চন্দ্রাহতের সাতকাহন

সাহিত্যিক কবি ফেরদৌস জেসমিনের জন্ম ষাটের দশক। বিক্রমপুরে মায়ের বাড়িতে ২ আগস্ট জন্ম নেন তিনি। তাঁর বাবার বাড়ি মানিকগঞ্জ হলেও শৈশবের বেশ কিছু সময় কেটেছে বিক্রমপুরে। বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলা থেকেই বাংলাদেশের অনেক জেলায় তাঁকে যেতে হয়েছে। প্রতিটি ভ্রমণে তিনি গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন দেশের সবুজ প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানুষ। চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা তিনি উপলব্ধি করেছেন হৃদয় দিয়ে। তাই তো তাঁর ভিতর জন্ম নিয়েছে অপূর্ব সৃজনশীলতা ও নান্দনিকতা, যা পরে তাঁর লেখার জগৎকে করেছে সমৃদ্ধ।
ফেরদৌস জেসমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করেছেন। বর্তমানে বাস করছেন আমেরিকার বোস্টনে। জীবিকার প্রয়োজনে দীর্ঘ সময় আমেরিকায় কাটালেও একের পর এক রচনা করেছেন কবিতা, প্রবন্ধ ও উপন্যাস। কোনো প্রতিকূলতাকেই লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে দেননি। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখে গেছেন। সম্পাদনা করেছেন ‘বাংলাঘর’, ‘কুড়াই নুড়ি’ ও ‘প্রত্যাশা’ পত্রিকা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউ ইংল্যান্ডের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং নিউ ইংল্যান্ড বাংলাদেশি আমেরিকান ফাউন্ডেশনের (নিবাফ) পরিচালক ও আজীবন সদস্য।
ফেরদৌস জেসমিনের বইয়ের সংখ্যা মোট ১৯টি। ‘চন্দ্রাহত’ কবিতার বইটি তাঁর বিশতম গ্রন্থ। বইটি যখন আমার হাতে আসে, চারু পিন্টুর করা চমৎকার প্রচ্ছদটি প্রথমে আমাকে মুগ্ধ করে। তারপর অভিভূত হই উৎসর্গের পাতাটি দেখে। কবি বইটি উৎসর্গ করেছেন মা আছিয়া রহমানকে। নামের নিচে লেখা রয়েছে আছিয়া রহমানের জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ ও সাল। আর তারপরেই কবি আছিয়া বেগমকে নিয়ে লিখেছেন ছয় লাইনের একটি লেখা-
‘দূর প্রবাসে মায়ের মতোই
পাশে ছিলেন যিনি,
আম্মা হয়ে সারা জীবন
আদর দিলেন তিনি,
ভালোবাসার মায়ায় আমি
তার কাছে যে ঋণী।’
উৎসর্গ করা বই আর তাঁর লেখনী বলে দেয় আছিয়া রহমান লেখকের জীবন ও মনের অনেকটা জুড়ে রয়েছেন। পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁকে তিনি গেঁথে রেখেছেন মনোভূমিতে। উত্তর আমেরিকার স্বনামধন্য সাংবাদিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিকর্মী, সৃজনশীল, উদারমনা ও বন্ধুবৎসল এবং নিবাফের প্রতিষ্ঠাতা বোস্টনের প্রিয়মুখ নাহিদ নজরুল সেতারা রঙে মা হলেন এই আছিয়া রহমান। চন্দ্রাহত কবিতার বইয়ের ৫৫টি কবিতার মধ্যে একটি কবিতার শিরোনাম আছিয়া রহমান। কবিতাটি পাঠক পড়ামাত্র আছিয়া রহমানের জীবনকে সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। তিনি ১৯৩৩ সালে মিয়ানমারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তাঁর স্বামী হাবিবুর রহমান আসছি বলে সেই যে ঘর থেকে বের হলেন, আর ফিরে আসেননি। যুদ্ধ শেষে ৪৭ বছর তিনি স্বামীর অপেক্ষাতে প্রতিটা প্রহর কাটিয়েছেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল একদিন হাবিবুর রহমান ফিরে আসবেনই। ২০১৮ সালে সমস্ত অপেক্ষা ও অভিমানের অবসান ঘটিয়ে তিনি আমেরিকার বোস্টনে মৃত্যুবরণ করেন। পৃথিবীর বুকে রেখে যান তাঁর অমূল্য ছয়টি রত্ন- নাহিদ সেতারা, হাসিনা চৌধুরী, সাহানা হাসান, তাহেরা মিতু, মাহাবুব ও মনসুর রহমানকে। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি সরাসরি যুদ্ধ না করলেও যুদ্ধ চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে স্বামীর জন্য তাঁর ত্যাগ, হাহাকার ও অপেক্ষাও ছিল এক বড় যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের সফল যোদ্ধা হিসেবে তাঁকেও আমরা মুক্তিযোদ্ধার সমান আসন দিতে পারি। কবি ফেরদৌস জেসমিন ও আছিয়া রহমানের প্রতি আমার অশেষ শ্রদ্ধা।
আছিয়া রহমানের জীবদ্দশায় তিনি ফেরদৌস জেসমিনকে বড় বেশি ভালোবাসতেন। তাঁর কাছ তিনি পেয়েছেন মায়ের স্নেহ। আছিয়া রহমানের ছেলে-মেয়ের মতোই তিনিও মেনে নিতে পারেননি না তাঁর মৃত্যুকে। তাই তো কবি প্রতি দিনের হাজারো কাজের মধ্যেও তাঁকে স্মরণ করেন, প্রার্থনা করেন তাঁর পারলৌকিক শান্তির জন্য।
এবার আসি কবির কবিতা প্রসঙ্গে। সুন্দর প্রচ্ছদ, বইয়ের শিরোনাম, প্রতিটা কবিতার শিরোনাম ও কবিতা পড়ে তা নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছাকে দমাতে পারলাম না। কবির কবিতাগুলো সহজ, সাবলীল । যেকোনো বয়সের পাঠকই তা সহজে বুঝতে ও পড়তে পারবেন। কবিতার নামকরণের ক্ষেত্রে কবি যথেষ্ট সচেতন ও সহজ। যথেষ্ট ভালো লাগার কারণে রচনা দীর্ঘ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও শিরোনামগুলো উল্লেখ না করে পারছি না।
জেসমিন ফুল, আছিয়া রহমান, নাজমা আপা, দেশ, তুমি, বদলে যাই, কথা রাখেনি, দেখা, প্রথম প্রেমপত্র, সকাল, দুপুর, রাত্রি, বিকেল, খেলা, কাজ, সে আসে, মা, মুঠোফোন, বাক, প্রিয় ভাই, নিরাপদ সড়ক চাই, তুই আমার, একুশের গান, আমার একটি নদী ছিল, আধিয়া-নাভিয়া, দিয়ামণি, সূর্যমুখী, নীল আকাশ, মীমের জন্য ভালোবাসা, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মনে রাখা, বৃষ্টি ভেজা মাটি, মেয়ে রুমকি, মনের ঘরে, আনন্দ আবদারে, ঈদ, বিজয় দিবস, চাঁদ অন্ধকারে কাঁদে, কদম ফুল, স্বাধীনতা, দুই ভাইবোন, জীবনটা রঙীন, শুভ নববর্ষ, স্মৃতিময় পদচিহ্ন, এমন বাসরবেলা, আমাদের বাড়ি, হিসাব মিলে না, ঘুড়ি হাতে, মহান প্রভু, বসন্ত বাতাস, পুরুষ সূর্যমুখী, পৃথিবী কবিতা চায়, বন্ধু, মঈদ ও চন্দ্রাহত।
একেকটি কবিতা যেন একেকটি জীবন্ত ছবি। যারাই পড়বে, তাদের বুকেই দাগ কেটে যাবে। প্রতিটি কবিতাই স্বতন্ত্র। নানাভাবে তিনি কবিতাকে সাজিয়েছেন। একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই। একেক কবিতায় একেক রকম সুর, একেক রকম ভাবনা। লাইনে লাইনে রয়েছে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার ছাপ। কবিতা পড়তে পড়তে যতই একজন পাঠক মগজ ও হৃদয়ে ধারণ করবে, ততই নিজেকে কবির লেখনীতে ফুটে উঠতে দেখবেন। আমি মনে করি এখানেই কবির সার্থকতা। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু কবিতার লাইন তুলে দিচ্ছি, যা বইটিকে অনন্য উচ্চতায় উঠিয়েছে।
স্বামী হাবিবুর রহমানকে নিয়ে আছিয়া রহমানের অপেক্ষার জাল বুনেছেন কবি কবিতাটির লাইনের প্রতি পরতে পরতে। এ যেন এক অপার্থিব সৃষ্টি। কবিতার প্রতিটি শব্দচয়ন হৃদয়কে নাড়া দেয়।
‘ভালোবাসা দিয়ে ভাসালে তুমি
মায়ায় করলে ঋণী,
তোমার সে হাসি মুখ সত্যি আপা
ভুলব না কোনদিনই।’
একজন দক্ষ কবি কবিতার মাধ্যমেই সৌন্দর্যের চর্চা করেন এবং সে সৌন্দর্য কেমন করে পাঠক মনে প্রতিস্থাপন করা যায়, সে বিষয়ে সজাগ থাকেন। কবি ফেরদৌস জেসমিন একজন সার্থক কবি। কারণ কবিতাবিষয়ক প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সজাগ ও সচেতন।