মহামন্দা আসছে নিউইয়র্কে?

আমেরিকার নিউইয়র্ক নগর প্রায় ৪০ বছর পর আবার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে। নিউইয়র্ক সিটির ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষণার সময় আসন্ন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। নিউইয়র্কে দীর্ঘকালীন দেনার পরিমাণ এখন পরিবার প্রতি ৮১ হাজার ১০০ মার্কিন ডলার। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে অতিরিক্ত কর আদায়ের ফলে নিউইয়র্কের উচ্চবিত্ত অনেকে শহর ছেড়ে অন্য অঙ্গরাজ্যে চলে যাচ্ছেন।
আবার মেয়র বিল ডি ব্লাজিও ক্ষমতায় আসার পর থেকে মূল বাজেটের ৩২ শতাংশের বেশি ব্যয় করেছেন। এটিও নিউইয়র্কের অর্থনীতিতে মন্দাভাব সৃষ্টি করেছে। সর্বশেষ মেয়র আব্রাহাম বিমের সময় নিউইয়র্ক সিটি এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল।
‘৪২তম জাতীয় ন্যাশনাল মুভারস স্টাডি’ শীর্ষক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নিউইয়র্ক ছেড়ে অনেক উচ্চবিত্ত অন্য অঙ্গরাজ্যে চলে গেছেন। বিপরীতে যারা নিউইয়র্কে এসেছেন, তাদের আয় ততটা উচ্চ নয়। এর কারণ হিসেবে উচ্চবিত্তদের ওপর ধার্য করা উচ্চ করহারের কথা বলা হচ্ছে।

জরিপের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে অঙ্গরাজ্য পরিবর্তন করা ব্যক্তিদের ৬১ দশমিক ৫ শতাংশই নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য ছেড়ে গেছেন। বিপরীতে নিউইয়র্কে এসেছেন ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ। নিউইয়র্ক ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৪১ শতাংশেরই আয় দেড় লাখ ডলারের বেশি। নিউইয়র্ক ছাড়া ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র ৮ দশমিক ৪ শতাংশের আয় ৫০ হাজার ডলারের নিচে। অর্থাৎ গত বছর যারা নিউইয়র্ক ছেড়ে গেছেন, তাদের মধ্যে উচ্চবিত্তদের সংখ্যাই বেশি।
অঙ্গরাজ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয়টি হচ্ছে, চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা। গত বছর নিউইয়র্কে যারা এসেছেন, তাদের ৬০ শতাংশেরই লক্ষ্য ছিল চাকরি। অন্যদিকে একই কারণে নিউইয়র্ক ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ৪৪ শতাংশ অঙ্গরাজ্যটি ত্যাগ করেছেন।
নিউইয়র্ক নগর ও অঙ্গরাজ্য আমেরিকায় কর ও দেনার দিক থেকে এক নম্বরে। প্রোপার্টি কর থেকে নিউইয়র্ক নগরের আয় প্রায় মূল বাজেটের অর্ধেক। কিন্তু সেই প্রোপার্টি কর হু হু করে বাড়ার কারণে নিউইয়র্কবাসীর ত্রাহি অবস্থা। অনেকে অঙ্গরাজ্য ছেড়ে যাচ্ছেন। এতে করে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর বিভাগের তাড়া খেয়েই উচ্চবিত্তরা নিউইয়র্ক ছাড়ছেন। গত বছর কর ব্যবস্থা পুনর্গঠনের পর উচ্চবিত্তের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের করহার বেড়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে অঙ্গরাজ্যের ধার্য করা কর। নিউইয়র্ক নগর ও অঙ্গরাজ্য মিলিয়ে মোট কর এখন ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে, ফ্লোরিডার মতো কিছু অঙ্গরাজ্যের ধার্য কোনো আয়কর নেই। নতুন ফেডারেল কর আইনটি ফেডারেল ও স্থানীয় কর মিলিয়ে নিউইয়র্কের মতো উচ্চকরের অঙ্গরাজ্যকে উচ্চ আয়ের লোকেদের জন্য ব্যয়বহুল করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিউইয়র্ক অনেক কোটিপতি হারাচ্ছে। শীর্ষস্থানীয় উপার্জনকারীদের আয়ের বিপরীতে ৪৬ শতাংশ কর হিসেবে পরিশোধ করতে হয়।
গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোও স্বীকার করেছেন, ‘করদাতাদের অল্পসংখ্যকও যদি নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে যায়, তা রাজস্ব আয়ের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। নিউইয়র্কের ধনী ব্যক্তিরা মূলত কর পরিশোধ থেকে পালাতেই অঙ্গরাজ্য ত্যাগ করছেন। এটা উচিত নয়।’
সব মিলিয়ে উচ্চবিত্তদের কাছে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য বসবাসের জন্য আর আকর্ষণীয় থাকছে না। কর আদায়ে অঙ্গরাজ্য সরকার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি তৎপর। ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে নিউইয়র্কে প্রায় ৩ হাজার অনাবাসিক উচ্চবিত্তকে নিরীক্ষা (অডিট) কার্যক্রমের আওতায় এনেছে। এই সময়ের মধ্যে এই ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলার কর আদায় করেছে কর বিভাগ।
নিরীক্ষার ক্ষেত্রে তদন্ত সংস্থা সন্দেহভাজন মানুষের সেলফোন রেকর্ড, সামাজিক গণমাধ্যমে তার ফিড, চিকিৎসক ও তাদের পোষা প্রাণীর চিকিৎসা রেকর্ডসহ বাসস্থানের নানা রকম খরচের তথ্য যাচাইয়ের দিকে নজর দিচ্ছে। এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিদর্শনের সময় তদন্ত কর্মকর্তারা চাইলে করদাতাদের বাড়ির বা অফিসের রেফ্রিজারেটরও খুলে দেখতে পারেন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে কর সংগ্রাহক ও ধনী নিউইয়র্কবাসীর মধ্যে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে। নিউইয়র্কের উচ্চবিত্তদের অনেকেই কর রেয়াত পাওয়ার আশায় ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের দিকে চলে যাচ্ছেন। এই সংকট তৈরি করেছে রাষ্ট্রই। ফেডারেল কর আইনে ধনী নিউইয়র্কবাসীদের ফ্লোরিডা বা অন্য নিম্ন-করহারের অঙ্গরাজ্যে স্থানান্তরের জন্য উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। বিপরীতে কর বিভাগ চালু করেছে এক বিশেষ ট্র্যাকিং ব্যবস্থা।
নতুন ট্যাক্স রেসিডেন্সি ট্র্যাকিং সংস্থা একটি অ্যাপ তৈরি করে সম্প্রতি বাজারে ছেড়েছে, যার গ্রাহক মূলত কর বিভাগ। এই সংস্থার সাহায্যে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের কর ও আর্থিক বিভাগ নিশ্চিত করতে চায়, যেন কোনো উচ্চআয়ের নিউইয়র্কবাসী কর পরিশোধ ছাড়া অঙ্গরাজ্য ত্যাগ করতে না পারে। এই সংস্থার মাধ্যমে ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের অনাবাসিক উচ্চবিত্তদের ওপর প্রায় ৩ হাজার তদন্ত চালানো হয়।
উইথুম স্মিথ অ্যান্ড ব্রাউন অ্যাকাউন্টিং ফার্মের মতে, প্রথাগত কর নিরীক্ষা পদ্ধতি করদাতাদের আর তেমন কোনো সাহায্য করছে না। তারা বলছে, নতুন যে অ্যাপ এসেছে, তা খুবই কার্যকর। এর মাধ্যমে করা তদন্তের সবটিতেই জয় পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নিউইয়র্কের কর কর্মকর্তারা উচ্চবিত্ত করদাতাদের শনাক্তে উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যার মাধ্যমে করদাতার ক্রেডিট কার্ড বিল, পুরস্কারের টাকা, স্বর্ণালংকার, ভ্রমণের সময়সূচি, মোবাইল বিলের রেকর্ডসহ প্রায় সবকিছু সম্পর্কে খুব সহজেই তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
উইথুম স্মিথ অ্যান্ড ব্রাউন অ্যাকাউন্টিং ফার্মের অংশীদার ব্যারি হরোভিটস বলেন, ‘একজন উচ্চ আয়ের নিউইয়র্কবাসী অন্য অঙ্গরাজ্যে চলে যেতে চাইলে কর পরিশোধ করে যেতে হবে। কারণ নতুন পদ্ধতিতে বাসস্থান যেখানেই হোক না কেন, সেখানে নিরীক্ষার সম্ভাবনা শতভাগ।
হগসন রাস ট্যাক্স অ্যাটর্নিদের চেয়ারম্যান মার্ক ক্লেইন বলেন, ‘আমাদের অফিস এখন প্রায় ২০০টি ট্যাক্স-রেসিডেন্সি অডিট নিয়ে কাজ করছে। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে নিউইয়র্কে একটি বিশাল পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। আসলেই উচ্চ আয়ের ব্যক্তিরা নিউইয়র্ক ছেড়ে যাচ্ছে।
নিউইয়র্কের কর বিভাগের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন। তবে এক মুখপাত্র বলেছেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করদাতাদের কর পরিশোধ নিশ্চিত করা আমাদের কাজ। এর জন্য আমাদের কর নিরীক্ষা প্রকল্প সব সময় খুব সক্রিয় থাকে।
অন্যদিকে আমাজন নিউইয়র্ক সিটি থেকে চলে যাওয়ার কারণে সিটি ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বেশি আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ বিষয়ে অঙ্গরাজ্যের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো বলেন, ‘আমার সরকারকে নিউইয়র্ক নগর থেকে আমাজনের চলে যাওয়ার মতো এমন বিরাট দুঃখজনক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি কখনো। কেউ আসলে জানে না, একটা সরকার কীভাবে চলে।’
আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চের অর্থনীতিবিদ পিটার আর্লে বলেন, শিগগিরই নিউইয়র্ক সিটি ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষণা হবে। ভেস্টেডের প্রধান অর্থনীতিবিদ মিলটন ইজ্রাটি বলেন, নিউইয়র্ক নগরের অর্থনীতির এখন খুবই কঠিন অবস্থানে আছে। অর্থনীতিতে একটু হেরফের হলেই এর অর্থনীতিতে ধস নামবে।
নিউইয়র্ক নগরের বর্তমান বাজেট ৮ হাজার ৯০২ কোটি ডলার। মেয়র ডি ব্লাজিও ইতিমধ্যে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি ডলার ব্যয় করেছেন। যদিও ২০২০ সালের বাজেটে মেয়র ৭৫ কোটি ডলার সঞ্চয় দেখিয়েছেন। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতে এই সঞ্চয় মোটেই যথেষ্ট নয়।