নিজেকে ভালোবাসি, সুস্থ থাকি

বলা হয়ে থাকে আত্মপ্রেম শ্রেষ্ঠ প্রেম, আত্মপ্রেম স্বার্থপর নয়। কারণ যে নিজেকে ভালোবাসত পারে, সে অন্যকেও ভালোবাসতে পারে। ইংরেজি সেডোনা নামে একটা সাময়িকী আছে। এটিতে শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতা ঠিক রেখে নিজেকে ভালোবাসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ইংরেজি দুটো শব্দ emotional health বা mental health–এর ওপর খুব জোর দেওয়া হয়েছে। কেবল শারীরিক সুস্থতা নয়, একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য যেন ভালো থাকে, সে দিকে নজর রাখা জরুরি। নজরটা অন্য কাউকে নয়, আপনাকেই রাখতে হবে। অন্যরা যতটা না আমাদের ক্ষতি করে, আমরা নিজেরা তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতি করি। মানসিক স্বাস্থ্য মনের একটি ইতিবাচক অবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে, যেকোনো বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিকে বাড়িয়ে তুলতে এবং নিজের চেয়ে বড় কিছুর সঙ্গে সংযুক্ত করতে সাহায্য করে।
একটু চিন্তা করলে দেখবেন, আমাদের ছোট ছোট আচরণই খুব সূক্ষ্মভাবে আমাদের ক্ষতি করে। যখন দুজন মানুষ সামনাসামনি হয়, তখন এরা দুধরনের শক্তি নিয়ে আসে, একটি ইতিবাচক শক্তি, অন্যটি নেতিবাচক শক্তি। দুজন যদি ইতিবাচক হয় তাতে সমস্যা হয় না। কিন্তু যিনি নেতিবাচক তিনি তার সামনের জনের মানসিক পরিস্থিতির ওপর আঘাত করতে পারেন। হয়তো দুজনে খুব সামান্য ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে। একটা সময় তার নেতিবাচক প্রভাবে দুজনকে প্রচণ্ডভাবে আবেগী করে তুলল, দুজনেই হয়তো রেগে গেলেন। এতে দুজনের রক্ত চাপ বাড়ল, মানসিক বিপর্যয় শারীরিক অসুস্থতার প্রধান কারণ। রাগের কারণেই বেশির ভাগ রোগীর স্ট্রোক হয়।
এখানে দেখা গেল, যার নেতিবাচক শক্তি সেটা তার সামনের মানুষ শোষণ করে নিয়েছেন। কিন্তু তিনি যদি তার ইতিবাচক মনোভাবের সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হন, শান্তি প্রিয় হন তবে তিনি তার পজিটিভ শক্তি দিয়ে তাকে বদলাতে পারেন। প্রভাব ফেলতে পারেন। এতে প্রথমত তিনি নিজেকে নিরাপদ রাখলেন, কারণ তিনি শান্তি প্রিয় মানুষ নিজের শান্তি নষ্ট করতে চান না। আবার অন্যজনকে চাইলে তা দিয়ে প্রভাবিত করতে পারেন। যেমন—একজনের নাম আশা ও একজনের নাম আনন, তাদের কথোপকথন এ রকম—
আশা: তুমি বুঝতে পারছ না, আমি যা বলছি সেটাই ঠিক। এ ব্যাপারে আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
আনন: হ্যাঁ ঠিক আছে, তুমি ঠিক বলছ কাউকেই বিশ্বাস করা ঠিক না।
আশা নেতিবাচক শক্তি খরচ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। এরকম সরাসরি সমর্থন করে এক সময় নেতিবাচক ব্যক্তির আচরণে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারেন। এখন আপনি হয় তো বলবেন, সে ভুল বলছে তার ভুল কেন আমি সমর্থন করব? এ ক্ষেত্র আপনাকে বুঝতে হবে, তার হয়তো অনেক বেশি ব্যথার ভেতর দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। যার জন্য সে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এটি যেকোনো বিষয় হতে পারে। ধরুন, প্রেমের বা টাকা–পয়সার সম্পর্ক, সহায়–সম্পদ যেকোনো বিষয়। বিশ্বাস শব্দের সঙ্গে তার হয়তো দুঃখজনক অভিজ্ঞতা আছে, সে বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু আপনার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বিশ্বাস মানে সুখের কোনো অনুভূতি। কাউকে বিশ্বাস করে আপনি কখনো ঠকেননি, তাই বিশ্বাস মানে আপনার কাছে সুখ। মানুষ তার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আচরণ। ঠিক এই জিনিস প্রতিদিনই আমাদের আচরণে, ঘরে-বাইরে প্রতিফলিত হচ্ছে। এখানে আনন রেগে গিয়ে অনেক ক্ষুব্ধ আচরণ করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। এই যে ছোট ছোট আচরণে ইতিবাচক প্রভাব, এগুলো যদি একটা ঘরে প্রতিফলিত হয় একদিন সমাজের সর্বত্র না হোক, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হতে বাধ্য।
সহনশীলতা হচ্ছে মানসিকভাবে নিজেকে ঠিক রাখার সবচেয়ে বড় মন্ত্র। হয়তো ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছেন, কিন্তু আপনি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন, রেগে যাচ্ছেন। কিন্তু এতে আপনারই মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ট্রাফিক জ্যাম ছাড়ছে না। আপনি যদি নিজেকে এমতাবস্থায় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তবে আপনি একজন ইতিবাচক ব্যক্তিত্ব। সবকিছু হচ্ছে সহনশীলতা, গ্রহণযোগ্যতা। গ্রহণযোগ্যতা থাকে না বলেই দেখা যায়, একটা ঘরে স্বামী–স্ত্রীর কথা মানবেন না বা তার বিপরীতটা, শাশুড়ির কথা বউ মানবেন না। কারণ তিনি যেটা বলছেন সঠিক। অথচ একটা মাত্র ছোট্ট বাক্য, ‘ঠিক আছে’—সব ঠিক করে দিতে পারে। যখনই একজনের অন্যায় আচরণও সহ্য করতে পারছেন বা ক্ষমা করতে পারছেন, দেখবেন তখন এসব আপনার নিজের মানসিক স্থিতির ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। আপনি শান্তি প্রিয় মন নিয়ে চলতে পারছেন।
আমাদের আচরণগত প্রভাব প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের হয় ভালো করছে, নতুবা খারাপ করছে। ধরুন, আপনার শিশুম সন্তান ল্যাপটপ ব্যবহার করছে। কিন্তু হঠাৎ হাত থেকে ফেলে ভেঙে ফেলেছে। এমতাবস্থায় আপনি যদি তাকে বকা দেন, প্রথমত এতে আপনারই রক্তচাপ বাড়বে, দেহে একটা নেতিবাচক কম্পন হবে যা শারীরিকভাবে ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। বাচ্চা আহত হবে, আপনার ভালোবাসার প্রতি ভীতশ্রদ্ধ হবে, ভবিষ্যতে আপনার অবর্তমানে কোনো ক্ষতি হলে শাসনের ভয়ে স্বীকার করবে না। আপনি বকা দিলেও জিনিসটা ফেরত আসবে না। কিন্তু আপনি যদি বলেন, ‘তুমি ব্যথা পাওনিতো, ঠিক আছে। সমস্যা নেই ভবিষ্যতে সাবধানে ব্যবহার করো?’ তখন তার অপরাধবোধ কমে যাবে, এটি তার মানসিক অবস্থায় চির ধরাবে না। বরং ভবিষ্যতে যাতে এ রকম না হয়, সে ব্যাপারে নিজেই সচেষ্ট থাকবে। একইভাবে একটা কাপ বা গ্লাস ভাঙার অপরাধে যদি কাজের মানুষের সঙ্গে এই আচরণ করা যায় তবে সে নিজে বদলাবে, সেই সঙ্গে দোয়াও দেবে। এই একটা ইতিবাচক আচরণের জন্য কোনো অঘটনেও আপনি নিজের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পারছেন। নিজের ক্ষতি নিজেই রোধ করছেন। তা ছাড়া ক্ষমা হচ্ছে শান্তির প্রথম উপমা। এ মর্মে মহাত্মা গান্ধীর বাণী হচ্ছে, ‘দুর্বলরা কখনো ক্ষমা করতে পারে না । ক্ষমা হচ্ছে শক্তিমানদের গুণ।’
পরম্পরবিরোধী মনোভাব ভেতরে-ভেতরে যাদের পোড়াচ্ছে, তাতে তাদের নিজের সূক্ষ্ম ক্ষতি হচ্ছে যা এক সময় তাকে শারীরিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা। আমরা মনে মনে যা ভাবি, অন্য ব্যক্তি সম্পর্কে তা কিন্তু প্রতি সেকেন্ড রূপান্তরিত হচ্ছে। ঠিক টেক্সট মেসেজের মতোই আমাদের মনের ভালো–খারাপ অনুভূতি পৌঁছে যাচ্ছে অন্যজনের কাছে। তাই সবাই বুঝতে পারে, কে ভালোবাসে, কে ঘৃণা করে? কে এড়িয়ে যাচ্ছে। তবে নিজের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি করতে পারলে এসব পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।
পরিশেষে, মানসিকভাবে আমরা কে কাকে কতটা আঘাত করছি বা নিজেকে কতটা ব্যথা দিচ্ছি—তা গভীরভাবে না ভাবলে চোখে পড়ার কথা না। আমাদের মুখের সামান্য নেতিবাচক কথা, নেতিবাচক চিন্তা সব সময় যেমন সামনের মানুষের ক্ষতি করছে তেমন আমাদের নিজের ক্ষতি করছে। আমরা যদি বলতে শুরু করি, নিজেকে আর কষ্ট দেব না, অন্যের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাব না, আমার মনের শান্তি বজায় রাখব, নিজেকে ভালোবাসব। তখন সামনে যত বড় নেতিবাচক ব্যক্তিত্ব থাকুক, আপনার ক্ষতি করতে পারবে না। তাই সবার আগে আমরা নিজের মনের শান্তিটুকু খুঁজি, নিজেকে ভালোবাসি, বলি নিজেকে হিংসা–বিদ্বেষে জড়াব না। তখন অবিশ্বাস, ভুল বোঝাবুঝি আপনা থেকে মুছে যাবে।
সামান্য ভুল বোঝাবুঝি প্রিয়জনের সঙ্গে শুধু সম্পর্কে চির ধরায় না, নিজের মানসিক স্থিতি নষ্ট করে। যাকে ভুল বোঝে আঘাত করলেন, সে আঘাতটা পাপের পর্যায়ে চলে যায়। আমরা যখন নিজের মধ্যে পরিবর্তনশীল নেতিবাচক অনুভূতিকে পরাজিত করতে পারব, তখন অন্যকে সহজে গ্রহণ করতে পারব, ভালোবাসতে পারব। পারব নিজেকে রক্ষা করতে। কোনো অবস্থায় সামনের মানুষের নেতিবাচক শক্তির কাছে নিজের ইতিবাচক শক্তির অপচয় হতে দেবেন না। পরাজয় মেনে নিয়েও বলুন, ‘you are right বা আপনি ঠিক বলেছেন, আমি বুঝতে পারছি না।’