জাতিস্মর

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মিলুদার সঙ্গে এইভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। সপ্তাহের কর্মদিবসগুলো আমার শুরু হয় খুব ভোরে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে সূর্য ওঠার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। ফিরতে ফিরতে আবার সন্ধ্যা হয়ে আসে। দুপুরের খাবারের বিরতিতে শুধুমাত্র গায়ে একটু সূর্যের আলো লাগে। তাই সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে সকালবেলায় না ঘুমিয়ে জোর করে ঘুম থেকে উঠে পড়ি শুধু সকালটা দেখার জন্য। প্রতিদিনই উঠে বাসার পাশের ড্রপওয়ালটাতে পা ঝুলিয়ে বসে থাকি। আমার পিঠের ওপর দিয়ে সূর্য ওঠে আর সেই আলোয় ধীরে ধীরে সামনের পাড়াগুলো আলোকিত হতে থাকে। একেবারে শুরুতে সবচেয়ে দূরের পাহাড়গুলোর চূড়ায় আলো দেখা যায়। তখন আমি বুঝে নিই সূর্য উঠেছে। দূর পাহাড়ের চূড়াগুলো থেকে আলোটা ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসে। সামনের বাড়িগুলোর টিনের চালে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে এক সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করে। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখি। তখন একেকটা টিনের চালাকে মনে হয় একেকটা ছোট সূর্য। আর কানে আসতে থাকে হাজারো পাখির কিচিরমিচির শব্দ। সেই সাত সকালেই সামনের শিল্প এলাকাটার কিছু কিছু চিমনি দিয়ে শুভ্র সাদা ধোঁয়া বের হতে থাকে। তখন আমার কাছে মনে হয় যেন সেগুলো একেকটা মেঘ তৈরির কারখানা। টুকরো টুকরো মেঘ চিমনির মুখ থেকে বেরিয়ে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে।

প্রতি শনিবার ও রোববার সকালেই আমার এই একই রুটিন। অবশ্য মাঝে মধ্যে আমার তাহিয়া উঠে পড়লে বাপবেটি মিলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। তারপর সারা পাড়াময় একটা চক্কর দিয়ে বাসায় ফিরি। অবশ্য ইদানীং সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোতে একটু আগে ভাগেই তাহিয়াকে উঠে পড়তে হয়। কারণ আমি ওদের কেয়ারে ড্রপ করে অফিসে যাই। তাই তাহিয়া শনিবার ও রোববারে একটু বেশি ঘুমাতে চায়। তবুও মাঝেমধ্যে উঠে পড়ে। ঘুমঘুম চোখে আমার পাশে ড্রপ ওয়ালে এসে বসে। আমরা দুজন কোনো কথা না বলে সামনের দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকি। মাঝেমধ্যে অবশ্য আমরা হাঁটতেও বের হই। এমনি একদিন হাঁটতে গিয়ে আমরা দুজন মিলে দুটো মরা শামুক কুড়িয়ে এনেছিলাম। তারপর তাহিয়া অনেক যত্ন করে তুলে রেখেছে সেগুলো। মাঝেমধ্যে আমরা কুড়িয়ে আনি বিভিন্ন রকমের ফুল। তারপর সেগুলো বাটিতে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখে দেয় তাহিয়া।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ইদানীং একা একাই ড্রপওয়ালের ওপর সকালবেলা বসে থাকি। মাঝেমধ্যে আমাকে সঙ্গ দেয় এক কাপ রং চা। বাসার অন্য সবাই ঘুমিয়ে থাকে। তাই মাইক্রোওভেনে এক কাপ পানি দিয়ে গরম করে নিয়ে তাতে একটা টি ব্যাগ দিয়ে একটু চিনি গুলিয়ে নিলেই চা তৈরি হয়ে যায়। কয়েক দিন আগে সেভাবেই চা নিয়ে বাইরে এসে দেখি ড্রপওয়ালের ওপর একজন ছোটখাটো মানুষ সুতির একটা পাঞ্জাবি পরে বসে আছেন। অস্ট্রেলিয়ার পঞ্জিকা অনুযায়ী তার আগের দিন থেকে বসন্ত কাল শুরু হয়েছে। তাই বাতাস তেমন একটা ঠান্ডা না। অনেকটা নাতিশীতোষ্ণ ভাব। আমি চায়ের কাপ নিয়ে তার পাশে বসতে বসতে তাকে চিনে ফেললাম। মিলুদা। আমার দিকে তাকিয়ে সেই পরিচিত নিষ্প্রাণ হাসি দিয়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হাসান কেমন আছ? আমি আমার অন্য সব সিনিয়রদের কাছ থেকে তুই শুনতেই অভ্যস্ত। কিন্তু মিলুদা আমাকে তবুও তুমি বলেই সম্বোধন করেন।

আমি বললাম মিলুদা তুমি কোথা থেকে।

মিলুদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সাত সমুদ্র তেরো নদীর এই পারেও তোমার এই প্রকৃতি প্রেম দেখে তোমাকে সঙ্গ দিতে চলে আসলাম।

বললাম, মিলুদা তুমি অসময়ে কেন চলে গেলে। তোমার কাছে কত কী পাওনা ছিল আমাদের?

: সেটাতো তোমরা বুঝেছ। কিন্তু আমার জমানায় আমি যে পরিমাণ নিগ্রহের শিকার হয়েছি সেটাতো তোমার অজানা নয়।

: সেটাতো জানি। তাই বলে তুমি অকালে কেন চলে গেলে? কাকিমার সেই অমর কবিতা কি তোমাকে একটুও মোটিভেট করতে পারেনি?

: সবই ঠিক ছিল বুঝলে, কিন্তু কবিতাতো আর সের দরে বিক্রি করে তেল নুন চাল কেনা যায় না। তোমার ক্ষুধা কীভাবে নিবারণ হতো বলত?

: তাও ঠিক কিন্তু তুমি বেঁচে থাকলে আমার খুব উপকার হতো জানো?

: তা হতো কিনা জানি না। কারণ তুমি তো আমার কবিতা পড়তে না?

: ওই বয়সে তোমার কবিতার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝতাম না। একই লাইনের তিন চার রকমের অর্থ হতো। তাই আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।

: আমার মনে হয় লেগে থাকলে তুমি পারতে। কারণ তোমার আর আমার শৈশব একই আদলে গড়া।

: তা ঠিকই বলেছ। পদ্মার চরে জন্ম আমার। তাই মাটির খুব কাছাকাছি থেকে বেড়ে ওঠা। প্রকৃতির রূপ রস গন্ধের স্বাদ পুরোপুরিভাবে নিতে পেরেছি। কিন্তু ঘটনা কী জানো, কাকিমা মানে তোমার মা যেমন চুলার পাশে বসেও কাব্য রচনা করতেন, আমার মা সেই সুযোগটা পাননি। একান্নবর্তী পরিবারের একগাদা লোকের রান্নাবান্না করতেই দিন শেষ হয়ে যেত। আমরা মাকে কাছে পেতাম শুধু ঘুমাতে যাওয়ার সময়। তখন আমরা দুই ভাই মারামারি শুরু করে দিতাম কে মায়ের কোন পাশে ঘুমাব সেটা নিয়ে। আর প্রাণভরে মায়ের শরীরের ঘ্রাণ নিতাম। তারপর মা আমাদের দুই ভাইকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কিচ্ছা (গল্প) বলা শুরু করতেন। আমরা মার কিচ্ছা শুনতে শুনতে রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে যেতে যেতে ঘুমিয়ে পড়তাম। আমরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই মায়ের দিন শুরু হয়ে যেত। রাতে আবার মায়ের সঙ্গে দেখা হতো।

: তাহলে তো তুমি তোমার শিল্পবোধের প্রথম পাঠটা পেয়েছ তোমার মায়ের কাছ থেকে।

: সেটা ঠিক বলেছ। আমার এখনকার যত চিন্তাভাবনা সবই তখনকার তৈরি। জানো মিলুদা তোমার আর আমার মতো শৈশব আর কৈশোরের স্মৃতি আছে আরও একজন মানুষের। ওনার নাম স্বপন। আমি ডাকি স্বপন ভাই বলে। ওনার সঙ্গে যখন গল্প করি তখন তোমার শৈশব কৈশোর আর লেখালেখি নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়। উনি তোমার সম্বন্ধে জানেনও প্রচুর।

: বল কী! তাহলে তো একদিন তার সাথে আলাপ করতে হয়।

: তুমি একদিন শুক্রবার বিকেলে আস, ওনার বাসায় নিয়ে যাব। ভাবি খুব চমৎকার পেঁয়াজি বানাতে পারেন। চা আর পিঁয়াজির দারুণ সমন্বয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।

: জানো কত দিন বরিশাল যাই না। সেই কীর্তনখোলা নদী, সেই লঞ্চঘাট সবই এখন স্মৃতি।

: জানো তো আমাদের গাঁয়ের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে প্রমত্তা পদ্মা নদী। সেই নদীর ঘাটে নৌকা বাঁধা থাকত পারাপারের জন্য। শহরে কাউকে খবর দেওয়া লাগলে আমরা নদীর ঘাটে গিয়ে বসে থাকতাম। পরিচিত কেউ শহরে গেলে তাকে খবরটা দিয়ে দিতাম। তিনি শহরে গিয়ে সেই লোকের সঙ্গে দেখা করে খবরটা দিয়ে আসতেন। এমনকি নদী ভাঙনের পর আমরা যখন শহরে চলে আসলাম তখন পর্যন্তও একইভাবে খবর আদানপ্রদান করা হতো। আব্বা গড়াই নদীর ঘাটে এসে শহর থেকে ফিরছে এমন কারও কাছে খবরটা দিয়ে দিতেন। তিনি গ্রামের বাড়িতে খবরটা পৌঁছে দিতেন। তবে সব সময় যে সময়মতো পৌঁছাত এমন কিন্তু না। হয়তো বা সেই লোক ভুলে যেতেন। আমার এসএসসি পাশের খবর আব্বা একজনকে দিয়েছিলেন। তিনি তিন দিনেও খবর পৌঁছে দেন নাই দেখে গ্রামের বাড়ির সবাই ধরে নিয়েছিল আমি বোধ হয় ডাল মেরেছি মানে ফেল করেছি।

আমার এই কথাটা শুনে মিলুদা একটু হাসার মতো ভঙ্গি করলেন। আসলে মিলুদার জীবনটা এত বেশি কষ্টের ছিল যে তার হাসিটা আমার কাছে আরও বেশি করুণ মনে হয়। আমার কাছে তার যত ছবি আছে সবগুলোতেই উনি কেমন যেন স্বভাবসুলভ গম্ভীর। আর চোখের ভাবটা কেমন উদাস। যেন ওনার শরীরটা শুধুমাত্র সেইখানে আছে কিন্তু মনটা অন্য কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মিলুদা বললেন, জানো আমারও খুবই মায়ের কথা মনে পড়ে। সেই কুপিবাতির অতিপ্রাকৃত আলোয় দেখা মায়ের মুখখানি এখনো আমাকে তাড়া করে ফেরে। সেই মাটির চুলা, খড়কুটোর আগুন সবই কেমন জানি জীবন্ত লাগে আমার কাছে। পরবর্তী জীবনের এত চড়াই-উতরাই পার হয়েছি শুধু মায়ের মুখটা কল্পনা করে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

: মিলুদা তুমি আমার মনের কথা বললে। মা যখন খুব ভোরে উঠে চুলাতে রান্না বসাতে যেতেন, আমি মাঝেমধ্যে টের পেয়ে যেতাম। তখন মা আমাকে চুলার পাশে বসিয়ে দিতেন। আমি বসে বসে মায়ের রান্না দেখতাম। চুলার আগুনের আলোয় মাকে ভিনগ্রহের কেউ বলে মনো হতো। বিশেষ করে শীতকালে পিঠাপুলির সময়ে আমি চুলার পাশে বসে মায়ের হাতে পিঠা বানানো দেখতাম। আব্বার লুঙ্গিটাকে পেঁচিয়ে গলার কাছে গিট্টু দিয়ে একটা ওভারকোটের মতো বানিয়ে দিতেন। তারপর চুলার পাশে বসে থাকতাম যতক্ষণ না সকাল হতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ঘটনাগুলো আমার অবচেতন মন এতটাই মনে রেখেছে যে, এখনো আমি বাড়িতে গেলে সকালবেলা উঠে মায়ের সঙ্গে চুলার পাশে গিয়ে বসি। শুরুতে মা বলতেন, অনেক রাতে ঘুমিয়েছ যাও আরও একটু ঘুমিয়ে নাও। পরে যখন মা বুঝল এটাতে আমি অনেক আনন্দ পাই তখন আর কিছু বলতেন না।

: জানো আমি যখন বাধ্য হয়ে কলকাতায় থাকা শুরু করলাম তখনো কিন্তু সব সময় মনেপ্রাণে বাংলাদেশের কথা ভাবতাম। আমার কবিতা, উপন্যাস সবকিছুতেই ছিল বাংলাদেশের প্রকৃতি আর পরিবেশ। আমার দেহটা শুধু কলকাতার পথে প্রান্তরে ঘুরে বেরিয়েছে কিন্তু মনটা ছিল বাংলাদেশেই।

: মিলুদা তুমি কাকে এই কথা বলছ। আমারও একই অবস্থা। আমিতো সিডনির রাস্তাঘাটে চলে ফিরে বেড়াচ্ছি কিন্তু সবকিছুর মধ্যে বাংলাদেশের প্রকৃতি আর পরিবেশের মিল খুঁজে পাই। এই যে সকালবেলা উঠে ড্রপওয়ালে বসে দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকি। জানো কার কথা ভাবি? ভাবি আমার কৈশোরের কথা। আমরা বন্ধুরা মিলে ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ির পেছনের মাঠে গিয়ে বটগাছের গাড়িতে সবাই গোল হয়ে বসে আড্ডা দিতাম যতক্ষণ পর্যন্ত না সূর্যের দেখা পেতাম। একইভাবে বিকেলবেলা আসরের নামাজ পড়েও মাঠে গিয়ে মাগরিবের আজান না দেওয়া পর্যন্ত। সেই অভ্যাসটা এতটাই পাকাপোক্ত ছিল যে এখন পর্যন্ত ছাড়তে পারিনি। এই যে ছুটির দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে জোর করে উঠে ড্রপওয়ালে বসে থাকি সেই একই কারণে। আমি কল্পনায় দেখতে পাই বিদ্যুৎ, সালাম, শংকর, জাহিদ নানা আমরা সবাই মিলে আমাদের বাড়ির পেছনের মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আচ্ছা মিলুদা তুমি যে বলেছিলে—‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শাঁখচিল শালিকের বেশে,/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।/ হয়তো বা হাঁস কোনো-কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে লাল পায় সারা দিন কেটে যাবে কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।’

কিন্তু তুমিতো আর ফিরে আসোনি। আমি তোমার এই কবিতাটা পড়ার পরে মনে মনে তোমায় কত খুঁজেছি।

: কে বলল আমি ফিরে আসিনি। আমিতো আসলে তোমাদের মধ্যে থেকে হারিয়েই যাইনি কখনো। এই যে তোমরা আজ বাংলার প্রকৃতি নিয়ে ভাব, এমনকি বাংলাদেশে থেকেও এত দূরে থেকে সবকিছুর মধ্যেই দেশের ছোঁয়া খুঁজে পাও এই অনুভূতিটাই তো আমি। আর গ্রাম বাংলার মায়েরা যত দিন তাদের ছেলেদেরকে পড়ে শোনাব—‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ ততবারই আমি মায়ের কোলে কোলে ফিরে আসি।

: তার মানে তুমি পুনর্জন্মে বিশ্বাসী বলছ?

: সেটা বলা মুশকিল কেন জান? কারণ মানুষ একেক বয়সে একেক রকম জিনিস বিশ্বাস করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বিশ্বাস পরিবর্তন হয়। যা হোক আমি নিভৃতচারী মানুষ। সাধারণত এত কথা বলি না। কিন্তু তোমার প্রকৃতি প্রেমটা আমি লক্ষ্য করছিলাম বহুদিন ধরে। তাই ভাবছিলাম তোমার সঙ্গে একদিন আলাপ করব। শোনো এই তোমার দেখা ও শেখা, এগুলোই মানব জীবনের আসল অর্জন। খিদে পেলেতো সব মানুষই খাবার খায়। কিন্তু পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই মনের খিদেটা আবিষ্কার করতে পারে না তার আগেই মারা যায়। তোমার মনের মধ্যে যে ক্ষুধা তৈরি হয়েছে সেটা ধরে রাখ। দেখবে জীবনটাকে তখন আর বোঝা মনে হবে না। কারণ প্রতিদিনই তুমি নতুন নতুন জিনিস দেখবে ও সেখান থেকে শিখবে। এই অস্ট্রেলিয়াতে কত দেশের মানুষ বাস করে। তোমার তো সেই সব দেশে বেড়াতে যাওয়ার সামর্থ্যও নেই। কিন্তু তুমিতো তাদের সঙ্গে কথা বলতে পার। তাদের সঙ্গে কথা বললে তাদের দেশের প্রকৃতি, পরিবেশ, ইতিহাস ও সংস্কৃতি সবকিছুর সম্বন্ধে ধারণা পাবে। তাই মানুষের সঙ্গে মেলামেশার এই অভ্যাসটা আমৃত্যু ধরে রেখ।

একদমে এ কথাগুলো বলে মিলুদা একটা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। মিলুদার সঙ্গে কথার শুরুতে আলাপ হচ্ছিল ছাড়া ছাড়াভাবে। কারণ তার স্বভাবটাই এমন আমি জানতাম। তাই আমি শুধু আমার কথাই বলে যাচ্ছিলাম। অবশেষে মিলুদা মনের গহিনের কথাগুলো বলে ফেললেন। তাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে, কথাগুলো বলতে পেরে যেন তার বুক থেকে বিশাল বোঝা নেমে গেল।

: আচ্ছা মিলুদা তুমি ইদানীং কীভাবে সময় পার করো?

: আমি কলকাতার রাস্তায় যেভাবে আনমনে হেঁটে বেড়াতাম এখনো সেভাবে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় আনমনে হাঁটি আর তোমার মতো কোনো প্রকৃতি পাগল লোকের সঙ্গে দেখা হলে আলাপ জুড়ে দিই।

এ কথা বলে তিনি ড্রপওয়াল থেকে উঠে পড়লেন। তিনি ধীর পায়ে হেঁটে মূল রাস্তার দিকে যাচ্ছেন আর আবৃত্তি করছেন—‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,/ সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে...।’

আমি তার চলে যাওয়া পথের দিকে অপলক তাকিয়ে আছি যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেলাম মেয়ে তাহিয়ার ডাকে। বাবা, তুমি আজও আমাকে না ডেকে একা একাই উঠে এসে বসে আছ?

মো: ইয়াকুব আলী: মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: