বিজয়পুরের মেয়ে

বদরগঞ্জ। এক স্টেশন পরই রংপুর। সেই বদরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার আব্দুল আলীম। তাঁর আদি বাড়ি বাগেরহাটের বিজয়পুর গ্রামে। এক যুগেরও বেশি চাকরি করছেন বাংলাদেশ রেলওয়েতে। গত এক বছর ধরে আছেন বদরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টারের দায়িত্বে। বাসা স্টেশনেরই কাছে রেলওয়ে কলোনিতে। হাফিজ, শিমুল ও পলাশ এই তিন সন্তানের সুখী সংসার আলীম দম্পতির। বড় ছেলে হাফিজ রংপুর কারমাইকেল কলেজ, বড় মেয়ে শিমুল রংপুর মেডিকেল কলেজ, আর ছোট মেয়ে পলাশ বদরগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলে পড়ে। ছোট মেয়েটি এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
খাবার টেবিলে বসে সকালের নাশতা করছিলেন আব্দুল আলীম। পাশের চেয়ারে বসে আছেন স্ত্রী উম্মে হাবিবা। খাওয়া শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে প্রতিদিন চা দিয়ে যায় শিমুল। মাঝে মধ্যে পলাশও এ কাজটি করে থাকে। তবে শিমুলের হাতের চা বাবার খুব পছন্দ।
প্রতিদিন সকাল সাড়ে নয়টায় বদরগঞ্জে একটি ট্রেন আসে দিনাজপুর থেকে। ট্রেনটি যায় রংপুর হয়ে লালমনিরহাট। এই ট্রেনেই কলেজে যায় দুই ভাইবোন হাফিজ ও শিমুল। হাফিজ কারমাইকেলে এবং শিমুল যায় রংপুর মেডিকেল কলেজে। কলেজে যাবার আগে বাবাকে চা বানিয়ে দেওয়া শিমুলের রোজনামচারই একটা অংশ। আজ বাবার জন্য চা নিয়ে এল পলাশ। পলাশকে চা আনতে দেখে বাবা আবদুল আলীম স্ত্রী হাবিবাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বেলা নয়টা বেজে গেল, ওরা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি? ট্রেনতো এখনই এসে পড়বে?’
‘টের পেলাম হাফিজ উঠেছে। শিমুল বলছিল, ওদের কলেজ গেটে নাকি গতকাল কয়েকটা বাঙালি ছেলে এক বিহারি ছেলেকে পিটিয়েছে। তার জের ধরে আজকেও বাঙালি-বিহারি কোনো সংঘর্ষ বাঁধতে পারে? তাই বলছিল, আজকে সে কলেজে যাবে না’, জবাব দিলেন হাবিবা।
‘তাই নাকি? দেশের রাজনৈতিক যে দুরবস্থা; জানি না কী হয়..।’
মায়ের কথা শুনে বাবার টেবিলে চা রেখেই লাফাতে লাফাতে পলাশ শিমুলের রুমে গেল। শিমুল কেবল বিছানা ছেড়ে টুথব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে বাথরুমের দিকে যাচ্ছিল। তাকে সামনে পেয়েই পলাশ শিমুলকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপু তুই নাকি আজ কলেজে যাবি না? আমাদের স্কুলে আজ একটা অনুষ্ঠান আছে। আমাদের পরীক্ষার্থীদের বিদায় সংবর্ধনা। সেখানে অনেকের মা-বাবা, ভাইবোন আসবে। বাবাকে বললাম; তিনি যেতে পারবেন না। মাও যাবেন না। তুই তো আজ কলেজ যাচ্ছিস না, নে চল না আমার সাথে।’
সকালের নাশতা খেয়ে দু বোন অনুষ্ঠানে পৌঁছাল। অনুষ্ঠানে নাচ-গান-কৌতুক-আবৃত্তি—অনেকে অনেক কিছু উপস্থাপন করল। কিছুক্ষণ পর ঘোষণা এল, সুধী মণ্ডলী এবার আপনাদের সামনে সংগীত পরিবেশন করবেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ছাত্র মোহাম্মদ হাসান জাহিদ।
পল্লি গানের বিখ্যাত শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান, ‘আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি প্রাণ কোকিলা রে’, গানটি গেয়ে দর্শক শ্রোতাদের মন কেড়ে নিল হাসান। গান শুনে শ্রোতা দর্শক করতালিতে হল কাঁপিয়ে তুলল। অনেকে মন্তব্য করল, কণ্ঠে যেন অবিকল আব্বাস উদ্দিন। শ্রোতাদের অনুরোধে আরও দুটো গান পরিবেশন করল হাসান।
অনুষ্ঠান শেষে শিমুল পলাশ দু বোন বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে আছে রিকশার অপেক্ষায়। এমন সময় হাসানও বেরিয়েছে স্কুল থেকে। হাসান শিমুলের মুখোমুখি হতেই শিমুল তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়েন বুঝি?’
একটি সুন্দরী মেয়ের হঠাৎ এমন প্রশ্নে হাসান প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। নিজেকে সামলে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ।’ সেও পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কেন বলুন তো?’
-না মানে, আমিও ওখানে পড়ি কিনা। গতকাল বিকেলে ক্লাস থেকে ফেরার পথে কলেজ গেটে যে গন্ডগোলটা দেখলাম, মনে হয় আমি আপনাকে সেখানে দেখেছি?
-ও তাই বুঝি? আপনি কোন ইয়ারে?
-ফার্স্ট ইয়ারে।
-আমি সেকেন্ড ইয়ারে। আমরাই তো মেডিকেলের প্রথম ব্যাচ।
-সত্যিই চমৎকার গেয়েছেন। আপনার গান শুনে হল ভর্তি মানুষ কিভাবে উজ্জীবিত হলো! অপূর্ব গান আপনি।
গান হাসান মাঝেমধ্যে স্কুল-কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেয়ে থাকে। সামনাসামনি কোনো মেয়ের কাছ থেকে এমন প্রশংসা এই প্রথম। এমন প্রশংসায় সে যেন একটু আবেগে আপ্লুত হয়ে হারিয়ে গেল অন্য জগতে। তার সে ভাবটা যেন শিমুল টের পেয়ে গেল। সে আবেগ থেকে স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে সে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, গতকালকের ঘটনাটা কি?’
-আর বলবেন না। শালা বিহারির বাচ্চা, পাকিস্তানি দালাল। বলে কিনা, ‘হাতমে ছড়ি মুমে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।’ আমাদের সাথেই পড়ে। নইলে দিতাম পাঠিয়ে একেবারে গোরস্থানে। আপনি এই দিকে থাকেন বুঝি?
-জি। আমার ছোট বোন এবার এসএসসি দিচ্ছে। ওর নাম পলাশ।
পলাশ এ সময়ে স্কুল চত্বরে একটি কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কয়েকজন মেয়ের সাথে গল্প করছিল। সেদিকে তর্জনী উঁচিয়ে দেখাল শিমুল, ‘ওই যে কাঁঠাল গাছতলে ক’জন মেয়ে গল্প করছে, আসমানি রঙের কামিজ আর সাদা সালওয়ার পরা মেয়েটি আমার বোন, পলাশ।’
-ও আচ্ছা। আপনাদের বাসা তাহলে এখানেই?
-জি, রেলওয়ে কলোনিতে আমাদের বাসা। বাবা এখানকার রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার।
-আপনাদের বাসাও কি এখানে?
-না । আমাদের বাসা রংপুর, আলমনগর। মামাবাড়ি এখানে। মামাতো বোন পরীক্ষা দিচ্ছে। মামিমা বললেন, চল হাসান বিদায় সংবর্ধনা দেখে আসি। তাই এলাম।
-কী নাম আপনার বাবার?
-আব্দুল আলীম।
হাসান বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘আব্দুল আলীম? আপনারা কি আগে সৈয়দপুর ছিলেন?
-জি।
-বলেন কী? আপনার ভাইয়ের নাম কি হাফিজ?
-আপনি আমার ভাইয়াকে চেনেন?
-চিনি মানে, আমরা তো এক সময়ে বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম। আপনাদের বাসা ছিল রেলওয়ে মাঠের পূর্ব দিকে আতিয়ার কলোনিতে। আপনার বাবা তখন সৈয়দপুর স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার। কী ঠিক বলিনি?
-ও মাই গড! আপনি দেখি আমাদের পরিবারের আদ্যোপান্ত জানেন।
-আমি তখন আলমনগর হাইস্কুলে ক্লাস টেনের ছাত্র। একবার স্কাউট ক্যাম্পিংয়ে গিয়েছিলাম সৈয়দপুর। আমাদের ক্যাম্পিংটি ছিল রেলওয়ে মাঠে। আমাদের স্কুলের দলপ্রধান ছিলাম আমি, আর সৈয়দপুর রেলওয়ে হাইস্কুল দলের প্রধান আপনার ভাই হাফিজ। সে সময়ে হাফিজের সাথে রেললাইন পার হয়ে মাঝে মাঝে আপনাদের বাসায় যেতাম। সে তো রংপুর কারমাইকেলে পড়ছে তাই না? অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিল। হঠাৎ কবে যেন তা বন্ধ হয়ে গেল। হাফিজকে আমার কথা বলবে তো? এই যা, আপনাকে আমি তুমি বলে ফেললাম।
শিমুল হেসে বলল, ‘ঠিক আছে। আপনি তো আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। তা ছাড়া বয়সেও বড়। আপনি না বলে তুমি বলা অযৌক্তিক নয়।’
এমন সময় হাসানের মামি ও মামাতো বোন স্কুল থেকে বেরিয়ে এল। মামি বললেন, ‘কিরে চ্যাংরা তুই এইখান বসি গল্পে আছিস, আর হামরা তোমাক সারা ইস্কুল খুঁজি বেড়ি। হাঁটো বাহে বাড়িত যাই।’
-মুইও খুঁজি বেড়ি তোমাক না পাই গেটোত আসি দাঁড়ায় আছো। মামিমা তারার নাম শিমুল। হামার ইস্কুল লাইফের বন্ধু হাফিজের বইন।
মামি শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাই? তোমাদের বাসা এখানে বুঝি?’
-হ্যাঁ, চলেন আমাদের বাসা থেকে বেড়িয়ে যাবেন।
-না আরেক দিন যাব ।
মামিকে উদ্দেশ্য করে হাসান বলল, ‘মামিমা, তোরা রিকশাত চড়ি বাড়িত যান। মুই টাউন থাকি একটু বেরি আসি।’
মামি ও মামাতো বোনকে একটি রিকশা ঠিক করে দিয়ে সে নিজের মোটরসাইকেলের গিয়ারে চাপ দিল। সাইকেলটি ভোঁ ভোঁ করে উঠল। মুহূর্তে সে চোখের আড়াল হয়ে গেল। যাবার সময় হাত নেড়ে শিমুলকে জানিয়ে গেল, ‘আল্লাহ হাফিজ।’
রংপুর আলমনগরের ছেলে হাসান জাহিদ। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সে সবার ছোট। বাবা জাহিদ আহমেদ তামাকের আড়তদার। হাসান বিড়ি নামে তাদের একটি বিড়ির ফ্যাক্টরিও আছে হারাগাছে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একক প্রতিনিধিত্ব লাভ করে। পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করে। ১ মার্চ ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিলেন।

সেদিন কলেজ থেকে বাসায় ফেরার জন্য রংপুর রেলওয়ে স্টেশনে হাফিজের অপেক্ষায় ওয়েটিং রুমে বসে আছে শিমুল। এমন সময় রং-তুলি ও একগাদা পোস্টারিং কাগজ বগল চাপা করে সেখানে উপস্থিত হলো হাফিজ।
এসব দেখে শিমুল তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া এসব কি?’
-দেশের পরিস্থিতি ভালো না। এখানে বলা যাবে না। চল বাসায় গিয়ে বলব।
বাসায় গিয়ে হাফিজ বলল, ‘বঙ্গবন্ধুর বাণী সংবলিত কিছু পোস্টার এগুলো বিভিন্ন জায়গায় পোস্টারিং করতে হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে আন্দোলন ছাড়া এ সমস্যার সমাধান হবে না। এমনকি যুদ্ধবিগ্রহও বাধতে পারে। আগামীকাল মেডিকেলে হাসানের সাথে যদি দেখা হয়, আমার সাথে দেখা করতে বলতে পারবি?’
দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেক কথা হলো। হাফিজ হাসানকে বলল, ‘শোন দোস্ত, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানকে শাসনের নামে শোষণ করে আসছে। তারা কথায় কথায় বলে আমরা মুসলমান। সব মুসলিম ভাই ভাই। ওরা শুধু কথার ফুলঝুরি ছড়ায়। আসলে তারা চায়, এ বাঙালি জাতিকে শাসনের নামে শোষণ করতে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিল। এখন পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় বলা যায় না। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে যোগাযোগ রাখার অঙ্গীকারে সেদিনের আলোচনা মুলতবি হলো।
এদিকে প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠকে ২ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হলো। ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের টনক নড়ে। ১৬ মার্চ ক্ষমতা হস্তান্তরের এক প্রহসনমূলক বৈঠক ডাকেন বঙ্গবন্ধুর সাথে। এ সময় জুলফিকার আলি ভুট্টোও উড়ে আসেন করাচি থেকে ঢাকায়। ২৪ মার্চ পর্যন্ত এ প্রহসনের বৈঠক চলে। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের ইঙ্গিত দিয়ে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন।
২৫ মার্চ দিবাগত রাতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি আর্মি ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙালিদের ওপর। চালায় গণহত্যা, লুটতরাজ। গভীর রাতে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার অপরাধ দেখিয়ে ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে নেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যা মোকাবিলার জন্য বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলল। পাকিস্তানি সেনারা সংখ্যায় অনেক, আর তারা ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। তাদের অস্ত্রের মুখে বাঙালিরা টিকে উঠতে পারল না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাঙালিদের সংগ্রামের প্রতি তাঁর সরকারের অকুণ্ঠ সহানুভূতি জ্ঞাপন করে পূর্ব পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিল। অত্যাচারিত ও ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালিরা দলে দলে সে দেশে যেতে লাগল। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারগুলো সীমান্ত বরাবর শরণার্থীশিবির স্থাপন করল। এই শিবিরগুলো থেকেই বাঙালিরা তাদের প্রিয় মাতৃভূমি রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করল।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্কুল কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে হাফিজ ও হাসান মহল্লার কয়েকজন যুবক ও কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ হাফিজদের বাসায় বৈঠক করল। সিদ্ধান্ত হলো তারা দিনাজপুরের ফুলবাড়ি সীমান্ত হয়ে ভারতে যাবে এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবে। তাদের সাথে শিমুলও যোগ দেওয়ার মনস্থির করলে হাফিজ তাতে আপত্তি করল।
শিমুল বলল, ‘ভাইয়া,আমি বিজয়পুরের মেয়ে। বাগেরহাটের বিজয়পুর আমাদের বাড়ি।’
-বিজয়পুর তাতে কি হয়েছে?
-বিজয়পুরের মেয়েরা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় না।
শিমুলের কথা শুনে হাফিজ হেসে উঠল। হাফিজের হাসিতে শিমুল রেগে গিয়ে বলল, ‘তুমি হাসলে যে, ভাইয়া? তা ছাড়া আমি একজন মেডিকেলের ছাত্রী। ডাক্তার না হলেও আমার মধ্যে ডাক্তারি বিদ্যে তো রয়েছে। তোমরা যুদ্ধ করবে রণাঙ্গনে, আর কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি তাকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলব। আমার ডাক্তারি বিদ্যেটুকু দেশের কাজে ব্যবহার করতে চাই। তুমি আপত্তি করো না ভাইয়া। আমাকেও তোমাদের সঙ্গে নিয়ে চল। আর এখানে থাকলে আমাকেও অন্যদের মতো পালিয়ে বেড়াতে হবে। পালিয়ে পালিয়ে বাঁচার চেয়ে দেশের সেবায় জীবন উৎসর্গ করে দেওয়াই উত্তম, আই অট টু লাভ মাই কান্ট্রি।’
এ সময় হাসান বলল, ‘শি ইজ রাইট। যেতে চাচ্ছে, যাক না।’
১৫/২০ জনের একটি দল ফুলবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর পৌঁছাল। সেখানে বালুবাড়ি শরণার্থীশিবিরে তারা অবস্থান করল। সেখানে গিয়ে সন্ধ্যারাণী নামের এক ক্লাসমেটের সাথে দেখা হলো শিমুলের। সন্ধ্যারাণী ও তার স্বামী সৌমিত্র সেখানে পৌঁছেছে তার দুদিন আগে। শরণার্থীশিবিরে আশ্রিতদের জন্য একটা প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। চিকিৎসা কেন্দ্রের পরিচালিকা শ্রীমতি অঞ্জলী দেবী শিমুল ও সন্ধ্যারাণীকে পেয়ে খুবই খুশি হলেন। তিনি তাদের সেখানে যোগ দিতে বললেন। হাসান, হাফিজ ও অন্যরা একটি আশ্রয়শিবিরে থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগ দিল।
বদরগঞ্জে হাফিজ শিমুলদের বাসায় তাদের মা-বাবার টিকে থাকাটা দায় হয়ে পড়ল। তাদের বাসায় রাজাকার পাক সেনারা কয়েক দফা লুটপাট করে তার মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাসা ছেড়ে তারা ছোট বোন পলাশকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে লাগল। অবশেষে চাকরি ছেড়ে পৈতৃক বাড়ি বিজয়পুর যাবার সিদ্ধান্ত নিল তারা।
কয়েক মাস প্রশিক্ষণ শেষে হাফিজ ও হাসান বীরদর্পে ফিরল দেশের মাটিতে। রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ৬নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন উইং কমান্ডার এম কে বাশার। হাফিজ ও হাসান তার সেক্টরে যোগ দিল। সারা দেশে তখন মুক্তিযোদ্ধারা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ শেষে বাংলার দামাল ছেলেরা ততক্ষণে নিজ নিজ এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধে শত্রুদের ওপর সর্বতোভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। হাসান ও হাফিজ তাদের নিজ এলাকা বদরগঞ্জ, চিলমারী, তারাগঞ্জ, চিকলী নদী প্রভৃতি অঞ্চলে শত্রু সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এলাকার রাজাকার পাক সেনারা হাসান হাফিজের নাম শুনলেই ভয়ে শিউরে উঠছে।
হাফিজ ফিরে এসেছে রণাঙ্গনে, আর শিমুল রয়ে গেছে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের পশ্চিম দিনাজপুরে শরণার্থী ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা কেন্দ্রে। শিমুলের সেবায় বহু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সুস্থ হয়ে উঠেছে, অনেকে আবার রণাঙ্গনে ফিরে গিয়েছে। দীর্ঘ আট মাস মা-বাবা ও একমাত্র আদরের বোন পলাশকে রেখে দুই ভাইবোন দেশের টানে দেশ ছেড়ে এ পরবাসে। কিছুদিন আগেও মাঝেমধ্যে ভাইয়ের সাথে দেখা হতো। আজ অনেক দিন হলো তা ও হচ্ছে না। সে আছে রণাঙ্গনে। মা-বাবা, আর ছোট বোনটার জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠল শিমুলের। মাত্র কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে তাদের বাসা। কয়েক দিন ধরে অঞ্জলি দেবীকে বলে আসছে মাত্র দুদিনের জন্য সে ছুটি নিয়ে মা-বাবা ও বোনের সাথে একবার সাক্ষাৎ করেই ফিরে আসবে। তিনি কিছুতেই তাকে দিতে ছুটি দিতে রাজি হচ্ছেন না। উল্টো বলছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে চারিদিকে পাক সেনা, আর রাজাকারদের আনাগোনা। সে সেখানে গেলে আর ফিরে আসতে পারবে না।’ এত বিপদের আশঙ্কা সত্ত্বেও মন মানে না শিমুলের। তার সঙ্গী হওয়ার জন্য সন্ধ্যারাণীসহ অনেককেই অনুরোধ করেছে। কিন্তু কেউই তার সঙ্গী হতে রাজি হয়নি। অবশেষে অসীম সাহস বুকে নিয়ে এক রাতের আঁধারে শিবির থেকে একাই পালাল শিমুল। সে শিবির থেকে পালালে যুদ্ধরত তার ভাই হাফিজকে ওয়ারলেস মাধ্যমে জানানো হয়।
নোংরা কাপড়, আর বোরকা পরে বুড়ির বেশে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর থেকে বাসে চড়ে সোজা ফুলবাড়ি সীমান্তে এসে নামল। ফুলবাড়ি থেকে পার্বতীপুর যাবে। সেখান থেকে বদরগঞ্জের সংযোগ ট্রেন পাওয়া যাবে। খুলনা থেকে ছেড়ে আসা চিলাহাটিগামী একটি ট্রেনে চেপে পার্বতীপুর পৌঁছাল শিমুল। ফুলবাড়ি স্টেশনে যখন ট্রেনের টিকিট নিচ্ছিল, তখন দুজন বিহারি মাহিলাও টিকিট নিচ্ছিল। মহিলা দুজন বারবার তাকে অনুসরণ করছিল। সে যখন ফুলবাড়ি থেকে ট্রেনে চড়ল, মহিলারাও তার সাথে একই বগিতে চড়ে কাছাকাছি আসন নিল। শিমুল ট্রেনে বসলে নোংরা কাপড় আর বোরকার নিচ থেকে পায়ের নখের টুকটুকে লাল নেলপালিশ, আর ফুটফুটে পদযুগল বেরিয়ে পড়ল খানিকটা। সে লক্ষ্য করল, তখন তারা তাকে নিয়ে নিজ ভাষায় বলাবলি করছে, ‘ও আওরাতকো দেখনেকে বুরহী লাগতি হ্যায়, ল্যাকিন উসকি নেলপালিশ অর পাওছে লাগতা হ্যায় ও বুরহি নেহি। হো সাকতা হ্যায় ও কই মুখবর হো?’ তাদের এ কানাঘুষা একসময়ে শিমুলের কানেও এসে পৌঁছাল।
কানাঘুষা শুনে শিমুলের সন্দেহ হলো। এরা কি সাধারণ যাত্রী নাকি গুপ্তচর? শিমুল পার্বতীপুরে নেমে গেলে তারাও সেখানে নেমে গেল।
পার্বতীপুর স্টেশনে বদরগঞ্জ ট্রেনের সংযোগ ট্রেনের অপেক্ষা করছিল শিমুল। এমন সময় হঠাৎ একজন আর্মি অফিসার ও জন তিনেক রাজাকার এসে তাকে ঘিরে ফেলল। সে বুঝতে পারল ওই মহিলা দুজন কোনো সাধারণ যাত্রী ছিল না। ছিল পাক আর্মির গুপ্তচর। পাক আর্মির কাছে ধরা পড়ে গেল শিমুল।
তাকে ক্যাম্পে নিয়েই বোরকা খুলে ফেলল। বোরকার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক সুন্দরী যুবতী। তাকে দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ক্যাম্পের সদস্যরা। শুরু হলো মারধর, ‘মাগি হিন্দুস্তানের দালাল, বল তোর মুক্তিরা কোথায়? বল বল তাদের আস্তানা কোথায়?’
-আমাকে আর মেরো না। আমি ছিলাম চিকিৎসা শিবিরের এক নার্স মাত্র। তাদের সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। দুধে আলতা মাখা রঙের শরীর থেকে যেন রক্ত ফুটে ফুটে পড়ছে। মারের একপর্যায়ে সে বেহুঁস হয়ে পড়ল। জ্ঞান ফিরলে তার ওপর আবারও চলল উৎপীড়ন। কিন্তু তার কাছ থেকে তারা আর কোন তথ্য পেল না। একপর্যায়ে তাকে দিগম্বর করে ফেলল তারা। এক রাজাকার বলল, ‘যা গোটা তিনেক ডিম সিদ্ধ করে নিয়ে আয়।’
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, ‘ওস্তাদ সিদ্ধ ডিম কি করবেন? ওকে খেতে দেবেন?’
-আরে শালা না। আগে আন তারপর দেখ। ও তো দূরের কথা ওর বাপ পর্যন্ত স্বীকার করবে সে কে? সে স্বীকার করবে তার মুক্তির বাবারা কোথায়? আরও জানবে পাকিস্তান ভাঙার পাঁয়তারাকারী হিন্দুস্তানের দালালদের কী পরিণাম?
-আমি বুঝেছি ডিম দিয়ে আপনি কি করবেন। না না ওস্তাদ ওই কর্ম করা যাবে না।
-তোর দেখছি ছেরির জন্য ম্যালা দরদ। ব্যাপার কি?
-দরদ ওর জন্য না, দরদ আপনার জন্য।
-আমার জন্য ক্যান?
-আজ রাতে ওকে তো ক্যাপটেন সাহেবের রুমে পাঠাতে হবে। জ্বলে পুড়ে ফোসকা পড়ে গেল ক্যাপটেন সাহেবের বিনোদনে ব্যাঘাত ঘটবে। আর তার বিনোদনে ব্যাঘাত ঘটলে আপনার খবর আছে?
হাফিজ গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর পেল পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশনে তার বোন ধরা পড়েছে। কয়েক দিন পরে খোলাহাটি রেলওয়ে স্টেশনের কাছে একটা ডোবায় নারী-পুরুষের অনেকগুলো ছিন্নভিন্ন লাশ আবিষ্কার করে গ্রামবাসী। তাদের মধ্যে শিমুলের লাশও ছিল।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় রমনার রেসকোর্সে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজী পাকিস্তান সরকারের পক্ষে আত্মসমর্পণ করেন। নিয়াজীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল। ভূমানচিত্রে জন্ম নিল নতুন একটি দেশ, বাংলাদেশ।
ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অভিযোগে হাসানের বাবা জাহিদ আহমেদকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি বাহিনী। তিনি আর বাড়িতে ফিরে আসেননি। সে সময় বাবাকে রক্ষা করতে গিয়ে মাও আহত হয়েছেন। আর হাফিজদের বাসা তালা বন্ধ। কেউ তাদের সঠিক সন্ধান দিতে পারল না। অবশেষে দুই বন্ধু সিদ্ধান্ত নিল তাদের সন্ধানে দাদাবাড়ি বিজয়পুরে যাওয়ার। হয়তো সেখানে তাদের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে?
হাফিজ ও হাসান বিজয়পুরে পৌঁছালে তাদের সাথে শিমুলকে না দেখে পলাশ জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া আপু কই? আপুকে না নিয়ে তোমারা একা ফিরে এলে যে? সে কোথায়?’
হাফিজের কাছে শিমুলের কাহিনি শুনে পলাশ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে হাফিজকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ তুমি কি বলছ ভাইয়া, আপুর জন্য আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমার আপুকে এনে দাও ভাইয়া, আপুকে এনে দাও।’ একপর্যায়ে পলাশ মূর্ছা গেল। সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হলো। কান্নার শোরগোলে স্বাধীনতার আনন্দ ম্লান হয়ে গেল।
হাফিজদের বাড়ি কয়েক দিন মেহমান থেকে একদিন হাসান তাকে বলল, ‘আর কত দিন তোদের এখানে থাকব? এবার তো আমায় ঘরে ফিরতে হয়। মাকে কথা দিয়ে এসেছি দিন কয়েক থেকে ফিরে যাব তার কাছে।’
-ঠিক আছে যাবি, কিন্তু তুই একা ফিরে যাবি? শিমুল দেশের জন্য শহীদ হলেও পলাশ তো রয়েছে। পলাশকে আমি তোর হাতে তুলে দিতে চাই। তুই তাকে সাথি করে সঙ্গে নিয়ে যা। পলাশ তোর পাশে পাশে থাকলে শিমুলের আত্মাটা হয়তো এতটুকু শান্তি পাবে। তেমনি শিমুলকে হারানোর ব্যথা কিছুটা হলেও ভুলতে পারবি। আর আমরাও দুটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বিনি সুতোয় বাঁধা রয়ে যাব চিরদিন।