এত ভালো, ভালো নয়

একটা গল্প বলব। গল্পটা আমার নয়, শোনা। যাঁর কাছ থেকে শোনা, তিনি নেই। পরলোকগমন করেছেন।
তার আগে বলি, ভালো লাগার একটি মুহূর্ত। যখন খবরে দেখলাম, অসুস্থ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে হাসপাতালে গেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সঙ্গে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আবদুল মঈন খান।
এই হওয়া চাই। এমনটা দেখতেও ভালো লাগে, শুনতেও ভালো লাগে।
মানবিকতাবোধ সম্পন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুপস্থিতি যেখানে, সেখানে এ ধরনের রুচিশীল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তারা সুধী সমাজের প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
তবে ব্যতিক্রম আছে। ফেসবুকে দেখলাম, তাদের দলের কেউ কেউ বা অন্যরা রুচিহীন মন্তব্য করেছেন। খুব কষ্ট পেয়েছি এসব দেখে। মানুষের শোকে-দুঃখে, অসুখে-বিসুখে, বিপদে-আপদে পাশে থাকা, সহানুভূতি-সহমর্মিতা জানানো—এটাই মানবিকতা। তবে স্বস্তি পেতে চাই এ কথা ভেবে, ফেসবুকে ভুয়া খবর ও গুজবের ছড়াছড়ি থাকে। এ সব হয়তো তারই অংশ।
সমাজের সবার আচরণ, কথা বলা, রাগ-হাসি এক হওয়ার কথা নয়। কেউ মিষ্টভাষী, কেউ বদরাগী। কারও রসবোধ আছে, কারও নেই।
সবার বিচার-বুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এক নয়। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম। দেখার মধ্যেও আছে পার্থক্য। অর্ধেক গ্লাস দুধকে যে ইতিবাচকভাবে দেখবে সে বলবে, অর্ধ গ্লাস ভর্তি দুধ, আর যে নেতিবাচকভাবে দেখবে সে বলবে, গ্লাসের অর্ধেক খালি।
প্রকৃতিতেও দেখি, পাখির ডাক এক হয় না, থাকে না একই সুর। কাক ও কোকিলের ডাক কি কখনো এক হয়? হয় না।
পাশাপাশি দুটি দোকান। একই পণ্য বিক্রি করে। এক দোকানে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে, অন্য দোকানে ক্রেতা নেই। কেন? দামে কি আকাশ-পাতাল তফাৎ? না, তা নয়। সেলসম্যানশিপের পার্থক্য। এক জায়গায় হাসিখুশি ও মিষ্টভাষী মুখ, অন্য জায়গায় গুমড়ো-বিরক্তিকর পরিবেশ।
জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিনয় ও ভদ্রতার জয়জয়কার দেখা যায়। ‘প্লিজ’ ‘অনুগ্রহ করুন’ শব্দগুলোর অনেক মাহাত্ম্য।
নিজ ঘরেই দেখুন না, বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করলে ছোট হোক বড় হোক—হাতেনাতে ফল পাওয়া যায়। সমাজে অনেক আছেন কর্তৃত্বপরায়ণ। হুকুম করতেই তাদের পছন্দ, তামিল করতে নয়।
একই বিষয়, চারজনের মুখ থেকে চারভাবে আসবে। এই পার্থক্য যার যার রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ঘটে।
মানুষের মতের ভিন্নতা থাকা খুবই স্বাভাবিক। এই ভিন্নতা প্রকাশে রুচিহীন হতে হবে কেন? কেন হতে হবে আক্রমণাত্মক?
আসলে গুছিয়ে কথা বলা একটি গুণ, একটি শিল্প। সবাই তা পারে না, কেউ কেউ পারে। কিন্তু বিনয়, ভদ্রতা? ওটা পরিহার করব কেন।
টেলিভিশনে মাঝে-মধ্যে টক শো দেখি। বাংলাদেশ-আমেরিকার উভয় জায়গার। পছন্দ হলে শুনি, না হলে চ্যানেল বদলাই। কখনো কখনো মতের ভিন্নতা থাকলেও কোনো কোনো বক্তার বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনি। এটা বক্তার বলার গুণ। তার কথার মধ্যে আছে যুক্তি, আছে রসবোধ, সর্বোপরি স্পষ্ট পরিচ্ছন্ন অভিমত, নেই কোনো ধোঁয়াশা। বোঝা যায়, যে বিষয়ে বলছেন সে বিষয়ে তার যথেষ্ট পড়াশোনা আছে।
এক শ্রেণির বক্তা আছেন, তাদের মাইন্ড সেট করা। আগাগোড়া এক কাসুন্দিই ঘাটবেন। এর বাইরে যাবেন না বা যেতে পারেন না। কেউ কেউ আছেন, মনে হয় যেন কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করে দেওয়া হয়েছে, সেটাই আওড়ে যাচ্ছেন, জীবন্ত বলে কিছু নেই।
কর্মজীবনে এক সহকর্মী পেয়েছিলাম, তাঁর কথা ভুলব না। বিনা নোটিশে তিনি ঝগড়া শুরু করতে পারতেন। বলা নেই, কওয়া নেই, দেখা গেল তিনি চড়াও হয়েছেন, অতি সামান্য কোনো ব্যাপার বা উপলক্ষে। তবে অবাক ব্যাপার হলো, তার অন্তরটা ছিল ভালো, ভীষণ ভালো। তার বাসায় গেলে বারো/চৌদ্দ আইটেম রান্না করাতেন আপ্যায়নের জন্য। তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হতাম। একই মানুষের দুই রূপ, এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেতাম না।
যাক সে সব কথা।
বলছিলাম গল্প বলব।
গল্পটি মরহুম খসরুজ্জামান চৌধুরীর। তিনি মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, আমলা ও শিক্ষাবিদ। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘স্বাধীনতা পদক’ পেয়েছেন তিনি। সিলেট শহরের সে সময়ের অখ্যাত স্কুল ‘দি এইডেড হাইস্কুল’ থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তৎকালীন সারা পূর্ব পাকিস্তানে তিনি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন। এরপর সিএসপি কর্মকর্তা হন। একাত্তরে কিশোরগঞ্জ মহকুমার এসডিও থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর ময়মনসিংহের ডিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। এরপর আমৃত্যু আমেরিকায় প্রবাসজীবন কাটান। নিউইয়র্কের সিরাকিউজে ছিলেন দীর্ঘদিন। এরপর লুইজিয়ানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত করেন। তিনি ছিলেন সুসাহিত্যিক। বিশেষ করে রস সাহিত্যে তাঁর অনন্য অবদান ছিল। মুক্তিযুদ্ধ, গল্প, প্রবন্ধ ও ভ্রমণকাহিনি নিয়ে তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর স্ত্রী তাহমিনা জামানও একজন সুলেখিকা।
আমি বাংলা পত্রিকায় সম্পাদক থাকাকালে খসরুজ্জামান চৌধুরীকে পত্রিকায় ধারাবাহিক লেখার আমন্ত্রণ জানাই। আমার প্রস্তাবে তিনি সানন্দে রাজি হন এবং ‘যাহা বলিবে বুঝিয়া বলিবে, যাহা বুঝিবে তাহা বলিবে না’ শিরোনামে দীর্ঘদিন একটি কলাম লিখেন। খুব জনপ্রিয় বা পাঠকপ্রিয় ছিল কলামটি।
আমি তাঁর যে গল্পটি বলব তা হুবহু তাঁর ভাষায় নয়, বিষয়বস্তু ঠিক রেখে আমার মতো করে বলছি।
এক ছোট্ট মফস্বল শহর। ওই শহরের গৃহবধূরা সামাজিকতা ও বিনোদনের জন্য নিয়মিত পার্টির আয়জন করে থাকেন। এতে থাকে খাবার-দাবার, হাসি-কৌতুক, গান-বাজনা, আড্ডা- গল্প। পালাক্রমে একেকজন একেক বাড়িতে এই পার্টির আয়োজন করে আসছেন। বেশ ভালোই চলছে সবকিছু। কিন্তু সমস্যা ছিল এক জায়গায়। এক গৃহবধূর ছিল খুঁতখুঁতে স্বভাব। কোনো না–কোনো কিছুতে তিনি খুঁত ধরতে পছন্দ করতেন। তার কাছে কোনো অনুষ্ঠানই পারফেক্ট ছিল না। প্রতিটি অনুষ্ঠান শেষেই তার একটা না একটা বিরূপ মন্তব্য থাকত। সবাই ধরে নিত, যত ভালোই হোক, ইনি কিছু একটা মন্দ বলবেনই। হয়তো ওই খাবারটা ভালো সেদ্ধ হয়নি, ওটাতে লবণ বেশি হয়েছে, ওটাতে ঝাল, পায়েস ছিল তো দধি ছিল না, অমুকের গানটা কেমন বেসুরো ছিল, তালটা বারবার কেটে যাচ্ছিল, এই শরীর নিয়ে নাচ (!), এটা কোনো কৌতুক হলো(?), চেয়ার দুটি বেশি থাকলে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই এই খুঁতখুঁতে গৃহবধূকে নিয়ে ক্লান্ত। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু কিছুতো একটা করতে হবে। না হলে প্রতিবারের আনন্দঘন মুহূর্তটা ম্লান হয়ে যায় একেকটি মন্তব্যে, মাটি হয়ে যায় সবার পরিশ্রম। এটা রোধ করতেই হবে।
সবাই মিলে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, তারা এমন একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন, যাতে কোনোই ত্রুটি থাকবে না। দেখি, এবার খুঁতখুঁতে নারী কী বলেন। এটা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ।
পরিকল্পনামাফিক সবকিছু করা হলো। সুন্দর, ছিমছাম, গুছানো পার্টি। কোনো ত্রুটি নেই। সবাই হাসি-খুশি, আনন্দ-ফুর্তিতে বিভোর, কিন্তু চোখ ও কান খোলা ওই গৃহবধূর প্রতি। তিনি আজ কী বলেন। না, তিনি কিছু বলছেন না। বাহ, আজ তিনি জব্দ! মুখে রা নেই। ওই গৃহবধূ এদিক-ওদিক ঘুরছেন, দেখছেন, শুনছেন, তাকে তো কিছু বলতে হবে। কিন্তু কী করে বলেন প্রশংসার কথা। তাকে যে বলতে হবে নেতিবাচক কিছু। কিন্তু কি সেটা? তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। হঠাৎ তার মাথায় এল। এইতো পেয়েছি। তিনি বললেন ‘এত ভালো, ভালো নয়’।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।