ডিভোর্স হয়ে যাওয়া বাবা-মায়ের সন্তান রিয়া থাকত মায়ের সঙ্গেই। মায়ের সঙ্গে জন্মদিন পালন করে বিকেলের দিকে বাবার সঙ্গে জন্মদিনের আনন্দ শেয়ার করতে যায় রিয়া। তখনো হয়তো এই বাচ্চা মেয়েটি ধারণা করতে পারেনি এটিই তার জীবনের শেষ দিন। আর করবেই বা কী করে, গিয়েছে তো বাবার কাছে। বাবা হচ্ছে পৃথিবীর নিরাপদ আশ্রয়। সেই বাবাই কিনা তাকে খুন করল!
বাবার কাছ থেকে সন্ধ্যার মধ্যেই মায়ের কাছে ফিরে আসার কথা ছিল রিয়ার। কিন্তু সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও রিয়া ফিরে না আসায় মা চিন্তিত হয়ে পড়েন। অপেক্ষা করে রিয়ার মা রাতে পুলিশের শরণাপন্ন হন। পুলিশকে রিয়ার মা বলেন, মেয়ে ও নিজের ক্ষতি করবে এমন কিছু মন্তব্য করেছে রিয়ার বাবা রুপেশ কুমার। পুলিশ তৎপর হয়ে খোঁজ নেয় এবং রিয়ার বাবা রুপেশ কুমারকে ধরে ফেলে। পুলিশ ভেবেছিল রিয়াকে অপহরণ করে রুপেশ পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রুপেশ গাড়িতে একা ছিল। পরে রুপেশের বাড়ির বেসমেন্ট থেকে মৃত অবস্থায় রিয়া রাজকুমারকে উদ্ধার করা হয়। রিয়ার বাবার হয়তো বিচার হবে। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি কি ফিরে আসবে? সমাজে কি এর প্রভাব পড়বে না? তা ছাড়া মায়ের এই কষ্ট, এই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন। প্রায়ই এ রকম হচ্ছে; এর সবগুলো যে সংবাদমাধ্যমে আসে তা নয়।
শুধু কি বিদেশে? এই তো কিছুদিন আগে বাংলাদেশেও ডিভোর্সি এক বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে নিজ কন্যা সন্তানকে যৌন নির্যাতনের। অভিযোগকারী স্বয়ং বাচ্চাটির মা। একজন মায়ের কাছে এটা কতটা পিড়ার, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। চিকিৎসক মেয়েটিকে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিয়ে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেন। একটা বাচ্চা মেয়ে এই যে হেনস্তা হলো, তার কি আর মানুষের প্রতি বিশ্বাস থাকবে? প্রতি মুহূর্তে মেয়েটি মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করবে। আরও অবাক ব্যাপার হচ্ছে এই ধর্ষণের সাক্ষী মেয়েটিরই ছোট ভাই। বিচ্ছেদের আগে চিশতীর বিরুদ্ধে তাঁর স্ত্রী অভিযোগ ছিল গৃহকর্মীকে ধর্ষণের। একপর্যায়ে মেয়েটি গর্ভবতীও হয়। এই সব নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে সেনা কর্মকর্তা তাঁর স্ত্রীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। ফলে ওই নারী বাধ্য হয়ে সেনা কর্মকর্তাকে ডিভোর্স দেন। কিন্তু বাচ্চারা বাবা-মা দুজনের কাছেই থাকত। এই যে টানাপোড়েন চোখের সামনে বাবা-মায়ের বাগ্‌যুদ্ধ, এগুলো দেখেই তো বাচ্চাগুলো বড় হচ্ছে। তাদের মনে কি এর প্রভাব পড়ে না? অবশ্যই পড়ে। ছোট বলে হয়তো কিছু বলে না। কিন্তু বড় হয়ে এই বাচ্চাগুলো কি অন্যদের মতো করে জীবন-যাপন করতে পারবে? এখন তো আরও বেশি কঠিন হয়ে যাবে। পুলিশের কাছে মেয়েটির মা কয়েকবার গিয়েও কেস ফাইল করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে মেয়েটির মা মিডিয়ার শরণাপন্ন হন। এ আরেক সমস্যা। ক্ষমতার দাপটে একজন ধর্ষক বাবাও হয়তো পার পেয়ে যাবে। মিডিয়ায় এলেই যে আমরা শুধু আপন মানুষ দ্বারা শিশুদের নির্যাতিত হওয়ার কথা জানতে পারি, তা নয়। আমাদের চারপাশে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। সবগুলো মিডিয়ায় আসে না। কিন্তু নির্যাতন চলছে প্রতিনিয়ত।
কিছুদিন আগে পরিচিত এক দম্পতির ডিভোর্স হলো। দুজনেই শিক্ষিত, স্মার্ট। মিলছে না কিছুতেই। তাঁদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ইগো। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নরাজ। তাঁদের একটি সন্তান রয়েছে। আদালতের আদেশ অনুযায়ী বাচ্চাটি বাবার কাছে দুদিন থাকবে সপ্তাহে। অর্থাৎ টানাহেঁচড়ার জীবন। সহজেই বলা যায়, স্বামী-স্ত্রীর ইগোর বলি হলো সন্তানটি। তার বাবা-মা হয়তো আবার বিয়ে করবেন। কিন্তু তখন বাচ্চাটির কী হবে? ভাঙা পরিবার বলে চারপাশ তাকে উপহাস করবে তাকে; এটাই সমাজের বাস্তবতা।
আমি আরেক বাবাকে চিনি, যিনি পেনসিলভানিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী থাকেন নিউজার্সি। তাঁদেরও ডিভোর্স হয়ে গেছে। সন্তান দুটি। বাবা দুই সপ্তাহ পরপর বাচ্চাগুলোকে দেখতে আসেন। তবে তাঁদের সবচেয়ে ভালো দিক হলো তাঁরা সন্তানদের নিয়ে টানাটানি করেন না। সন্তানেরা যখন যেখানে থাকতে চায়, থাকে। এখন হয়তো বাবা আরেকটা বিয়ে করেননি, তাই ভালো আছে। কিন্তু আবার বিয়ে করলে তো তখন আর সময় দিতে পারবেন না।
এ রকম শত শত উদাহরণ আছে। আজকাল ডিভোর্সের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো স্বামী তাঁর রাগের বহিঃপ্রকাশ স্ত্রীর ওপর না করে করছেন সন্তানের ওপর। প্রতিশোধের আগুন পুড়িয়ে মারছে সন্তানকে। অনেকেই আবার সামাজিকতার ভয়ে চেপে যান। ভাবেন বাচ্চাদের কথা। এক ধরনের আপস বলা যায়।
বিদেশ হোক আর দেশ, বাবা-মায়ের সম্পর্ক একই সন্তানের সঙ্গে। শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, ধনী বা গরিব; এতে কিছু যায় আসে না। একজন দরিদ্র মা যেমন তাঁর সন্তানকে ভালোবাসেন, তেমনি বিত্তশালী মাও তাঁর সন্তানকে ভালোবাসেন। মায়ের ভালোবাসায় কোনো পার্থক্য নেই। সামাজিকতার পার্থক্য থাকে, শিক্ষায় পার্থক্য থাকে, অর্থে-বিত্তে পার্থক্য থাকে, কিন্তু সন্তানের প্রতি যে ভালোবাসা, তাতে কোনো পার্থক্য নেই।
যাদের সংসারে অশান্তি বিরাজ করছে, কেন করছে তা খুঁজে দেখুন অযথা সন্দেহ পোষণ না করে। খোলাখুলি কথা বলুন দুজনে। সংসার ভাঙে মূলত সন্দেহ, আর অবিশ্বাসের কারণে। তাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দেয়াল থাকা উচিত নয়। আর ভুল হলে, তা ভাঙিয়ে দেওয়া উচিত। সংসার ভাঙা সহজ, কিন্তু টিকিয়ে রাখা কঠিন। আপনি ভাবছেন, এই লোক ভালো না, অন্যজন ভালো হবে, নতুন করে শুরু করলে ভালো হবে। কিন্তু নতুন করে শুরু করে দেখলেন হয়তো আরও খারাপ। তখন কী করবেন? তখন কি মনে হবে না যে, আগেরজনই ভালো ছিল? আসলে ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। আপনার দুর্বল দিকগুলো আপনি ভালো জানেন, সেগুলো শুধরে নিলে হয়। কি পেয়েছেন তা হিসাব না করে একজন বাবা হিসেবে, মা হিসেবে সন্তানকে কতটুকু দিতে পারছেন তা ভাবুন। সন্তানকেই সবচেয়ে বেশি সময় দিন, তার সঙ্গে থাকুন, কী বলতে চায় শুনুন। এটাই সবচেয়ে ভালো উপহার সন্তানের জন্য। আজ যদি আপনি তাদের অবহেলা করেন, দূরে সরে যান, একদিন দেখবেন তারাও আর আপনার পাশে নেই। আপনার শান্তির জন্য, সুখের জন্য ডিভোর্স দিলেন, একসময় দেখলেন যেটুকু শান্তি ছিল ডিভোর্সের পর সেটাও আর নেই। তখন তো আপনার সবকিছুই গেল। শুধু নিজের কথা না ভেবে পরিবারের মানুষগুলোর কথা ভাবুন। আর সন্তান থাকলে, ডিভোর্সের ক্ষেত্রে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। প্রয়োজনে সময় নিন। কারণ আপনার এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়বে সন্তানের ওপর। আলাদা না হয়ে একত্রে ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে থাকুন; দেখবেন এর চেয়ে সুখ আর কিছুতেই নেই।