বরিশালের গ্রামে হায়েনাদের তাণ্ডব

[ ১৯৭১ সালে বিভিন্ন বয়সের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন। যুদ্ধের সময় কেউ ছিলেন নিতান্তই বালক বা কিশোর, আবার কেউ ছিলেন টগবগে যুবক অথবা বয়স্ক মানুষ। বয়স যাই হোক না কেন, একাত্তরের স্মৃতি তাঁদের মনে গেঁথে আছে বিভিন্ন অভিজ্ঞতায়। গল্প লেখক ও শিশু সাহিত্যিক নসরত শাহ ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন নিতান্তই এক বালক। সেই বালক বয়সের চোখে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছিলেন। একজন বালকের চোখে কেমন ছিল সেই উত্তাল সময়? চলুন পাঠক, নসরত শাহের স্মৃতিতে ঘুরে আসি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উত্তল সময়। তিনি বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী, বসবাস করছেন কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যে]

এক বালকের স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ
গল্প-১৬
’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় বয়সে আমি ছিলাম নিতান্তই এক বালক। সেই বালক বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো আর স্কুলের পাঠ্যবই নিয়েই আমার সময় কাটতো। কিন্তু সেই সময়টা রাজনৈতিকভাবে ছিল উত্তপ্ত। সেই উত্তাপ আমরা ঢাকা থেকে দূরের বরিশাল শহর থেকেও পেতাম। আমাদের চারপাশের রাজনৈতিক উত্তাপের বিভিন্ন খবর আমাদের ঘরেও চলে আসতে। আমার বাবা–চাচাদের আলাপ-আলোচনায় বুঝতে অসুবিধা হতো না, দেশে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। আমার বাবা–চাচারা পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন। তাঁদের সবার কথারই সারাংশ ছিল, আমরা সবাই একটা স্বাধীন দেশের অপেক্ষায় বসে আছি। স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। এই পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে আর নয়। আমাদের বাপ-চাচাদের অভিমত ছিল, ১৯৪৭ সালে ভারত যখন ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হয়েছিল, ঠিক তখনই আমাদের পূর্ব বাংলাকেও স্বাধীন একটি দেশ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারপরও আর পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে নয়, এবার চাই স্বাধীনতা।
আমার জন্ম বরিশাল সদরে। আমার স্কুল আর শৈশবে আঁকা সব রং বরিশাল জেলা সদরকে ঘিরে। আমাদের বরিশালবাসী রাজনৈতিকভাবেও বেশ সচেতন ছিলেন। সেই কিশোর বয়সে দেখতে পেতাম, রাস্তায় মিছিলের পর মিছিল। ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে আমজনতা মিছিলে অংশ নিতেন, পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী স্লোগান দিতেন। এদিকে ’৭০–এর নির্বাচন আমাদের গোটা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমাদের বরিশাল শহরকেও এই নির্বাচন প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। তখন সেই অল্প বয়সেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে বড় দুজন নেতার নাম আমরা খুব গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করতাম তাঁরা ছিলেন মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরা দুজনই পূর্ব বাংলা স্বাধীনতার জন্য নানা কর্মসূচির ডাক দিয়ে বাংলার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এখনো মনে আছে, সত্তরের ঘূর্ণিঝড় এলাকা পরিদর্শন শেষে মাওলানা ভাসানী ঢাকায় পল্টনের মাঠে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ে তখন পূর্ব পাকিস্তানের উপকূল অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বিপুলসংখ্যক মানুষ ও গবাদিপশু মারা গিয়েছিল। মানুষ হয়ে পড়েছিল গৃহহীন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকার পূর্ব পাকিস্তানে কোনো ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আসেনি। মাওলানা ভাসানী পল্টনে এসে ঘোষণা দিলেন, ‘ওরা কেউ আসে নি। স্বাধীনতাই একমাত্র পথ।’
এদিকে সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরপরই আমাদের বরিশালবাসীর মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না, পূর্ব বাংলা পূর্ণ স্বাধীন হওয়ার পথেই এগোচ্ছে। তখন স্কুলে আমাদের ক্লাস হতো, আবার কখনো আধা বেলা হয়েই ছুটি দিয়ে দিত। বেশির ভাগ সময় আধা বেলা ক্লাসের পরই আমাদের ছুটি হতো। তখন আমরা কিশোরেরা বড়দের সঙ্গে মিছিলে অংশ নিতে যেতাম। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে নানা অজুহাত দাঁড় করাতে শুরু করল। তখনই আমরা ধরে নিয়েছিলাম মুজিবকে ক্ষমতা না দিলে দেশের জন্য সামনে বড় কোনো সংকট অপেক্ষা করছে। আমরা কিশোরেরাও তখন অনেক রাজনৈতিক সচেতন হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই এই নিয়ে রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক আর উত্তপ্ত আলাপ-আলোচনা হতো। আমরা ছোটরাও সে আলোচনায় সুযোগ পেলেই অংশ নিতাম। তারপর এল সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ শোনার জন্য দলে দলে বাংলার মানুষ ঢাকায় গিয়েছিলেন। আমাদের বরিশাল থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য লঞ্চের ভাড়া ফ্রি বা খুবই নামমাত্র ভাড়া রাখা হয়েছিল।
বেশ মনে আছে, ৭ মার্চের ভাষণের পরই সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রস্তুতিপর্ব শুরু হতে থাকে। বাঙালির হাতের কাছে লাঠিসোঁটা যা কিছু ছিল, তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে নেমে গেল। আমাদের বরিশাল শহরে কিছু অবসরে চলে যাওয়া ক্যাডেট কোরের কর্মকর্তা অথবা সেনাবাহিনীর সদস্য দেশের মুক্তিকামী মানুষকে প্রশিক্ষণ দিতে এগিয়ে এলেন। তাঁরা অস্ত্র চালনা থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষার সব কলাকৌশলের ওপর প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। বরিশাল শহরে পুলিশ, আনসার সবাই তখন একসঙ্গে কাজ শুরু করল। তখন প্রায় সময়ই বরিশাল শহরে ধর্মঘট ডাকা হতো। ধর্মঘট মানেই দোকানপাটের ঝাঁপ অর্ধেক খোলা রেখে বাকিটা বন্ধ করে ফেলা হতো। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল হতো।
আমরা ছোটরাও সেই মিছিলে অংশ নিতাম। তখন হঠাৎ করে কেরোসিন তেলের দাম বেড়ে যায়। একবার এক মিছিলে আলাউদ্দিন নামের এক স্কুলছাত্র মারা গিয়েছিল। এভাবেই ধীরে ধীরে বরিশাল শহরে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ বিস্তৃত হতে শুরু করে। শুধু বরিশাল নয়, তখন এই দৃশ্য ছিল গোটা পূর্ব বাংলারই। সেই সময়েই বরিশাল শহরের সদর রোডে ‘যুব সংঘ’ নামের একটি সংঘ গড়ে ওঠে। কালিবাড়ি রোড ধর্মরক্ষিণী ভবনে গোপনে এই যুব সংঘের সদস্যরা বোমা বানানোর কাজ শুরু করে। বেশ মনে আছে, তখন বোমা বানানোর কাজে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন আমাদের পরিচিত শিল্পী চিত্ত হালদার। তাঁর সঙ্গে আরও যারা নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা হলেন মিন্টু বসু, নুরুল আলম ফরিদ, এনায়েত হোসেন মিলন, এস এম ইকবাল, নুরুল ইসলাম চুন্নু, লিয়াকত আলী শাহ, আবুল হাসান আবদুল্লাহ, মইনুল হাসান, এনায়েত হোসেন চৌধুরী, বুলু ভাই, কালু ভাই প্রমুখ। আমরা ছোট ছিলাম বলে তাঁরা আমাদের কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। তবে গোপনে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সব খবরই টের পেতাম।
২৬ মার্চ ঢাকায় দমনপীড়ন ও ধরপাকড়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বরিশাল শহর থমথমে হয়ে যায়। সেই সময় আওয়ামী লীগের বড় নেতা আমির হোসেন আমু, নুরুল ইসলাম মনজুরসহ আরও অনেকেই বরিশাল সদর গার্লস স্কুলে বরিশাল সচিবালয় স্থাপন করেছিলেন। এই সচিবালয়ের মাধ্যমেই বরিশালের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণসহ মুক্তিযুদ্ধকে একটি সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ দেওয়ার সব রকম প্রস্তুতি চলতে থাকে। বরিশালের সব বাঙালি সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ বিভাগ এই সচিবালয়ে এসে তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ শুরু করে। সেই সময় মেজর জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকেও সচিবালয়ে আনা হয়। মেজর জলিলের কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। বরিশাল শহরে এভাবেই প্রাথমিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের কাজ শুরু হচ্ছিল।
এপ্রিলের দিকে একটি ঘটনা ঘটল। এক লোক গোপনে পাকিস্তানিদের কিছু রসদ ও গোলাবারুদ নিয়ে নদী পথে বরিশাল আসছিল। যেকোনোভাবেই হোক, খবরটি বরিশালের মুক্তিযোদ্ধাদের কানে এল। তখন নদীপথে আসা নৌকাটি মুক্তিযোদ্ধারা ঘেরাও করে লোকটিকে বেঁধে বরিশাল স্টেডিয়ামে আনে। পাকিস্তানি চর বলে প্রমাণ হলে তাঁকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় বরিশালের মুক্তিযুদ্ধ আরও বেগবান হয়। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাদের সাক্ষাৎ পেতে মুক্তিযোদ্ধাদের খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না। পাকিস্তানি চরকে গুলি করে মারার খবরটি সম্ভবত শোনার সঙ্গে সঙ্গেই এপ্রিলের শেষের দিকে পাকিস্তান বাহিনী আকাশ পথে কয়েকবার বরিশাল শহরের আকাশ প্রদক্ষিণ করে। পরে গানবোট, স্টিমার ও আকাশ পথে হামলা চালিয়ে বরিশাল শহর দখলে নেয়। পাকিস্তানি সেনারা বরিশাল শহরে ঢোকার পথে কসবা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সেখানে যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারান। শুরু হল বরিশাল শহরে গেরিলা অপারেশন।
বরিশাল শহরের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আমরা চলে গেলাম আমাদের গ্রামের বাড়ি টর্কি বন্দরে। আমাদের যাত্রা পথে ৩টা ফেরি পার হতে হল। আমরা সন্ধ্যা নদী পার হলাম। সকালে যাত্রা করে সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়ি পৌঁছালাম। বেশ মনে আছে, রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি, কার বাড়ি যাচ্ছি। সেই গ্রামে আমার এক চাচা ডাক্তার কেরামত আলী ডাক্তারি পাস করার পর স্থায়ীভাবে গ্রামে চলে এসেছিলেন এবং চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি গ্রামের মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। আমার বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী, আমার এই চাচা এত বড় ডাক্তার হয়েও গ্রামে এসে মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। সেই সময় তাঁর ভিজিট ছিল ৫ টাকা। তবে বেশির ভাগ গ্রামের মানুষই চাচাকে কোনো টাকাই দিত না বা বলা যায়, সেই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য তাদের ছিল না।
আমার বাবা হোসেন শাহ ছিলেন ব্যবসায়ী ও সমাজ সেবক। একসময় তিনি কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সেখানেই আমাদের বাড়ির পাশে ভিক্টোরিয়া হাই স্কুলের মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হল। প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিতেন। আমার বাবা ও চাচা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানাতেন। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা গেল, প্রায় দুই শ মানুষ প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ধীরে ধীরে এই সংখ্যা বাড়তে লাগল। মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দীন ও একজন অবসরপ্রাপ্ত আনসার কমান্ডার এই প্রশিক্ষণ দিতেন। আমার চাচা যেহেতু ডাক্তার ছিলেন, তাই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হলে কীভাবে তাকে প্রাথমিক সেবা দিতে হবে, সেই সব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন।
এদিকে বাড়িতে লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে। আমার চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই সবাই গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জোয়ান–বুড়া সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার আহ্বান জানাতেন। মনে পড়ে মন্টু দাশগুপ্তের কথা। তিনিও বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন। অনেকেই ভয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে আসতে চাইতেন না। বরং তাঁরা ভয়ে গোপনে কীভাবে পালিয়ে ভারতে চলে যাবেন, সে হিসাব কষতে ব্যস্ত থাকতেন। বিশেষ করে বরিশাল শহরে পাকিস্তানি সেনা আসার পর হিন্দু, মুসলমান সবার মধ্যেই এক অজানা আতঙ্ক বাসা বাঁধতে থাকে। অনেকেই ভয়ে দেশ ছাড়তে শুরু করেন। দেখা গেল, অনেক গ্রাম মানুষ শূন্য হয়ে গেল। আবার অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দলে দলে আসতে থাকেন।
এদিকে গ্রামেও পাকিস্তান সেনাদের আসা শুরু হল। একদিন দুপুরে গ্রামের মানুষজন দূরে মোটর গাড়ির শব্দ শুনতে পেল। দেখা গেল, শহরের হাইওয়ে সিএনবি রোড ধরে পাকিস্তান সেনারা ঢাকা থেকে ফরিদপুর-মাদারীপুর-ভুরঘাটা হয়ে বরিশাল শহরে আসছে। ভুরঘাটা শহরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তাদের গাড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাদের একটা অংশ গৌরনদী কলেজে তাদের প্রথম ঘাঁটি স্থাপন করে আর বাকিরা বরিশাল সদরে চলে যায়। বরিশাল গ্রামাঞ্চলেও তখন একধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমরা আরেক দফায় বরিশাল শহর থেকে আরও অনেক ভেতরে আমাদের আরেক বাড়ি বাঙিলায় ‘শাহ বাড়ি’ চলে গেলাম। এদিকে কমান্ডার নিজাম বাহিনীর দলের ছত্রচ্ছায়ায় মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে গৌরনদী অঞ্চলে হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। সেই সময় হেমায়েত বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের অপারেশন মাদারীপুর, গৌরনদী, কালকিনিসহ বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত। সেখানেই তারা বিচ্ছিন্নভাবে গেরিলা হামলা চালাত।
আমরা আমাদের বাঙিলা শাহ বাড়ি থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বর্বরতা আর তাণ্ডবের খবর শুনতে পেতাম। তারা বরিশালে গ্রামেগঞ্জে ঢুকে রীতিমতো তাণ্ডব চালাতে শুরু করে। গ্রামে কোনো মন্দির দেখলে সেই গ্রামে নেমে আসতে পাকিস্তানিদের বর্বরতা। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিত। বিশেষ করে সুন্দরদি, রামসিন্দি, আগৈলঝাড়া, পয়সা হাট, গৈলাসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ও হাট বর্বর পাকিস্তানি সেনারা পুড়িয়ে দিয়েছিল। গ্রামের অনেক মানুষ জীবন বাঁচাতে গভীর জঙ্গলে আত্মগোপন করতেন। কিন্তু পাকিস্তানি বর্বরতা থেকে গ্রামের কেউ রক্ষা পেতেন না। তারা গ্রামের সাধারণ মানুষের বাড়িঘর পোড়াত আর নারীদের ধর্ষণ করত। শুধু ধর্ষণই শেষ কথা ছিল না। ধর্ষণ করে নারীদের গোপন অঙ্গ বেয়নেট দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করত। বর্বর পাকিস্তানি সেনারা গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার পর এই আহত লাঞ্ছিত নারীদের আমাদের বাড়িতে আনা হতো। আমাদের ডাক্তার চাচা তার সাধ্য অনুযায়ী তাদের চিকিৎসা দিতেন।
আমাদের বাড়ির তিনদিকেই ছিল পানি। বর্ষার কারণে বাড়ির চারপাশই ছিল পানিতে টইটুম্বুর। ফলে বাড়িটি পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। আমাদের বাড়িতে রেডিও থাকায় রাতের অন্ধকারে গোপনে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতাম। তখন সেই ছোট বয়সেই মনে মনে শপথ নিতাম। এই বর্বর হায়েনাদের পরাজিত আমাদের করতে হবেই। চোখে তখন আমাদের একটাই স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ছিল নতুন স্বাধীন এক দেশ দেখার স্বপ্ন। (চলবে)