অপারেশন কলাটিয়া বাজার

[মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের প্রতিটা দিনই ছিল ঐতিহাসিক মুহূর্ত। যুদ্ধে বিধ্বস্ত তখন বাংলার গ্রাম, জনপদ, শহর আর শহরতলি। ভয়ে আর শঙ্কায় মানুষ তখন দিগ্‌বিদিক যে যার মতো ছুটছে। এদিকে রাস্তায়, ডোবায়, পুকুরে, নদীতে বেওয়ারিশ লাশ। সেই লাশ ছিঁড়ে খাচ্ছে কাক, শেয়াল, শকুন। পাশাপাশি চলছে মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলশামস বাহিনীর সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ করছে আমাদের লড়াকু মুক্তিযোদ্ধারা। সেই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে গলির মোড়ের পানের দোকানদার, যিনি অস্ত্র কীভাবে চালাতে হয় সে বিদ্যাটাও জানেন না। এভাবেই দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের ফসল আজকের আমাদের বাংলাদেশ। ‘মুক্তিযুদ্ধের না বলা গল্প’—এই সংখ্যায় রয়েছে এমনি এক ভয়াবহ রক্ত হিম করা যুদ্ধের গল্প। এটি হয়েছিল পাকুন্দিয়ার কলাকাটিয়া বাজারে ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে। এই যুদ্ধের গল্প এখনো পাকুন্দিয়া এলাকায় মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। গল্পে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন মোক্তার আহমেদ। তিনি বর্তমানে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন।]

গল্প-১৫
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের কোন একদিন। গোপন সোর্সের মাধ্যমে খবর পাওয়া গেল রাত দুটার দিকে পাকুন্দিয়া থেকে একটি ট্রাকবোঝাই পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনী অপারেশন শেষ করে কিশোরগঞ্জের দিকে আসবে। সেই ট্রাকে থাকবে ভারী অস্ত্র আর গোলা বারুদ। এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না পাকুন্দিয়ার মুক্তিযোদ্ধা হান্নান মোল্লার বাহিনী। অথবা বলা যায়, হান্নান মোল্লা বাহিনী ঠিক এমন একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। হান্নান মোল্লা তাঁর বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে জরুরি সভা ডাকলেন। পাকুন্দিয়ার কলাটিয়া বাজারে মরিচের আড়তদার দোকানে এক গোপন বৈঠক শুরু হল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সেখানে একে একে জড়ো হতে লাগলেন হান্নানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর লোকজন। রাত তখন দ্বিপ্রহর। হাড় কাঁপানো শীতের রাতে একে একে সবাই উপস্থিত হলেন। উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের চোখের তাড়ায় তখন প্রতিশোধের আগুন। না, এ সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না।
তবে হান্নান বাহিনী গোপন সোর্স থেকে আরেকটি তথ্যও পেল। সেটিই হলো সমস্যা। ট্রাকের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যরা অনেক ভারী অস্ত্র বোঝাই করে রীতিমতো নিজেদের সুরক্ষা করে রেখেছে। তাদের সঙ্গে আছে স্থানীয় কিছু রাজাকার আর আলবদর বাহিনীর সদস্যও। এই রাজাকার সদস্যদের সবাই স্থানীয়। অতএব এলাকার রাস্তার খবরাখবর ও খুঁটিনাটি তারা সবকিছুই জানে। হান্নান বাহিনী হিসাব কষে দেখল, সামনাসামনি যুদ্ধে তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র সাজে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠবে না। আরেকটা সমস্যাও আছে। যদি কোনোভাবে হান্নান মোল্লার অ্যামবুশ বা অতর্কিত হামলা ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের গোটা বাহিনীর ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার জীবন বিপন্ন হতে বাধ্য। সব দিক খেয়াল রেখে খুব ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিলেন হান্নান মোল্লা। যুদ্ধের চিত্রটা তিনি উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে তুলে ধরলেন। সিদ্ধান্ত হল, পাকিস্তানিদের অস্ত্রবোঝাই ট্রাকের ওপর অ্যামবুশ হবে।
হিসাব কষে দেখা গেল, ঠিক রাত দুটোর দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্রবোঝাই ট্রাকটি পাকুন্দিয়ার কলাটিয়া বাজার থেকে একটু দূরে একটি ছোট সেতু পার হবে। সেতুটা বেশ মজবুত। তবে এর নিচ দিয়ে রয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীর একটি ছোট মোহনা। আর সেতুর দুপাশে রয়েছে ধান ‌ খেত। ধানখেতের দুপাশ থেকে একই সঙ্গে সাঁড়াশি হামলা করে কোনোভাবে যদি ট্রাকের চারটি চাকাই ফুটো করে দেওয়া যায় তাহলেই খেল খতম! কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্নাইপার। কে আছে ধানখেতে বসে এমন কাজটি করতে পারবে? সেতুর দুই পাশে অবস্থান নিয়ে ঠিক একই সময়ে ট্রাকের চারটি চাকা গোলায় উড়িয়ে দেওয়া এত সহজ কাজ নয়। যদি কোন কারণে অপারেশন ব্যর্থ হয়, তাহলে কপালে মৃত্যু ছাড়া আর কোন গতি নেই। কিন্তু অ্যামবুশ করতে হবেই। সবার চোখ পড়ল উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা মো. মাহতাবউদ্দীন ও শামসুল হুদা আঙুরের দিকে। এদের নিশানার কোনো তুলনা নাই। মাত্র তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে এই দুই মুক্তিযোদ্ধা হান্নান মোল্লা বাহিনীর অন্যতম সম্পদ। তাদের কাজের ওপর ভরসা করা যায়। দলের সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হলো। মাহতাবউদ্দীন রাস্তার দক্ষিণ পাশে অবস্থান নেবেন। তাঁকে ব্যাক আপ করবেন আলতাফ, টিপুসহ অন্যরা। আর শামসুল হুদা আঙুর অবস্থান নেবেন সেতুর উত্তর পাশে ধানখেতের ভেতর। তাঁকে ব্যাক আপ করবেন লুৎফর, তাপসসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। অপারেশনের সময় সবার কাজ ভাগ করে দেওয়া হল। কালটিয়া বাজারে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা সবাই শেষবারের মতো তাদের অস্ত্র ঠিক করে নিলেন। অপারেশন শুরু হবে পরদিন শুক্রবার।
শুক্রবার রাত ১০টা। কলাটিয়া বাজারের সবার মুখ কেমন যেন থমথমে। কপাল ভালো যে আকাশ পরিষ্কার। তারপরও একটু রাত নামলেই গ্রামের হাট বাজার একেবারেই জনশূন্য হয়ে পড়ে। রাত ১০টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই পাকুন্দিয়ার কলাটিয়া বাজার নিমেষে জনশূন্য হয়ে গেল। দূর থেকে কিছুক্ষণ পরপর শিয়াল আর কুকুরের ডাক কানে আসছে। এ সময়ে জঙ্গলের বুনো শেয়ালগুলো বেশ তৎপর। মানুষের লাশই তখন তাদের প্রধান খাদ্য। মানুষের মাংস খেয়ে খেয়ে এই শেয়াল কুকুরগুলোর চোখও ভয়ংকর আর ধূর্ত হয়ে উঠেছে। রাত গভীর হচ্ছে। ধানখেতের ওপর দিয়ে মৃদু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। সেই বাতাসের গায়ে বাড়ি খাচ্ছে সোনালি রংয়ের ধানের শিষ। সেই থেকে হালকা সংগীতের মতো একটা শব্দ তৈরি হচ্ছে। রাস্তার দুকোলজুড়ে তালগাছে বাদুড়ের বাসা থেকে মৃদু ডানা ঝাপটার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ কানে আসছে না। হান্নান মোল্লা তাঁর বাহিনীর লোকজন নিয়ে প্রস্তুত। অ্যামবুশের সব রকম ব্যবস্থা নিয়ে ওত পেতে শিকারের অপেক্ষায় বসে থাকা ছাড়া তাদের আর কোন কাজ নেই।
রাত বারটা। ধানখেতের ভেতর থেকে বিশেষ এক বুনো পাখির ডাক কানে আসে। পাখির ডাকের সাংকেতিক শব্দে মুক্তিযোদ্ধারা সবাই নড়েচড়ে উঠে। তারা জেনে নেয়, সবকিছু ঠিক আছে। এখন শুধু কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া। এখন হঠাৎ করে এই রাস্তা দিয়ে অন্য কোন যানবাহন না গেলেই সব দিক রক্ষে। ধানখেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চুপ বসে থাকা এত সহজ কথা নয়। একেতো নানা রকমের পোকামাকড়ের উৎপাত, সেই সঙ্গে রয়েছে কনকনে শীত। সেই শীতে অনেক সময় বিষাক্ত গোখরা সাপ গর্ত থেকে বের হয়ে পড়ে খাবারের খোঁজে। কিন্তু হান্নান মোল্লার বাহিনী খুব ভালো করেই জানে, এই পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী এই বিষাক্ত গোখরার থেকেও বেশি হিংস্র। অতএব এখন গোখরা আর পোকামাকড় আমলে আনলে চলবে না। আগে পাকিস্তানিদের বিষদাঁত ভাংতে হবে। তারপর ভাংতে হবে তাদের দোসর রাজাকার আলবদরদের। দেশকে মুক্ত করা ছাড়া আর কোন ভাবনাই হান্নান বাহিনীর মাথায় নেই। বাংলা থেকে এদের উৎখাত করে এই দেশের মাটি পবিত্র করা চাই।
রাত ২টা বাজতে আর মিনিট পাঁচেক বাকি। প্রস্তুতির সব রকম আয়োজন অনেক আগেই নেওয়া হয়ে গেছে। এবার শুধু অ্যামবুশ করার কাজ বাকি। এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা এই দলটির বিশেষ পারদর্শী আছে। কিছুদিন আগে কিশোরগঞ্জ থেকে কাছে হোসেনপুরে ঠিক এমন একটি অ্যামবুশে তারা অংশ নিয়েছিল। অতএব অতর্কিত আক্রমণ করে কীভাবে শত্রুকে পরাজিত করা যায়, সেই বিদ্যা তাদের বেশ ভালোই আছে। ঘড়ির কাটায় দুটো বাজতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি থাকতেই হঠাৎ করে দূরে একটি ইঞ্জিনের শব্দ কানে ভেসে আসছে। ধানখেতের দুপাশ থেকেই আবার বিশেষ একটি কুহু ডাক কানে এল। তার অর্থ হচ্ছে সবাই প্রস্তুত। ধীরে ধীরে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ খুব কাছে চলে এল। একটি পাঁচ টন মালামাল নেওয়ার বিশাল ট্রাক হেডলাইট জ্বালিয়ে পেট ফুলিয়ে হেলেদুলে দানবের মতো শব্দ করতে করতে ধেয়ে আসছে। দূর থেকে ট্রাকের ছাদে কিছু মানুষের ছায়াও দেখা যাচ্ছে। অনুমান করা কঠিন নয় যে, এই ছায়ার মতো মানুষগুলোই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্য। দেখলেই বোঝা যায়, ট্রাকটি বেশ ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে রয়েছে কিছু দেশি বিশ্বাসঘাতক রাজাকার আর আলশামস বাহিনীর সদস্য। তারা ট্রাকের চারদিকে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।
হাতে এখন আর কোনো সময় নেই। আর মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত।
রাত দুটো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বোঝাই ট্রাকটি কলাটিয়া বাজারে ঢুকল। ধুলো মাখা মাটির রাস্তা থেকে ট্রাকটি এবার ছোট সেতুটায় তার মোটা মাথা ঢুকিয়ে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তার দুপাশের ধানখেত থেকে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রগুলো বিকট শব্দে গর্জে উঠলে। কয়েকটা মুহূর্ত। দেখা গেল, ট্রাকটির দুপাশের চারটি চাকাই থেঁতলে মাটিতে বসে গেছে। পাকিস্তানি বাহিনীকে আর কোন সুযোগ না দিয়েই দ্বিতীয় দফায় বেক আপ অ্যামবুশ শুরু হল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিছু বোঝার আগেই তাদের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালাতে লাগল হান্নান মোল্লা বাহিনী। শুরু হল পাকুন্দিয়া কলাটিয়া বাজারে ভয়াবহ এক যুদ্ধ। গভীর রাতে এভাবে পাকিস্তানি বাহিনী এত অস্ত্রশস্ত্র থাকা সত্ত্বেও এমন বিপাকে পড়ে যাবে, তা তারা কল্পনাই করতে পারেনি। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার মারা গেল। এক সময় পাকিস্তানি হানাদারেরা পিছু হটতে বাধ্য হল। যুদ্ধের পুরো দখল নিয়ে নিল হান্নান বাহিনী।
পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া কিছু অস্ত্র হান্নান বাহিনী ট্রাক থেকে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে এল। যুদ্ধে হান্নান মোল্লার বাহিনীর দুজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হলেন। তাদের নাম জানা গেল। একজন মুর্শিদ আলী, অন্যজন মো. গোলাম হোসেন। আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার আগেই তাদের মৃত্যু হল। তার কিছুদিন পরই অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর তাদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেয় একটি নতুন দেশ, যার নাম বাংলাদেশ। (চলবে)