কিডনি দান ও কিছু কথা

সারা পৃথিবীতে প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ কিছু না কিছু কিডনি সমস্যায় ভুগছেন। অন্তত ২৪ লাখ মানুষ প্রতি বছর কিডনি রোগে মারা যাচ্ছেন। দ্রুত এর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির পাচ্ছে। সব মৃত্যুর কারণের মধ্যে কিডনিজনিত মৃত্যুর হার আজ বিশ্বে ছয় নম্বরে। তাই ২০১৯ সালের ১৪ মার্চে বিশ্ব কিডনি দিবসের থিম হচ্ছে ‘সবার জন্য এবং সবখানে কিডনির সুস্বাস্থ্য কামনা’। উদ্দেশ্য, এর মাধ্যমে পৃথিবীর সব জায়গায় কিডনিজনিত মহামারির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া আর তার সঙ্গে বিভিন্ন দেশে এর চিকিৎসার অপ্রতুলতা ও অসামঞ্জস্য তুলে ধরা।
কিডনির সমস্যার মতো পরিস্থিতির মোকাবিলায় অনেককে এগিয়ে আসতে হবে। নিজ দেশে কিডনি রোগের কারণ, প্রাথমিক রোগ নির্ণয়, শুরুতেই প্রতিকার, প্রয়োজনে উচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা, ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধাবিপত্তি ইত্যাদির জন্য প্রক্রিয়া বা আইন প্রণয়ন বা সংশোধন করার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়ার জন্য প্রভাবিত করা সবার জাতীয় দায়িত্ব। বিভিন্ন উপায়ে সংবাদমাধ্যম, বিশেষ সাংস্কৃতিক বা বিশেষ ব্যক্তিত্ব, সামাজিক সংগঠন, গ্রামগঞ্জে, শহরে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও তরুণ সমাজের সাহায্যে এর ভয়াবহতা প্রচার করতে হবে, জাগাতে হবে দায়িত্ববোধ। সব দেশের সব প্রাথমিক চিকিৎসককে দিতে হবে নতুন করে প্রাথমিক রোগ নির্ণয় ও প্রতিকারের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ। সাধারণ মানুষকে জানতে হবে, শুরুতে কখনো কোনো উপসর্গ থাকে না। তাই যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক রোগ আছে তাদের জন্য রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এর উপস্থিতি জানা প্রয়োজন। প্রাথমিকভাবে ধরা পড়লে বিভিন্ন চিকিৎসার মাধ্যমে কিছুটা প্রশমন করা যেতে পারে।
যাদের শেষ সময়ে ধরা পড়ে, তাদের জন্য কিডনি ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হয়। অন্যজনের কাছ থেকে কিডনি সংযোজন ব্যতীত বাঁচানো সম্ভব নয়। ডায়ালাইসিস আজ কিছুটা শুরু হলেও তা সবখানে নেই এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
কিডনি প্রতিস্থাপনের চিকিৎসায় বাংলাদেশ এগুলেও নিজেদের আত্মীয় ছাড়া আইনে কিডনি দান করার বিধান নেই। কিডনি সংযোজন নিয়ে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা অহরহ ঘটছে এবং প্রচুর অর্থ ব্যয়, বিদেশ ভ্রমণ এবং অনিশ্চয়তা নিয়ে মানুষের জীবন আজ দুর্বিষহ। পশ্চিমা দেশে মরণোত্তর কিডনি এবং অন্যান্য অঙ্গ দেওয়া একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে জীবিত আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে নেওয়ার প্রবণতা ও সামাজিক ভার অনেক কমেছে। ২০১৮ সালে আমেরিকায় ২১ হাজারের মতো কিডনি সংযোজন হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ হাজারের মতো মরণোত্তর অন্য অপরিচিত মানুষের কিডনি এবং ছয় হাজারের মতো আত্মীয়ের কাছ থেকে কিডনি গৃহীত হয়েছে। ব্রেন ডেড আত্মীয় লাইফ সাপোর্টে থাকার সময় কিডনি বা অন্যান্য অঙ্গ সংগ্রহ করতে হয়। মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হলে মানুষ আর বাঁচে না। যদিও লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের মাধ্যমে কিডনির ভেতর রক্ত চলাচল বজায় রেখে তাকে প্রতিস্থাপনের জন্য ব্যবহার করা যায়।
সব মানুষ মানবিক কারণে ওই সময় মরণমুখী ভালোবাসার মানুষের অঙ্গ দিয়ে অন্যদের অঙ্গ সংযোজন মেনে নিতে পারে না। এই প্রথা প্রচলনের জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে ঢাকা কিডনি ফাউন্ডেশনের এক পরিসংখানে দেখা গেছে, দেশের কয়েকটি নামকরা হাসপাতালের আইসিইউতে ২৫ ভাগ পরিবার তাদের প্রিয়জনের মরণোত্তর অঙ্গ দিলে কারওর উপকার হলে দিতে রাজি আছেন।
কিন্তু মানুষের গ্রহণযোগ্যতা, ব্রেন ডেড–এর স্পষ্ট আইন, গণমাধ্যমে মাঝে মাঝে ভয়াবহ চিত্র ও এই অপারেশনের সঙ্গে চিকিৎসকদের পরিচিতির অভাবে এই প্রক্রিয়াটি এখনো শুরু হয়নি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক হারুনুর রশীদ, ম্যানেজিং ডিরেক্টর টাইনি ফেরদৌস রশীদ একটি আন্তর্জাতিক কিডনি সেমিনারের আয়োজন করেন। তাতে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া ও কোরিয়ার এক দল চিকিৎসক অংশ নেন। আমেরিকা ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিডনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমিও সেই সেমিনারে যোগ দিয়েছিলাম। কিডনি ফাউন্ডেশনের যোগ্য সহকর্মী ও ঢাকার অন্যান্য স্বনামধন্য চিকিৎসক দল তাতে অংশ নেন। পাঁচ দিনব্যাপী সেমিনারের সময় কোরীয় চিকিৎসক দল বাংলাদেশের সার্জনদের হাতে–কলমে মরণোত্তর অঙ্গ সংযোজনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেন।
ঢাকার তিনটি হাসপাতালে ছয়জন ব্রেন ডেড রোগীদের উপযুক্ত বলে তারা শনাক্ত করেন। কিন্তু ছয়জনের মধ্যে কোনো পরিবারই তাদের আত্মীয়ের অঙ্গ দিতে রাজ্য হননি। উল্লেখ্য, এর ধর্মীয় কোনো বাধা নেই। কারণ, সৌদি আরবসহ সব মুসলিম দেশে অনেক পর্যালোচনার পর এই নিয়ম আজ প্রচলিত। কিছুদিন আগে ভারতেও এটার প্রচলন ছিল না। চেন্নাইতে একজন চিকিৎসকের একমাত্র সন্তান যখন গাড়ি দুর্ঘটনায় ব্রেন ডেড হয়ে গেল, তখন তার বাবা–মা দুজনেই ছেলের কিডনি দান করে বললেন, আমার ছেলে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবে। তারপর এখন চেন্নাইয়ে সেই হাসপাতালে মানুষ মরণোত্তর আত্মীয়ের কিডনি দেওয়ার জন্য এতটাই উদ্‌গ্রীব যে, এখন কিডনি নেওয়ার লোক কমে গেছে।
বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ভারতে তা আজ প্রতিফলিত হচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের মানুষও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শিগগিরই এগিয়ে আসবেন। শুধু কিডনি নয়, আজ বাংলাদেশে বহু শিশু চোখের কর্নিয়া সাদা হওয়ার জন্য অন্ধ হয়ে আছে। মরণোত্তর চক্ষু দানের মাধ্যমে অত্যন্ত সহজ উপায়ে এই রোগীদের দৃষ্টিদান সম্ভব। দুঃখের বিষয়, আমার এক আমেরিকান চোখের চিকিৎসক বাংলাদেশে ৮০টি কর্নিয়া নিয়ে গিয়ে তা দিয়ে মানুষের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে চায়। অথচ আমাদের মৃত আত্মীয়স্বজনদের চক্ষু দান করার অভ্যাস চালু করতে পারলে আমরাই আমাদের দুঃখী মানুষের চোখে আলো ফিরিয়ে দিতে পারি।
আজ বিশ্ব কিডনি দিবসে আমরা যেন উপলব্ধি করতে পারি আমাদের নিজস্ব শক্তি। ছড়িয়ে দিতে পারি আমাদের জ্ঞান। জাগিয়ে দিতে পারি মানুষের জন্য মানুষের সংহতি। আমরাই জ্বলে উঠতে পারি। ভুলে গেলে চলবে না, আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি কারও মুখাপেক্ষী হয়ে নয়, নিজস্ব মহিমায়। স্বাধীনতার মাসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ
ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়, ফিলাডেলফিয়া
সভাপতি, সিলেট কিডনি ফাউন্ডেশন