স্কুল শুটিং

সকাল সাতটা। ঘুম ভাঙা চোখে একেকজন ব্যাকপ্যাক কাঁধে স্কুলে ঢুকছে। সিনিয়রদের ক্লাস সাতটা পনেরোয় শুরু। মারিয়া, লুসি, গ্যাব্রিয়েল, ডেভিড, মীর্যা, মনীষা স্কুলে ঢুকছিল তখনই একজন ব্যাকপ্যাক খুলে পিস্তল বের করল আর গ্যাব্রিয়েলকে লক্ষ্য করে গুলি করল। মুহূর্তের মধ্যে পুরো স্কুলে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। পিস্তলসহ সে কোনো এক ক্লাস রুমে ঢুকে পড়ল। প্রিন্সিপাল ম্যাকডোনাল্ড ছাত্র-ছাত্রীদের বের করে নিতে মাইক্রোফোনে ঘোষণা দিলেন। সিকিউরিটি ক্যামেরায় চোখ রেখে বাইরের সাহায্য চাইলেন। মেইন গেট বন্ধ করে দেওয়া হলো, অধিকাংশ ছেলেমেয়ে টিচারদের সঙ্গে বের হয়ে গেল। কিন্তু অস্ত্রধারী কোথায় আছে বোঝা যাচ্ছে না। অস্ত্রধারী একজন নাকি একাধিক কে জানে!

মারিয়ানা আর লুসিফার
ওশেন পার্কওয়ে আর ক্রোফোর্ড অ্যাভিনিউয়ের কর্নারে দোতলা বাসাটি ওদের। এই বাড়িটি ডুপ্লেক্স। এর সামনের লনে রবার্তো এসে সিজনাল ফুল গাছ লাগিয়ে দিয়ে যায়। রবার্তোর বউ ভিবিয়ান সপ্তাহে একদিন এসে সব পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। রবার্তো আর ভিবিয়ানের মেয়ে এনা ওর মায়ের সঙ্গে এলে খুব খুশি হয় লুসিফার। লুসিফার আর মারিয়ানা দুই বোন। দুজনেই আব্রাহাম লিঙ্কন হাই স্কুলে যায়। লুসি সফমোর আর মারিয়ানা সিনিয়র। এনা একই স্কুলে যায়, ফ্রেশমেন। নাইনথ গ্রেডে। এই মেয়েটি খুব বুদ্ধিমতী। ভীষণ চটপটে আর মিশুক স্বভাবের । দেখতেও খুব আদুরে চেহারার। খুব ছোট বয়স থেকে ওর মায়ের সঙ্গে এই বাসায় আসত। ওরা তিনজন একসঙ্গে খেললেও কীভাবে যেন লুসির সঙ্গে একটু বেশি ভাব এনার। লুসি, মারিয়া, এনা ওদের স্কুলের বাস্কেটবল খেলার চিয়ার লিডার। মারিয়া চিয়ার লিডারের ক্যাপ্টেন। ওদের কোরিওগ্রাফি করা, কস্টিউমের ডিজাইন, কালার পছন্দ করা দুই বোন মিলেই করে। এনা গঞ্জালেজের নাচের আইডিয়া চমৎকার। ওদের স্কুলের টিমের ম্যাসকট হলো হর্নেট। চিয়ার লিডাররা বাস্কেটবল খেলা শুরুর আগে তাদের পারফরমেন্স করে। বিশেষ করে ফাইনালের দিন। অন্য স্কুলে ভেন্যু থাকলে দল বেঁধে সময় মতো ওরাও যায় কোচ ও অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচের তত্ত্বাবধানে।
বাস্কেটবল টিমের ক্যাপ্টেন ডেভিড। কো ক্যাপ্টেন হলো মীর্জা। গ্যাব্রিয়েল নামের এক সিনিয়রের সঙ্গে মারিয়া ডেটিং করছে। লুসির ভালো লাগে ডেভিডকে। কিন্তু ডেভিডের আবার ভালো লাগে স্ট্যাফেনিকে। সেদিন ওদের খেলা ছিল ফোর্ট হ্যামিলটন স্কুলের সঙ্গে। দুই বাসে ওরা ফোর্ট হ্যামিলটন স্কুলে গিয়ে পৌঁছাল। খেলায় ডেভিডকে ফাউল করলে ডেভিডের হাতে চোট লাগল। খেলা শেষ হওয়ার আগেই ডেভিডকে কনি আইল্যান্ড হসপিটালে যেতে হলো। ডেভিডকে লুসি আর মারিয়া সঙ্গে নিয়ে গেল। এক্স-রে করে হাত ব্যান্ডেজ করে দিল ডাক্তার। পরে ডেভিডকে ওর বাসায় ওরা নামিয়ে দিয়ে গেল। দুই দিন পর স্কুলে গিয়ে থার্ড পিরিয়ডে কেমিস্ট্রি ক্লাসে ডেভিডের পাশে বসল লুসিফার।
-কেমন আছ? হাত কেমন?
ডেভিড বারবার বলল
-তোমরা অনেক ভালো। আমি আর আমার প্যারেন্টস তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। যদি তুমি রোববার একবার আস আমাদের বাসায় খুব খুশি হব।
-আচ্ছা
স্কুল থেকে বাসায় গিয়ে লুসিফার অনেকক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখে। সে রোববারে একটা সুন্দর সাদা টপস আর জিনস পরে ডেভিডের বাসায় গেল। বাসায় ডেভিডের মা লিন্ডা ছিলেন। ওকে হাত ধরে নিয়ে সোফায় বসালেন। ডেভিডের বোন কারিনা আবার এনার বন্ধু। সেও এসে বসল। ডেভিডের বাবা ডেন্টিস্ট মি. মরিস। মি. মরিস ফিরতেই ডিনারে বসল সবাই। শুরু করার আগে প্রভু বন্দনা করলেন ওর মা লিন্ডা। এটা ওদের রেওয়াজ।
-তোমার কি খাবার ভালো লাগছে? লিন্ডা জিজ্ঞেস করেন।
-হ্যাঁ। ‘পটেটো স্যুপ উইথ টমেটো অ্যান্ড চিজ’ খুব ভালো হয়েছে। আমার মাও এটা খুব ভালো বানাতে পারেন।
‘গার্লিক ব্রেড আর চিকেনও’ আমার পছন্দ ।
‘আইসক্রিম আর ব্রাউনিস’ খেয়ে ওরা হাঁটতে বের হলো।
-আবার এসো বলে বিদায় দিলেন ওর বাবা-মা।
ওশেনপার্কওয়ের একটা বেঞ্চে এসে বসল দুজনে।
-এক সপ্তাহ আমি রেস্টে থাকব। খেলতে পারব না। ডেভিড বলল।
-এক সপ্তাহ তাহলে আমিও রেস্ট নেব।
কিছুটা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ডেভিড লুসির দিকে। তখন
লুসি ওকে কিস করে। হতবাক হয়ে যায় ডেভিড। লুসিফার ওর নীল চোখের দ্যুতি ছড়িয়ে সোনালি চুল দুলিয়ে চলে গেল। ডেভিড কেমন যেন মায়ায় জড়িয়ে গেল। স্ট্যাফেনিকে আর লুসিফারকে নিয়ে ভাবতে থাকে। কেন যেন এই মেয়েটিই টানে বেশি। এর সোনালি চুল আর মিষ্টি হাসি বেশি আকর্ষণীয়।
পরদিন স্কুলে মারিয়া আর স্ট্যাফেনি এক সঙ্গে বসেছিল। ডেভিড এল। স্ট্যাফেনি উঠতে চাইলে মারিয়া বলল
-তুমি বসো। গ্যাব্রিয়েল আসবে। আজ আমরা বাইরে যাব। গ্যাব্রিয়েল নতুন গাড়ি কিনেছে। ও আমাদের ট্রিট দিতে চেয়েছে। ওই সময় জন আর নিকোলাস এল।
-হেই। হোয়াটস আপ?
-ভালো। ভালো।
ভর ভর করে মারিজুয়ানার গন্ধ বের হচ্ছে ওদের মুখ থেকে। মারিজুয়ানার গন্ধ পেয়ে মারিয়া ও স্ট্যাফেনির মুখে ও কপালে ভাঁজ। ওদের চার চোখ মিলতেই চোখ টিপে কাঁধ ঝাঁকালো। নিকোলাসের বাবা-মা ইতালীর মিলান থেকে আসা। নিকোলাসের বাবা বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। নিকোলাস মার্সিডিজ গাড়ি নিয়ে স্কুলে আসত। কিন্তু হঠাৎই ব্যবসায় লস হওয়ায় ওর বাবা হার্ট আ্যটাকে মারা যায়। তারপর থেকে নিকোলাস স্কুলে অনিয়মিতভাবে আসে। ও বেশ বদলে গেছে মনে হলো। জন হলো আফ্রিকান-আমেরিকান। ওর গ্র্যান্ড প্যারেন্টস এ দেশে এসে ইস্ট নিউইয়র্কের ফ্লাটবুশ এলাকায় বাড়ি কেনে। জন আগে এডওয়ার্ড মুরো হাইস্কুলে ছিল। ওখান থেকে ট্রান্সফার নিয়ে আব্রাহাম লিঙ্কনে আসে। সাদা নিকোলাসের সঙ্গে কালো জনের দারুণ বন্ধুত্ব। ওদের চলাফেরা একটু আলাদা। ওরা খেলাধুলা করে না।
একদিন জন আর এনাকে একসঙ্গে ব্রুকলিন বোটানিক গার্ডেনে ঘুরতে দেখল লুসিফার আর মারিয়ানা। সেদিন ছিল চেরি ব্লসম। পুরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে গোলাপি আর সাদা চেরির আলোকচ্ছটা। আর এনা জনকে জড়িয়ে ধরে হাঁটছিল।
ক্লাসরুমে একটা টেস্ট চলছে। জন আর নিকোলাস মারিয়ার কাছে সাহায্য চায়। মারিয়া নিকোলাসকে সাহায্য করে। জন মারিয়ার ওপর খেপে যায়। বাইরে বের হয়ে তুমুল ঝগড়া হয়ে যায়। গ্যাব্রিয়েল এসে জনকে ধাক্কা মারে। জন আর নিকোলাসকে সিকিউরিটি এসে টেনে সরিয়ে দেয়। প্রিন্সিপাল ওদের সাসপেন্ড করেন।
লুসিফার, এনা, মারিয়া, ডেভিড আজ চিয়ার লিডারদের প্র্যাকটিসের পর স্কুলের জিমে বসে আছে। ওদের সঙ্গে কারিনা আর কেভিন চেন এসে যোগ দিল। কারিনা থাকে বুশউইকে। আর কেভিন থাকে চায়না টাউনে। পরদিন ওদের ফাইনাল খেলা ব্রঙ্কস হাই স্কুলের সঙ্গে। চিয়ার লিডারদের পারফরমেন্স খুব ভালো হলো। হলুদ রঙের দুটো স্কুল বাসে করে ওরা গিয়ে ছিল। খেলায় ব্রঙ্কস হাই স্কুলের সঙ্গে ওরা জিতে গেল। চিয়ার আপ গ্রুপের সবাইকে নিয়ে ছবি তুললেন কোচ গ্রাহাম। খেলোয়াড়দের নিয়েও ছবি তুললেন। স্কুলে আনন্দ বন্যা। প্রিন্সিপাল, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রিন্সিপাল সবাই অনেক অভিনন্দন জানালেন। সবাই খুব আনন্দিত। স্কুলের জিমনেশিয়ামে বেলুন দিয়ে সাজানো। টেবিলে খাবার-দাবার। বেশ হইচই। এ বছর ওরা গ্র্যাজুয়েশন করে চলে যাবে। তাই কিছুটা স্মৃতি কাতর সবাই।
টপটপ করে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। গ্যাব্রিয়েলের পায়ে গুলি লেগেছে। ওর সঙ্গে থাকা সবাই দৌড়ে বের হয়ে গেল ইউটার্ন করে। সবার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বাথরুমের কাছে এসে পড়ে গেল গ্যাব্রিয়েল। পাশে থাকা জ্যাকসন আর জিম দুজনে ধরে ওয়াশরুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল। ওয়াশ রুমের ভেতরে ওরা পাঁচজন । তিনজন ছেলে আর দুজন মেয়ে। মিরা আর জ্যাকসন এই দুজনেই ধরে ওকে বাথরুমের বেসিনের পাশে শুইয়ে দিল। রক্ত বন্ধ করার জন্য পাশ থেকে বারবারা ওর স্কার্ফ দিল। সেটা শক্ত করে বেঁধে দিল ওরা। অনেকক্ষণ হুড়োহুড়ির শব্দ হলো। মাইক্রোফোনে ‘স্কুলের দরজা এখন বন্ধ’ ঘোষণা করলেন প্রিন্সিপাল।
কোনো সাড়া শব্দ নাই। শুধু একটা কল থেকে টুপটাপ পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। বাইরে ফায়ার বিগ্রেডের ছয়টা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। অ্যাম্বুলেন্স আছে। হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। বের হয়ে আসা ছেলে-মেয়ে সবাইকে রাস্তার উল্টো দিকে নিরাপদ জায়গায় জড় করে রাখা হয়েছে। মারিয়ানা লুসিফার কাঁদছে। কেউ কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কে গুলি করল? কাকে? কেন? কার গুলি লাগল।
খবর ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত। মা-বাবারা ছেলেমেয়েরা নিরাপদে আছে কিনা খোঁজ নিতে আসছেন। মারিয়া লুসিফারকে নিয়ে গেলেন মারিয়ার বাবা-মা। আস্তে আস্তে সব অভিভাবক তাদের বাচ্চা নিয়ে চলে গেলেন। ভেতরে ঢুকে পড়ার আগে এখন পুলিশ ডাকছে
-ভেতরে যারা আছ বের হয়ে আস? হাত ওপরে তুলে বের হয়ে আসো। একে একে বের হয়ে আসছে ছেলে মেয়েরা।
পুলিশ ভেতরে ঢুকে পড়ল। ওয়াশ রুম থেকে গ্যাব্রিয়েলকে উদ্ধার করে হসপিটালে পাঠানো হলো। নিকোলাস আর জনের সঙ্গে গুলি বিনিময়ের একপর্যায়ে জনের বুকে গুলি লাগল। জন মারা গেল। আর নিকোলাস আহত অবস্থায় ধরা পড়ল। এনার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কালো পোশাক পরা মারিয়া, লুসিফার, এনা গ্রেভইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে আছে।
এনার হাতে চেরি ফুল। জনের কবরে দাঁড়িয়ে ও জিজ্ঞেস করে,
-আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। তবু কেন তুমি এই কাজ করলে???