মুক্তিযুদ্ধে একজন মহকুমা প্রশাসক

খসরুজ্জামান চৌধুরী
খসরুজ্জামান চৌধুরী

[১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারী পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে এককাট্টা হয়ে কাজ করেছিলেন। তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহকুমা শহরের মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) খসরুজ্জামান চৌধুরী তাঁদের অন্যতম। কিশোরগঞ্জ মহকুমায় মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করতে তাঁর ভূমিকা ছিল অসাধারণ। কিশোরগঞ্জ শহরের সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেই অর্থ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক কল্যাণে তুলে দিয়েছিলেন। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে সরকারি কর্মচারীরা যাতে কোনো রকম অর্থনৈতিক দুর্ভোগ না পোহান, তা মাথায় রেখে তিনি সবাইকে তিন মাসের অগ্রিম বেতন দিয়েছিলেন। খসরুজ্জামান চৌধুরীর বিষয়ে আরও নানা অজানা তথ্য দিয়ে এই লেখাটি তৈরি করতে সাহায্য করেছেন তাঁর স্ত্রী তাহমিনা জামান। তিনি বর্তমানে আমেরিকায় বসবাস করছেন।]

গল্প-১৭
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে খসরুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন কিশোরগঞ্জ মহকুমার প্রশাসক। দেশে তখন থমথমে অবস্থা। সবাই তখন এক অজানা উৎকণ্ঠায় ভুগছিলেন। কী জানি কী হয়! এদিকে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই দেশবাসী যেন তাদের করণীয় সম্পর্কে একটি দিক্‌ নির্দেশনা খুঁজে পেল। একই সঙ্গে উদ্বুদ্ধ হলো। অন্যদের মতো খসরুজ্জামান চৌধুরীও সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন, দেশকে স্বাধীন করতে হলে মুক্তিযুদ্ধই হলো একমাত্র পথ। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও ছিলেন অসম্ভব রকম নীতিমান ও আদর্শবান মানুষ। তিনি যেন এমন একটি দিক নির্দেশনার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর খসরুজ্জামান কিশোরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করতে মাঠে নেমে গেলেন। ৭ মার্চের ভাষণের কিছুদিন পর অর্থাৎ ২৫ মার্চ রাতে দমন-নিপীড়নে গোটা বাংলাদেশে কালো অন্ধকার নেমে আসে। মানুষের মনে তখন ভয়, উৎকণ্ঠা, সেই সঙ্গে দ্রোহ। কী ঘটতে যাচ্ছে? কিশোরগঞ্জের মতো মফস্বল শহরেও সেই ঢেউ স্পষ্ট বিদ্যমান। ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি হায়েনাদের বর্বর আক্রমণের পরই খসরুজ্জামান সিদ্ধান্ত নেন, তিনি তাঁর নিজের এলাকা অর্থাৎ কিশোরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। এরই মধ্যে ২৬ মার্চ ঢাকা থেকে খসরুজ্জামানকে উদ্দেশ্য করে জরুরি একটি চিঠি এল। চিঠির মূল বক্তব্য, কিশোরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের কাজকে ত্বরান্বিত করতে হবে। স্পষ্ট মনে আছে, ঢাকা থেকে আসা সেই চিঠিটি আমি নিজ হাতে গ্রহণ করে খসরুজ্জামানকে দিয়েছিলাম। চিঠিটি পাওয়ার পরপরই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজে নামতে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। প্রথমেই তিনি কিশোরগঞ্জ মহকুমার অস্ত্রাগার থেকে ৫০০ অস্ত্র তুলে এনে তা স্থানীয় ছাত্রদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন।
এদিকে মহকুমা প্রশাসকের কাজের সঙ্গে নৈতিক সমর্থন জানিয়ে তাঁর অধীনস্থ সব সরকারি কর্মচারীরাও এক যোগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। ২৯ মার্চ খসরুজ্জামান কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়ামে বিশাল এক গণজমায়েত করলেন। উদ্দেশ্য, মুক্তিযুদ্ধে গোটা কিশোরগঞ্জবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা এবং সেই সঙ্গে তাদের সঙ্গে কাজ ভাগ করে নেওয়া। ধারণা করা হয়, সেদিন স্টেডিয়ামে প্রায় ৭–৮ হাজার মানুষ এসেছিল। সেখানে তিনি প্রথমে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং জয় বাংলা উচ্চারণ করে বক্তৃতা শুরু করেন। কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়ামটি ছিল আমাদের বাসা থেকে খুব কাছেই। মাইকের আওয়াজ আমি বাসা থেকেই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। সেদিন খসরুজ্জামানের স্টেডিয়ামে দেওয়া ভাষণের কিছু অংশ এখনো আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। আমি যদি কখনো কিশোরগঞ্জ ছেড়ে দূরেও চলে যাই, তাহলে সে খবরটিও আমি আপনাদের জানিয়ে যাব। এখন দেশের কঠিন সময়। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা সবাই, আমাদের কাজ ভাগ করে নেব। মুক্তিযুদ্ধই এখন আমাদের একমাত্র পথ। জয়বাংলা।’
এদিকে ২৬ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তাণ্ডবের কারণে ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ মফস্বল শহরের দিকে আসতে শুরু করেছিল। কিশোরগঞ্জ শহরেও প্রচুর মানুষ আসতে শুরু করলেন। এসব মানুষের থাকা–খাওয়া যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য তিনি প্রশাসনকে নির্দেশ দিলেন। এরই মধ্যে তিনি কারাগারের কয়েদিদের মুক্ত করে দিলেন। কয়েদিরাও সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার শপথ নিল। তখন থেকেই কিশোরগঞ্জে গোপনে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে এসডিও খসরুজ্জামান ব্যস্ত হয়ে উঠেন। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন এসডিটিপিও আবদুল মোতালেব ও কিশোরগঞ্জ মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম আকবরসহ আরও অনেক সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাঁরা ওয়ারলেসের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ শুরু করতে শুরু করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যাতে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ আসতে না পারে, সে জন্য তাঁরা ঢাকা-কিশোরগঞ্জের রেলপথ বন্ধ করে দেন। শুধু কিশোরগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া যোগাযোগটি অক্ষত রাখা হয়েছিল। কারণ এই পথে দলে দলে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ভারতে যাচ্ছিল। শুধু তাই নয়, খসরুজ্জামান কিশোরগঞ্জে গ্যাসস্টেশন রেশনের আওতায় নিয়ে আসেন। রেশন কার্ড ছাড়া কাউকে গ্যাস দেওয়া হতো না। এর সবই করা হয়েছিল কিশোরগঞ্জ শহরের বিশেষ নিরাপত্তা জোরদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাজকে সহজ করার জন্য। এদিকে সরকারি কর্মচারীরাও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন। সরকারি কর্মচারীরা যেন কোনো রকম অর্থ কষ্টে না পড়েন, সে জন্য খসরুজ্জামান বিশেষ ক্ষমতা বলে সব সরকারি কর্মচারীদের তিন মাসের অগ্রিম বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সিদ্ধান্তের কারণে অনেক সরকারি কর্মচারী যুদ্ধকালে আর্থিক অভাব অনটন থেকে নিজের পরিবারদের মুক্ত রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন।
পাকিস্তান সরকার কয়েক দিন পরই টের পেতে থাকে, তাদের অধীনস্থ রাষ্ট্রের কর্মচারীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। সে কারণে তারা কিছুদিন পরেই সমন জারি করে, যদি কোনো সরকারি কর্মচারী সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজে যোগ না দেয়, তাহলে শাস্তি হিসেবে তাদের কপালে জুটবে সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। খসরুজ্জামানকেও তারা চিঠি পাঠায়, তাঁর আসামি নম্বর ছিল ৭। বলা বাহুল্য, পাকিস্তান সরকারের এসব চিঠি আর ভয়ভীতি তখন বাঙালি থোড়াই কেয়ার করেছিল। এরই মধ্যে দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে মেজর সফিউল্লাহ তাঁর একজন বিশ্বস্ত ক্যাপ্টেনকে কিশোরগঞ্জ মহকুমার এসডিও খসরুজ্জামান চৌধুরীর কাছে পাঠান। উদ্দেশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে জরুরি টাকা প্রয়োজন। তিনি স্থানীয় কিশোরগঞ্জ রথখোলা সংলগ্ন ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে তাৎক্ষণিক তিন কোটি টাকা উঠিয়ে মেজর সফিউল্লাহর পাঠানো বাহকের সঙ্গে দিয়ে দেন। এভাবেই একজন মহকুমা প্রধান হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের কাজে সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এ ঘটনাটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর নৈতিক এবং সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক সমর্থনও।
এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন খবর আসে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিশোরগঞ্জের কাছাকাছি সরারচর ইউনিয়ন পর্যন্ত চলে এসেছে। খসরুজ্জামান সঙ্গে সঙ্গে ভাবলেন, বিপদ সন্নিকটে। এই অঞ্চলের মানুষের সামনে সমূহ বিপদ। তিনি একজন মহকুমার প্রধান হয়ে শহরকে এভাবে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রেখে যেতে পারেন না। তাঁর নির্দেশ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী, একটি ছোট স্কুটারে মাইক লাগিয়ে শহরবাসীকে তাদের আশু বিপদের কথা জানানোর সিদ্ধান্ত হলো। গোটা শহরে মাইকিং করে শহরবাসীকে বলে দেওয়া হলো, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সরারচর পর্যন্ত এসে গেছে। অতএব শহরবাসী যেন আর দেরি না করে জানমাল নিয়ে নিজ নিজ নিরাপদ স্থানে চলে যায়। এসডিও আমাকে আমার ৮ মাস বয়সী পুত্রসন্তান সাইদ চৌধুরীকে (ফয়সাল) গ্রামের বাড়ি নবীনগর পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক গভীর রাতে আমরা কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশনে যায়। সেখানে খুব গোপনে একটি ট্রেনে চড়ে প্রথমে কুলিয়ারচর যাই। সেখান থেকে একটি লঞ্চে তিনি আমাদের তুলে দেন। এভাবেই আমি নবীনগর চলে আসি। নবীনগরে শুরু হয় আমার আরেক জীবন। আমাদের নবীনগর পাঠিয়ে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে নেত্রকোনার পথে রওনা হোন। গাড়ির চালক ছিলেন সুবোধ বাবু। খসরুজ্জামান গাড়িচালক সুবোধ বাবুকেও তাঁর পরিবার পরিজনকে উঠিয়ে নিতে বললেন। তাঁর নির্দেশে সুবোধ বাবুও যাত্রাপথে তাঁর পরিবারকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি গোপনে কিশোরগঞ্জ ত্যাগ করেন এবং নেত্রকোনার কংস নদী পার হয়ে ভারতের বাঘামারা পৌঁছান।
ভারতে পৌঁছেই খসরুজ্জামান মুজিব নগর সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদে কাজ শুরু করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এ পদেই ছিলেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া শরণার্থী ক্যাম্পের অর্থনৈতিক বিষয়টিও তিনি দেখভাল করতেন। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২১ ডিসেম্বর তাঁকে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল খসরুজ্জামান আমেরিকায় মারা যান। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় লং আইল্যান্ডে তাঁকে দাফন করা হয়। ২০১৪ সালে তাঁকে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।