স্বপ্নভঙ্গ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

অদিতি ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠল। এই শীতের রাতেও ঘামে ভিজে গেছে তার শরীর, ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। উঠে টেবিল থেকে গ্লাসে নিয়ে পানি খেল। এখন একটু শান্তি লাগছে তার। সেই স্বপ্নটা অদিতি আবার দেখেছে। সে দৌড়াচ্ছে দৌড়াচ্ছে দৌড়াচ্ছে। পেছনে কতগুলো শেয়াল আসছে। কোনো কোনো সময় দেখে পাহাড়ের ওপর দৌড়াচ্ছে। শেয়ালগুলো পেছন পেছন আসছে। তার যাওয়ার পথ নেই। না, আর সে ভাবতে পারছে না। কালই একবার ডাক্তার চাচার ওখানে যাওয়া দরকার। অদিতি এখন কেমন যেন নীরব হয়ে গেছে। ক্লাস থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, ক্লাস শেষে সোজা বাসায়। কোনো আড্ডায় যায় না। কারও সঙ্গে তেমন কোনো কথাও বলে না। বাসায়ও সে চুপচাপ। ভাইয়া, ভাবি, মা কারও সঙ্গে দরকারি কথা ছাড়া সে কথাও তেমন একটা বলে না।

আগে অদিতি এমন ছিল না। ছিল খুব চটপটে, উচ্ছ্বল আর প্রাণবন্ত। ননস্টপ কথা বলে যেত আর বন্ধুরা ডাকত রেডিও বলে। কিন্তু একটা দুর্ঘটনার পর থেকে সে এখন নীরব হয়ে গেছে। অদিতি নিজেকে নিয়ে আর ভাবতে পারে না। সে এখন অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী।
তিন বছর আগের কথা। সে যখন প্রথম বর্ষে পড়ে তখন আবেশের সঙ্গে তার প্রথম দেখা। সেদিন ছিল ১৮ আগস্ট, শরতের প্রথম দিন। অদিতিরা চার বান্ধবী মিলে সেদিন আকাশি রঙের শাড়ি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল। চারজনেই খুব মজা করল সারাটা দিন। বিকেলে ওরা যখন সবাই চলে গেল তখন সে একা বাসে করে আসছে। হঠাৎ বাসের জানালায় চোখ পড়ল। দেখল অপূর্ব সুন্দর একটি ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক পড়ছে না। অদিতিও গ্লাসের ভেতর দিয়ে ছেলেটিকে দেখতে লাগল। হঠাৎ ছেলেটির খেয়াল হলো, সে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিল। এটাই তাদের প্রথম দেখা। এভাবে প্রতিদিন বাসের ভেতর তাদের দেখা হতো। এই দেখা শুধু চোখে চোখে, সেখানে কোনো কথা হয়নি। অদিতি খেয়াল করল এই ছেলেটির প্রতি অদ্ভুত মায়ায় সে জড়িয়ে যাচ্ছে। একদিন তাকে না দেখলে মনে হয় যেন কত দিন তাদের দেখা হয়নি। সে ছেলেটি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করল তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে। ছেলেটির নাম আবেশ। পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
অদিতির ভালোবাসা ছিল একতরফা। বান্ধবীকে নিষেধ করে কিছু না জানাতে আবেশকে। সে দূর থেকে দেখতে চায় আবেশ তাকে ভালোবাসার কথা বলে কিনা। আবেশের জন্মদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি, ওই দিন ভালোবাসা দিবসও। সে জন্মদিনে আবেশকে ফুল ও কার্ড গিফট পাঠাল, তবে নিজের নাম গোপন করে। কিন্তু আবেশের কোনো সাড়া ছিল না। বান্ধবীরা তাকে ফেরানোর চেষ্টা করল, এতে অদিতির ভালোবাসা একটুকুও কমেনি বরং আরও বেড়েছে। সে আবেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগল। দুজন বেড়াচ্ছে, বাতাসে অদিতির চুল উড়ছে। আবেশ তাকে জীবনানন্দের কবিতা শোনাচ্ছে।
এভাবে দুটি বছর কেটে গেল। একদিন অদিতির জ্বর হলো। সে জন্য কয়েক দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল না। তারপর যেদিন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল তার পরের দিন ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি ও আবেশের জন্মদিন। সে তো খুব খুশি, কারণ ওই দিন সে আবেশকে জানাবে তার ভালোবাসা ও রাগের কথা। কেন আবেশ তাকে আগে বলেনি ভালোবাসার কথা। কোন্‌ কথার পর কোন কথা বলবে সে মনে মনে সাজাতে লাগল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শুনল একটি নতুন খবর—পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে একটি ছেলে স্কলারশিপ পেয়েছে আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর সেই ছেলেটি হলো আবেশ, তখন অদিতির আনন্দ দেখে কে। অদিতি যখন খুশির চরম পর্যায়ে তখন আবেশের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখল—ওরা হেঁটে যাচ্ছে ডিপার্টমেন্টের দিকে। সে তার এক ক্লাসমেটের কাছে জানল ওই মেয়েটি হচ্ছে আবেশের স্ত্রী, দুই মাস আগে ওদের বিয়ে হয়েছে। অদিতি সেই যে নীরব হলো, আর তাকে আগের রেডিও অদিতি করা গেল না।
এখন প্রতি রাতেই সে স্বপ্ন দেখে সে দৌড়াচ্ছে। পেছনে শেয়াল আসছে। অদিতি পাহাড় থেকে পড়ে যাচ্ছে। পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার মতো তার ভালোবাসার স্বপ্নটাও ভেঙে গেছে। এখন প্রতি রাতের দুঃস্বপ্ন তার সঙ্গী।

(লেখিকা অস্ট্রেলিয়ার সিডনিপ্রবাসী)