সর্বনাশের চোরাবালি ক্রেডিট কার্ড

জ্যাকসন হাইটসে ২২ ফেব্রুয়ারি আয়োজন করা হয় কোয়ান্টাম মেডিটেশন ও সেমিনারের
জ্যাকসন হাইটসে ২২ ফেব্রুয়ারি আয়োজন করা হয় কোয়ান্টাম মেডিটেশন ও সেমিনারের

জ্যাকসন হাইটসে ২২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সাপ্তাহিক কোয়ান্টাম মেডিটেশন ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সপ্তাহের সেমিনারের বিষয় ছিল, ক্রেডিট কার্ড: সর্বনাশের চোরাবালি।
৭২ স্ট্রিটের মামুন’স টিউটোরিয়ালে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে আলোচনা করেন কোয়ান্টাম মেডিটেশন সোসাইটি জ্যাকসন হাইটসের দায়িত্বশীল শাহনাজ আলম।
আলোচক বলেন, ক্রেডিট কার্ড আসলে একটি মারাত্মক দুষ্টচক্র। ক্রেডিট কার্ড অপচয়ের প্রবণতা বাড়ায়। আবার অপচয়ের মানসিকতাই সৃষ্টি করেছে ক্রেডিট কার্ডের ধারণা। গবেষকেরা বলছেন, আমরা যে কেনাকাটা করি তার ২০শতাংশ মাত্র প্রয়োজনে, বাকি ৮০ শতাংশই আবেগের বশে অথবা চোখের খিদের কারণে। আসলে সব কালেই চোখের খিদের কারণে কেনাকাটা পাগল মানুষজন ছিলেন।
কথা হচ্ছে এই যে মরণ ফাঁদ, এখানে তো কেউ জোর করে ঠেলে দিচ্ছে না, গ্রাহক নিজেই এগিয়ে যাচ্ছেন। কেন যাচ্ছেন? এর পেছনে যে মনস্তাত্ত্বিক কারণ তা হচ্ছে-অপ্রয়োজনে কেনাকাটা করার প্রবণতা। চোখের খিদে বলে যেমন একটি খিদে আছে, যেখানে পেট খালি না থাকলেও খেতে ইচ্ছে করে খাবারের দিকে চোখ পড়লে। তেমনি কোনো পণ্য চোখে পড়লেই কিনতে ইচ্ছে করে। এই কেনাকাটায় প্রধান বাধা সীমিত নগদ টাকা বা অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স। কারণ নিজের অ্যাকাউন্টের এই টাকা কষ্টে উপার্জনের টাকা। এটার পরিমাণ জানা থাকায় অতিরিক্ত ব্যয় করার ব্যাপারে সব সময়ই ক্রেতা সতর্ক থাকেন। কারণ নিজের টাকা কেউ বেহিসেবি ব্যয় করতে চায় না। কিন্তু ঋণের টাকার প্রতি ওই মায়া থাকে না। ওটা দিয়ে অপচয়ও তাই বেশি হয়।
একটা সময় দোকানে বড় করে লেখা থাকত—বাকি চাহিয়া লজ্জা দেবেন না। কিন্তু এখনকার ব্যবসায়ীরা বাকি দিতে মুখিয়ে থাকে। ক্রেতারাও তাই শুরু করেন লাগামহীনভাবে কেনাকাটা। একের পর এক জিনিস কেনা, তা-ও ব্র্যান্ড দোকান থেকে। এবং তার পরিণতি হলো পণ্য দাসত্ব। ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝাকে অগ্রাহ্য করে আরও আরও কেনা। একটি ক্রেডিট কার্ডের লিমিট পূর্ণ হয়ে গেলে আরেকটি, তারপর আরেকটি-এভাবে চালিয়ে যেতে থাকেন ঋণের পাহাড় মাথায় ভেঙে না পড়া পর্যন্ত।
অথচ ঋণ করে ঘি খাওয়া বা ফুটানি করা হচ্ছে ধর্মের শিক্ষার বিরোধী। ঋণ যে মৃত্যুর পরও কত বড় অভিশাপ তা বোঝা যায় একটি হাদিস থেকে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘মৃত্যুর পর বিশ্বাসীর আত্মা ঋণের কারণে ঝুলে থাকে। ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না।’ (বায়হাকি)। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) হতে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‌‘ঋণ ছাড়া শহীদের সকল গুনাহই মাফ হয়ে যায়’ (মুসলিম)। শুধু ইসলাম ধর্মে নয়, সনাতন ধর্মসহ সব ধর্মেই ঋণমুক্ত জীবন যাপনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যজুর্বেদে বলা হয়েছে, ‘হে মানুষ! স্বনির্ভর হও। বাইরের সাহায্যের দাসে পরিণত হয়ো না।’ অথর্ববেদে বলা হয়েছে, ‘জীবনের প্রতিটি স্তরে সব ধরনের ঋণ থেকে মুক্ত থাক।’
অর্থাৎ যে পণ্য, যে দ্রব্য, যে বস্তু আমার অশান্তি, আতঙ্ক, ত্রস্ততা, পরশ্রীকাতরতা বাড়ায়; তা থেকে মুক্ত থাকার জন্যই আসলে প্রতিটি ধর্মে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সতর্ক করা হয়েছে-দূরে থাকার জন্য।
২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের রয়েল সোসাইটি অব পাবলিক হেলথ এক গবেষণা করে ঋণ-গ্রহীতাদের ওপরে। এই জরিপে বলা হয়েছে, ৬৫ শতাংশ মানুষ বলেছেন যে, ঋণ তাদেরকে এত চিন্তিত ও মানসিক ভোগান্তিতে রেখেছে যে, চারপাশের সবার সঙ্গে তারা যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন এবং আরও একা হয়ে গেছেন। ৬৫ শতাংশ মানুষ বলছেন, এই মানসিক চাপ তাদের পারিবারিক সুখকে প্রভাবিত করেছে। ৭৫ শতাংশ বলছেন, ঋণের ফলে তাদের ঘুম খারাপ হচ্ছে। সিগারেটের প্যাকেটে যেমন লেখা থাকে-ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তেমনই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ঋণের অ্যাগ্রিমেন্ট কাগজে লিখতে পরামর্শ দিচ্ছেন যে, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করতে ঋণ বর্জন কর।
তাই প্রথম কথা হলো-ভোগ্যপণ্য কেনার ক্ষেত্রে কখনোই ঋণ যেন না করি। সব সময় নগদে কেনার চেষ্টা করব। কেনাকাটার ক্ষেত্রে কোথায় আমাকে থামতে হবে তা বুঝতে হবে। যা দেখব তা কিনতে মন চাইলেই যে কিনব তা যেন না হয়। সে জন্য চাওয়াটাকে তিনটি প্রশ্নের মধ্য দিয়ে যুক্তিসংগত করে তুলতে হবে। শ্রদ্ধেয় আল্লামা ড. এম শমশের আলী স্যারের কাছ থেকে আমরা জেনেছি এই তিনটি প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন: যে পণ্যটি আমি কিনতে চাই, এটা কি আমার প্রয়োজন? উত্তর যদি আসে ‘হ্যাঁ, প্রয়োজন, তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন: এটি কি সত্যিই খুব প্রয়োজন? এর উত্তরও ‘হ্যাঁ’ হলে তৃতীয় প্রশ্ন: এটা ছাড়া কি আমার চলবেই না? এর উত্তরও যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে বুঝতে হবে, ওটা আসলেই প্রয়োজন। তখন কেনার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তবে শর্ত আগের মতোই। হয় নগদে বা ডেবিট কার্ডে।
এ অনুষ্ঠানে সেমিনারে আলোচনা ছাড়াও মেডিটেশন, রোগগ্রস্ত, সমস্যা-পীড়িতদের জন্য হিলিং, সচেতনতামূলক তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। পরে শারীরিক, মানসিক, পেশাগত, আর্থিক ও আত্মিকসহ সব ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আয়োজন করা হয় ফ্রি কাউন্সেলিংয়ের।
উল্লেখ্য, প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় জ্যাকসন হাইটসের মামুন’স টিউটোরিয়ালে জীবনের বিভিন্ন সমস্যা, সাফল্য ও সম্ভাবনা নিয়ে সেমিনার ও মেডিটেশনের আয়োজন করে কোয়ান্টাম। টেনশন মুক্ত জীবন গড়তে, বিশেষ করে রোগকে সুস্থতায়, অশান্তিকে প্রশান্তিতে, অভাবকে প্রাচুর্যে ও ব্যর্থতাকে কীভাবে সাফল্যে রূপান্তর করা যায় এ অনুষ্ঠানে পাওয়া যায় তার সঠিক ধারণা। সুখী পরিবার গড়তে সবাই কোয়ান্টাম মেডিটেশন চর্চায় এগিয়ে আসলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডল আলোকিত হবে বলে মনে করেন আয়োজকেরা।