রসিদা বুয়া

বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই আমাদের বাড়িতে রসিদা বুয়াকে দেখতাম। 

বাবার আদৌ কোনো বোন হতো কিনা জানিনা, তবে তাকে আমরা রসিদা ফুফু বলে ডাকতাম।
আজ অবধি আমার চোখে দেখা জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন রসিদা ফুফু।
দিনের আলো নেভার সাথে সাথেই রসিদা ফুফু ঘুমিয়ে পড়তো।
কাক ডাকা ভোরে মুয়াজ্জিনের ডাকে ঘুম থেকে উঠতো।
রুটি, আলুভাজি, লাল চা সাথে চালভাজা, কনকনে শীতে খিচুড়ি
সূর্য ওঠার আগেই আমাদের সব নাশতা তৈরি করতো।

অক্ষরজ্ঞান শূন্য দেখতে কৃষ্ণ কালো রসিদা ফুফুর কোনো দিন বিয়ে হয়নি।
প্রকৃতির মতো সহজ সরল রসিদা ফুফুর মুখে রাতদিন খেলা করতো হাসি।
জাগতিক কোনো কুটিলতা সাদামাটা রসিদা ফুফুকে কোনো দিন স্পর্শ করেনি।
মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতে আমি রসিদা ফুফুর কাছেই শিখেছি।

কুপির আলোয় বসে রসিদা ফুফু চোখে কাজল লাগাত।
হয়তো মনে মনে স্বামী, সংসার, সন্তানের স্বপ্নে বিভোর হতো।
হাতে-মুখে স্নো, পাউডার মাখতো। কত রকমের যে রূপ চর্চা করতো।
পূর্ব-পশ্চিম চেনে না। গুছিয়ে কথা বলতে পারতো না বলে সাদাসিধা রসিদা ফুফুকে নিয়ে আম্মার খুব চিন্তা হতো।
তার ভবিষ্যতের ভাবনায় প্রায়শই আম্মাকে চিন্তিত দেখাতো।

অতঃপর, পড়াশোনার জন্য আমি চলে যাই বাড়ির বাইরে, তারপর বিদেশে।
অনেক বছর বাদে খবর পাই রসিদা ফুফু ঘুমের মধ্যে মারা গেছে।
পৃথিবী থেকে হিরের চেয়েও দামি একটি নক্ষত্র খসে পড়েছে।

সুটেড-বুটেড মানুষদের ভিড়ে ইদানীং আমার খুব রসিদা ফুফুর কথা মনে পড়ে।
ইচ্ছে করে তাকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি,
নির্মমতা, রঙিন সভ্যতা আপনাকে ঘর বাঁধবার কিংবা মা হওয়ার স্বীকৃতি দেয়নি ঠিকই ; কিন্তু আপনি বেঁচে আছেন আমার বুকের গহিনে একজন মানবিক মানুষ হয়ে।
জীবনে মানুষ হওয়ার যোগ্যতার চেয়ে বড় আর কোনো কৃতিত্ব নেই জগতে।