দু চোখ ভরা জল

নন্দিতা মফস্বল শহর দাপিয়ে বেড়ায়। চঞ্চল প্রজাপতি যেন। বড় বড় ভাসা ভাসা চোখ। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। দীর্ঘ কালো চুল। আওয়ার লেডি ফাতেমা স্কুলে এইটে পড়ে। ধর্মসাগরের কাছেই ওদের বাসা। বাবার অতি আদরের মেয়ে। বাবা ব্যবসায়ী। বাবা ঢাকা থেকে নীল ডায়ালের চমৎকার সিকো ঘড়ি এনে দিয়েছেন। এবার বায়না সাইকেলের। পরদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বাবা সাইকেল নিয়ে ফিরলেন। সাইকেল নিয়ে ও চলে যায় ঘুরতে। কৌশিক ভাইয়ার বন্ধু। ওকে সাইকেল চালাতে সাহায্য করে প্রথম দিন। তারপর ছেলে মেয়ে মিলে সাইকেলে প্রতিযোগিতা চলে। এভাবেই একবার সাইক্লিংয়ে প্রথম হয় নন্দিতা। বিভাগীয় পর্যায়ে ও চট্টগ্রাম গিয়ে প্রথম হয়। তার কিছুদিন পর ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা। ঢাকায় গিয়েও প্রথম হয়ে স্বর্ণ পদক জিতে নিল।
কৌশিক ওদের পাশের বাসায় থাকে। ওর বাবা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রফেসর। ওরা দুই ভাইবোন। কৌশিক নন্দিতার ভাই সুমিতের সাথে কলেজে ইলেভেনে পড়ে। আর ওর ছোট বোন তিয়াশা নন্দিতার সাথে এইটে পড়ে। তাই বন্ধু ওরা। সাইকেলে দল বেঁধে বের হয় ওরা। শহর ছেড়ে কোটবাড়ী এলাকায় ঘুরতে চলে যায়। একবার দলছুট হয়ে পড়ল কৌশিক ও নন্দিতা। ময়নামতির পর্যটন এলাকায় ঘুরে নিচে এসে বাড়ির পথ ধরতেই দেখে আকাশ কালো হয়ে আছে। কিছু দূর আসতেই ঝুম বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির ভেতরই সাইকেলে ওরা যাচ্ছিল। বৃষ্টির তোড়ে কিছুই দেখা যায় না।
- কৌশিক চল কোথাও থামি। কোনো কিছুই তো দেখি না।
তখনই একটা ছোট চালা মতো দেখল।
-চলো এখানে থামি।
ওরা সাইকেল রেখে বাঁশের বেঞ্চে বসল। হি হি করে কাঁপছিল নন্দিতা।
- তোমার মুখ নীলচে হয়ে গেছে নন্দিতা।
-শীত লাগছে।
-আমার ও ...।
সহসাই নন্দিতার খুব কাছে ঝুঁকে ঠোঁটে দখল নিয়ে নেয় কৌশিক। এতটাই আচমকা যে নন্দিতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটে যায় ঘটনাটা। নন্দিতা এবার মারমুখী হয়ে কিলঘুষি মারতে থাকে।
-তুমি এত খারাপ! দাঁড়াও আমি ভাইয়াকে সব বলে দেব।
- ঠিক আছে বলে দিও। তখনই জোরে কড়কড় করাত শব্দে বাজ পড়ল। ভয়ে কৌশিককে জড়িয়ে ধরল নন্দিতা। কৌশিক ওকে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে
-তোমার আম্মাকে বলে দেব তুমি কী করলে।
-হুম বলে দিয়ো।
-এভাবেই আগলে রাখব সারা জীবন; কথা দিচ্ছি।
- সত্যি?
- সত্যি, সত্যি; তিন সত্যি।
গভীর ভালোবাসায় যখন নিমজ্জিত দুজন তখনই বদলির অর্ডার এল কৌশিকের বাবার। হাফিজউদ্দিন সাহেব চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে প্রিন্সিপাল হয়ে প্রমোশন পেয়েছেন। সামনে কৌশিকের ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষা। কৌশিকের আব্বা চলে গেলেন আগেই। আর কৌশিকের পরীক্ষার পর ওরা সবাই চলে যাবে। নন্দিতার মন অনেক খারাপ। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার প্র্যাকটিক্যালও শেষ। সেদিন ওরা বার্ড-এ গেল। এত বিষণ্ন নন্দিতাকে কখনো দেখেনি কেউ।
- নিনি মন খারাপ করো না। যত দূরেই যাই, আমি তোমারই।
-আমি জানি। তবুও আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন দুজনকে দেখতে পাব না। তোমাকে ছুঁতে পারব না।
- আমরা কাল চলে যাব চিটাগাং। তুমি আজ সন্ধ্যায় এস একবার।
-না আমি তিয়াশার দিকে তাকাতে পারি না। কেঁদে ফেলব।
সেদিন সন্ধ্যার দিকে মায়ের সাথে কৌশিকদের বাসায় দেখা করতে গেল নন্দিতা। এ বাড়ির সবাই কিছুটা বুঝতে পারে তাদের সম্পর্ক।
কৌশিকের আব্বা বলেন, আমরা যাচ্ছি। বন্ধন আমাদের থাকবে। আপনারা চিটাগাং গেলে আসতে ভুলবেন না।
‘কাল আমাদের বাসায় খেয়ে রওনা দেন ভাই’, বলেন নন্দিতার মা।
- আচ্ছা। শেষ একটা কষ্ট দিয়ে যাই।
তারপর চা পান ও গল্প চলে। নন্দিতা তিয়াশার রুমে যায়। তিয়াশা হাপুস নয়নে কাঁদছে। গলা জড়িয়ে ধরে নন্দিতাও কাঁদতে থাকে। কৌশিক এসে ওদের কান্না থামিয়ে হাসানোর চেষ্টা করে।
-তিয়ামনি যা একটু চা করে চাচিদের দিয়ে আয়। নিনি মুখটা এদিকে ফেরাও। নন্দিতার চোখ ভর্তি জল। কাঁদবে না প্লিজ। আমার কী যে ভালো লাগে তোমার হাসিখুশি মুখখানা।

কৌশিকেরও খুব মন খারাপ। নন্দিতাকে চিঠি লিখল—

নিনি আমার,
দেখ এমনটা আমি ভাবিনি। তবে এও ঠিক, আজ বা কাল না হলেও আগামীতে আমরা বিচ্ছিন্ন হতামই। তবে এই বিচ্ছিন্নতা শুধুই বাহ্যিক দূরত্বের। মনের দূরত্ব বাড়ায় এমন সাধ্যি কার? তুমি আমাকে যতটুকু বুঝতে পারো এমন করে আর কখনো কেউ পারবে না। তাই তোমার মাঝেই আমার ঠিকানা। তুমি আমার ধ্রুবতারা।
তুমি যে সুন্দর সেটা তো শহরজুড়ে সবাই জানে। কিন্তু তোমার যে সৌন্দর্যের গভীরতা, তা শুধু আমি জানি। তোমার অন্তরের আলোকিত জগৎ শুধুই আমার। আমার পৃথিবী তোমাকে নিয়ে। আমি খুব দ্রুত নিজেকে যোগ্য আর প্রতিষ্ঠিত করে তোমার পরিবারের সামনে এসে তোমাকে প্রার্থনা করব। চাচা-চাচি আমাকে ফেরাতে পারবেন না। তুমি পড়ালেখা কর। আমি যত দূরে, যেখানেই থাকি মনে রেখ আমি তোমারই।
কৌশিক।

চিঠিটা পেয়ে নন্দিতা উত্তর লিখতে বসে।
চট্টগ্রাম যাওয়ার পরপরই কৌশিক সিদ্ধান্ত নিল সে খুব কম সময়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। সে আর্মির লং কোর্সে যোগ দিল। আর সুন্দরভাবে স্বল্প সময়ে কোর্স শেষ করে প্রথম পোস্টিং হলো রংপুর ক্যান্টনমেন্টে। এদিকেই নন্দিতা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনার্স নিয়ে ক্লাস শুরু করেছে। রোকেয়া হলে থাকে। কৌশিক এসে লাজুক ভঙ্গিতে কোনো মেয়েকে রিকোয়েস্ট করে হাতে চিরকুট দিয়ে।
-আপু রুম নাম্বার ১৭ অনার্স বিল্ডিং, নন্দিতা। প্লিজ।
হলের ভেতরে যেতে যেতে মেয়েরা ডেকে দিয়ে যায়। আর তাই ‘রুম নাম্বার -১৭ নন্দিতা ভিজিটর’ চিৎকার শুনলেই ছুটতে ছুটতে নন্দিতা আসে। তারপর রিকশায় করে ঘুরে বেড়ায়। ফুচকা খায়, শপিং করে। মঞ্চ নাটক দেখে। সিনেমা দেখে।
বছর দুই পর মাকে নিয়ে কুমিল্লা গেল কৌশিক। এক জমজমাট বিকেলে জাঁকজমকপূর্ণভাবে এনগেজমেন্ট হলো। এক মাস পর কুমিল্লায় বিয়ে, আর চট্টগ্রামে বউভাত হলো। রংপুর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে গিয়ে কৌশিক ব্যাচেলর জীবনযাপন করে। আর ছুটি পেলে দৌড়ায় ঢাকা। ‘অনার্স বিল্ডিং, রুম ১৭, নন্দিতা প্লিজ।’ আর না হলে চিঠিই শেষ ভরসা।
এক বছরের মাথায় কৌশিক বদলি হলো সাভার ক্যান্টনমেন্টে। এখানে নন্দিতাও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চলে আসে কখনো কখনো। ইংরেজি সাহিত্য অনেক কঠিন। ফাঁকি দিলে কষ্ট হয় কভার করতে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ফলাফল যা হলো, তাতে নন্দিতার আক্কেল গুড়ুম। অনার্সের আগেই প্রেগনেন্সি ধরা পড়ল। বহু কষ্টে অনার্স শেষ করে মার কাছে কুমিল্লার বাড়িতে যায় নন্দিতা। কিছুদিন থেকে সাভার ক্যান্টনমেন্টে নিজ বাড়িতে যায়। কৌশিক তখন আবার বদলি হয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে। যশোর সিএমএইচে জন্ম হয় অভ্রর।
অভ্র স্কুলে যাওয়ার আগে আগে কৌশিকের পোস্টিং হলো কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। এখানে তিন বছর ছিল। মায়ের বাসায় অভ্রকে রেখে ওরা আবার সেই বৃষ্টি আর পুরোনো দিন খুঁজে বেড়াত। মন ছুটে যায় ময়নামতি কোটবাড়ী। অভ্র থ্রিতে ভর্তি হলো চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। তখনই শুভ্রর জন্ম হলো। কৌশিকের বাবা চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের প্রিন্সিপাল তখন। ক্যান্টনমেন্টের বাসা আর কলেজের কোয়ার্টারে খুব আনন্দে দিন কাটছিল। ওই বছর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের নেতৃত্ব নিয়ে কৌশিক চলে গেল আইভরি কোস্ট। ষোলো মাসের মধ্যে একবার ছুটিতে দেশে এসেছিল। দুই ছেলের জন্য তার অনেক মায়া। নন্দিতাকে এক মুহূর্ত চোখের আড়ালে যেতে দেয়নি।
ফিরে এল যখন, তখন প্রমোশন পেয়ে ব্রিগেডিয়ার হয়ে গেল। এবার পোস্টিং ঢাকায়। খুব সুন্দর কোয়ার্টার পেল; মল্লিকা, এয়ারপোর্ট রোডে। এগারো তলায়। ছোট ছেলে স্কুলে যায়। নন্দিতা আগা খান স্কুলে চাকরি নিল। বড় ছেলে ভালো জিপিএ পেয়ে এসএসসি, এইচএসসি পাস করল। সে মালয়েশিয়াতে পড়তে গেল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। জীবন পরিপূর্ণ।
কৌশিক তবু দুষ্টুমি করে, নিনি তোমাকে আবার বিয়ে দেওয়া যাবে।
-যাও তো। তোমার খালি দুষ্টামি।
ঢাকায় র‍্যাবের সদর দপ্তরে কাটল আরও কিছুদিন। এরপর বিডিআর সদর দপ্তরে চলে এল ২০০৭ সালে। বিডিআরে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দরবার হলে বৈঠক চলছিল। এমন সময় কী হলো কেউ কিছু বুঝতেই পারল না। হঠাৎই প্রচণ্ড গোলাগুলি। কৌশিক নন্দিতাকে ফোন করে বলল।
-তুমি কী স্কুলে চলে গেছ? কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। তোমরা সাবধানে থেকো।
-কৌশিক তোমার ছেলে আছে। ছেলের দোহাই তোমরা পালিয়ে যাও।
-না, না, আমি একজন সৈনিক। আমার কাজ আমাকে করতে দাও। যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে। নিনি বি সেফ। বি ব্রেইভ।
অভ্র ওর মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। বিডিআর বিদ্রোহের খবর জেনে আজ সকালে মালয়েশিয়া থেকে এসে এয়ারপোর্টে নেমেই শুনল কালভার্টের মুখে একটা লাশ পাওয়া গেছে। ছোট মামা, মামি, মিতু খালাসহ মা ও ছোট ভাই শুভ্রকে নিয়ে পিলখানায় বিডিআরে পৌঁছালে। লাশটা উপুড় অবস্থায় আছে। ওরা অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মাছি ভনভন করছে। মুখটা সোজা করতেই দেখল বাবা। মার চোখ ঢেকে মাকে বুকে জড়িয়ে ধরল অভ্র।
-না, না, এ হতে পারে না। বাবা আমার কাছে বিদায় নিয়ে দরবার হলে গিয়েছিল কাল সকালে। ও মা গো। আমার বাবা কেন ওখানে পড়ে আছে? ওখানে অত নোংরার মধ্যে! বাবা তো খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ও ভাইয়া বাবা কেন ওখানে? কাঁদছে শুভ্র।
-বাবা যাবার আগে আমার কাপড় রেডি করে দিয়ে গেল। আমাকে বলে গেল ‘আব্বু স্কুল থেকে এসে এই কাপড় পরে রেডি হয়ে থেকো। আমি ব্রেকে আসব। এসে আম্মু আর তোমাকে নিয়ে যাব।’ শুভ্রকে থামানো যাচ্ছে না।
বিডিআর দরবার হলে গতকালের গোলাগুলির পর ডিজি শাকিলের লাশ পাওয়া গেছে। একে একে পাওয়া যাচ্ছে আরও অফিসারদের লাশ। হ্যাঁ, লাশ। তরতাজা অফিসাররা অনেকেই লাশ হয়ে গেছে। নন্দিতা বড় বড় চোখে স্থির তাকিয়ে আছে। কী ঘটছে, বিশ্বাস করতে পারছে না। হু হু করে উঠছে বুক। ওর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে, ‘নিনি চোখ মুছে ফেল। কাঁদবে না।’