'আমারে কেউ ছুঁইও না গো সজনি'

শাহ আব্দুল করিম
শাহ আব্দুল করিম

মাস তিনেক আগে আমি ও আমার বন্ধু সেলিম ঢাকা থেকে পারাবত ট্রেনে সিলেট ফিরছিলাম। পাশের বগি থেকে আমার কানে ভেসে এল একটি গান— ‘আমি কুলহারা কলঙ্কিনী/ আমারে কেউ ছুঁইও না গো সজনি।’ বন্ধুর চোখ ফাঁকি দিয়ে সেই বগিতে গিয়ে দেখি এক অন্ধ বাউল দোতারা বাজিয়ে গান গাইছে, সাথে ১২/১৩ বছরের এক কিশোর। আমি তার পেছন-পেছন ট্রেনের শেষ প্রান্তে চলে গেলাম। ততক্ষণে গানটি মুখস্থ করে ফেলেছি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে বন্ধুটি দেখল বাউলের পাশে বসে আমি গান শুনছি। আমি এসব গান পছন্দ করি। আমার খালাতো বোন শেফালী আপা আমাকে এ গানের ক্যাসেটটি উপহার দিয়েছিলেন। এরপর অনেক শুনেছি এ গান। যত শুনেছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি। সেই থেকে আমার হৃদয়ে অজান্তেই প্রেম জাগ্রত হতে থাকল শাহ আবদুল করিমের ব্যাপারে। জানতে ইচ্ছা হচ্ছে তাঁর জীবন, সৃষ্টি, তান্ত্রিক, আধ্যাত্মিক, সুফি ভাবনাকে। যিনি সহজ কথার গাঁথুনিতে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার জাল বুনে, একাধারে হাওর, নদী জীবন ঘনিষ্ঠ, দেহতত্ত্ব, বাউলতত্ত্ব, বিচ্ছেদ, ধামাইল, গণসংগীত, রাজনীতি, আল্লাহ, নবী ও ভাটির মানুষের দুঃখ দুর্দশার গন্ধসুধা গায়ে মেখে একের পর এক গান রচনা করেছেন। সুর দিয়েছেন, নিজে দরাজ কণ্ঠে গেয়েছেন এসব গান দেশে ও বিদেশে। কোথায় নেই তাঁর বিচরণ?
কে জানত ১৯১৬ সালে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া, অবহেলা ও ক্ষুধার যন্ত্রণায় বেড়ে ওঠা শিশুটিই পৃথিবীর আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে। তিনি তাঁর কথার গাঁথুনি ও সুর মাধুর্যের সৌরভ ছড়িয়ে সারা বিশ্বের মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর আঙিনায়।
দিনটি ছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি, কৃষক মোহাম্মদ ইব্রাহীম ও নাইয়রজান বিবির কোলজুড়ে এল প্রথম সন্তান। তাঁর নাম আবদুল করিম। দাদা নসিব উল্লাহ ফকির জিকিরে মগ্ন থাকতেন। উদ্দেশ্য ছিল আত্মসাধন। তিনি ছিলেন শান্তমতি, ত্যাগী ও জ্ঞানী। দাদার আদর্শে ও স্নেহে বেড়ে উঠতে থাকেন আবদুল করিম। দাদার মুখে শোনা ‘ভাবিয়া দেখ মনে/ মাটির সারিন্দানে বাজায় কোনজনে’ গানটি তাঁর কচি মনে গেঁথে যায়।
হাওর-বাওর, খাল-বিল, কালনীর ঢেউ, ভাটির গানের হোগলা-হিজল, নলখাগড়া, শাপলা, কোড়া- সারসের কিচিরমিচির শব্দের সখ্য পাতিয়েই একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকেন আবদুল করিম। অভাব তার নিত্যসঙ্গী। অর্ধাহারে, অনাহারে আবার কখনো বা কেবল পানি খেয়ে দিনাতিপাত করেছেন। জীবিকার তাগিদে রাখালের চাকরি করেছেন বালক আবদুল করিম। মুরিদ হন সুনামগঞ্জের মৌলা বক্স মুনশির কাছে। তখন জানলেন পীর-মুর্শিদ ভজতে হলে ‘আপনাকে’ জানতে হয়। সেই মতো পেতে চাইলেন মুর্শিদের সন্ধান। গুরু বলেন, ‘আগে নিজের মন ঠিক কর, পরে এ কাজে ব্রতী হও। তবেই পাবে তার দেখা, সে দূরে নয়। আশিক হয়ে খুঁজলে মাশুকপুরে তার সন্ধান মিলবে।’ তিনি বলেন, ‘ঘুরতে ঘুরতে মন যেথায় গিয়ে রয়/ তথায় তোমার প্রাপ্য বস্তু জানিও নিশ্চয়।’
বাউলগান বাউলদের ধর্ম সাধনার অঙ্গ। বাউল সাধকগণ আধ্যাত্ম পিপাসা নিবারণ করেন গানের মাধ্যমে। বাউল গানের মূল চালিকা শক্তি সাংগীতিক চেতনা, ধর্মীয় আবেগ ও আত্মোন্নতির বাসনা। বাউল আত্মভোলা বিবাগি, ঘরছাড়া বৈরাগ্যপন্থী মানুষ। তারা একতারা হাতে মাঠে-ঘাটে পথে-প্রান্তরে খুঁজে বেড়ায় মনের মানুষকে। বাবরি চুলে, আবার কখনো ঝুঁটি বেঁধে হৃদয়বিহারী এই বাউল খুঁজে চলে ‘আশিকের ধন পরশ রতনকে’। বাউলরা ভাবের পাগল। নবীর তরিকা ছাড়া তারা কেতাব-কোরআন মানে না। আবার যারা চন্দ্রভেদী তারা পঞ্চরস সাধন করে। আধ্যাত্মিক ধারায় পরমাত্মাকে পাওয়ার জন্য ভক্তের মধ্যে যে আকুলতা, ব্যাকুলতা লক্ষ্য করা যায় তাতেই ‘আকুল থেকে আউল’, আর ‘ব্যাকুল থেকে বাউল’ হওয়ার বিষয়টি চিন্তা করা যায়। তাঁরা বেদ-কোরআন, মন্দির-মসজিদ, ভজন-সাধন, নামাজ-উপাসনা ইত্যাদি শাস্ত্রীয় ধর্মের রীতিনীতি মানেন না। তাঁরা সহজ পথে আরাধ্যকে পাওয়ার সাধনা করেন। লিখিত কোনো শাস্ত্র নেই তাঁদের। গানের ভাষায় তাঁরা ধর্মের কথা প্রকাশ করেন।
বাউল হতে হয় গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে। বাংলার অতি সাধারণ মানুষ হৃদয় দিয়ে বাউলভাব লালন করেছে। বাউলরা মানুষ ধরার মন্ত্র জানেন। তাঁরা ‘ভাবের মন্ত্রে প্রেমের মন্ত্রে’ মজান কৃষক-মজুর এবং সাধারণ শ্রেণির শত শত মানুষকে। এটাই তাঁদের শক্তির উৎস। তাঁরা মুক্ত মন ও স্বাধীন চিন্তার অধিকারী। তাঁরা বৈরাগ্যপন্থী। এ বৈরাগ্যই তাঁদের গানের মূল সুর। উদাসী বাউল সর্বস্ব ত্যাগ করে মনের মানুষের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। তাই বাউল গানের মূল সুর কান্নার। বাউল, সুফি ও বৈষ্ণবের এই কান্না কখনো থামার নয়।
বাউলরা শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকারী। আজ তাঁর দেহ নেই, তবে রেখে গেছেন তাঁর নিশ্বাস স্পন্দন অসংখ্য ভক্তানুরাগীর জন্য। তাই প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত ও সংগীত পিপাষুদের পদচারণায় মুখরিত উজানধল গ্রাম। আমি সে লোভ সামলাতে না পেরে গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ছুটে গিয়েছিলাম সুনামগঞ্জের মরমি কবি হাছন রাজার মিউজিয়ামে। প্রবেশ পথেই দেখলাম, হাসান রাজার গানের উৎসবের একটি ছবি, যেখানে বিভোর হয়ে গাইছেন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম। ছবির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। নিজের অজান্তেই চোখের কোনো জল জমল। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালাম জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা সামারিন দেওয়ানকে। এখানেই শেষ নয়, পাশের দেয়ালেই মরমি কবি হাছন রাজার বড় একটি আঁকা ছবি ঝুলছে। আর পুরো ঘরজুড়ে রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী।
পরদিন গেলাম শাহ আব্দুল করিমের গ্রামের বাড়ি। শ্রদ্ধা জানালাম সে মাটিকে, যেখানে শায়িত আছেন শাহ আব্দুল করিম। আমি মুগ্ধ হলাম। তাঁর একমাত্র সন্তান শাহ নূর জালাল ও তাঁর সহধর্মিণীর হৃদয় স্পর্শ করা ভালোবাসায় মুগ্ধ হলাম। শহরের যান্ত্রিকতায় আমরা যে রোবটে পরিণত হয়েছি, তা এই ভাটির মানুষের সান্নিধ্যে না এলে বোঝার সম্ভব নয়। শাহ আবদুল করিম সম্পর্কে জানতে চাইলাম। নূর জালাল বললেন, ‘বাবা এগারো দিন ছিলেন পানি না খেয়ে, আর চল্লিশ দিন চিল্লায় থাকতেন। এই সময় শুধু দুধ ও হালকা খাবার খেয়ে থাকতেন। তিনি প্রায় সময় গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। কারও সঙ্গে কোনো কথা বলতেন না। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় গণসংগীতের মাধ্যমে সমাজে নিপীড়িত মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন তিনি।’
বিকেলে ‘কোন মিস্তিরি নাও বানাইছে/ কেমন দেখা যায়’ গানটি শুনলাম মনোযোগ দিয়ে। এরপর আমার প্রিয় শাহ আব্দুল করিমের আরও কিছু গান শোনালেন তাঁরই শিষ্য ড. কাইয়ুম, উবেদ পাগলা, দুখু মিয়া, শাহ নুর জালাল, শ্যামলাসহ অনেকে। বাউল ঢঙে নেচে গেয়ে গাইলেন বাড়ির নারীরা। গান গানেই তাঁরই সৃষ্টিসম্ভারের মধ্যেই যেন খুঁজে পেলাম তাঁকে।
শাহ আবদুল করিমের বড় স্বপ্ন ছিল নিজের বাড়িতেই ‘শাহ আবদুল করিম সংগীতালয়’ প্রতিষ্ঠার। দুঃখের বিষয়ে অর্থাভাবে আজ সেই সংগীতালয়টি অসমাপ্ত রয়ে গেছে। বিভিন্ন খাতে যা অনুদান এসেছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। আমরা সংগীতপ্রিয় মানুষেরা, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা ভক্তেরা চাইলে বাউল সম্রাটের শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাঁর অসমাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব। এই সংগীতালয় চালু হলে, শুদ্ধ বাউলচর্চাকে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। দেশ-বিদেশের অগণিত ভক্ত ছুটে আসবে বাউল গান শুনতে এবং গবেষণা করবেন নবীন বাউলেরা।
রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পদক, একুশে পদক, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা, নিউইয়র্ক হাছন রাজা লোক উৎসব সম্মাননা, সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড আজীবন সম্মাননাসহ অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন শাহ আবদুল করিম। কিন্তু তাঁকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে, যদি তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী আবদুল করিম সংগীতালয় প্রতিষ্ঠা করা যায়।