আমি ও সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক

সাহিত্য একাডেমি িনউইয়র্কের ৯৮তম আসরে লেখক ও সাহিত্যিকেরা
সাহিত্য একাডেমি িনউইয়র্কের ৯৮তম আসরে লেখক ও সাহিত্যিকেরা

আজ থেকে অনেক বছর আগে বেশির ভাগ বাবা-মায়ের মতো আমার বাবা-মারও স্বপ্ন ছিল তাঁদের মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। তাঁদের মনোবাসনা রক্ষার্থে আমি বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা শুরু করি। মাঝরাতের অখণ্ড নীরবতায় কিংবা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যখন আমার সহপাঠীরা মনোযোগ দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে নিউটনের গতি সূত্র আত্মস্থ করেছে, রসায়নবিজ্ঞানে ওয়াটার, কার্বনমনোক্সাইড, গ্লুকোজকে কীভাবে ভাঙতে হয় সূত্রগুলো শিখেছে তখন আমি শিশির ভেজা নারিকেল পাতায় চাঁদের আলোর মাখামাখির পানে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থেকেছি। ভোরে পুকুরের শান্ত জলে পা ডুবিয়ে মাছেদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টায় মত্ত রয়েছি। প্রজাপতিদের পেছনে পেছনে পুরো বাড়ি চষে বেড়িয়েছি। ধানখেতের আলপথ ধরে দু’পায়ে শিশির মাড়িয়ে ঘাসফড়িং এর মতো লাফিয়ে ছুটেছি। রবীন্দ্রনাথের ১৪০০ সাল কবিতাটি মুখস্থ করেছি। বিকেলবেলা দল বেঁধে নীড়ে ফেরা ক্লান্ত পাখিদের কিচিরমিচির শব্দের ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছি। পিপীলিকা, কীটপতঙ্গের পেছনে ছুটেছি। লজ্জাবতীদের ছুঁয়ে দিতেই তাদের নুয়ে পড়া দেখে হেসে কুটিকুটি হয়েছি।
সে আমি জীবনের তাগিদে নিউইয়র্কে এসে ইংরেজি ভাষা শেখা ও চর্চার প্রতি মনোনিবেশ করি, কলেজে ভর্তি হই। প্রবাসের দীর্ঘ জীবন পার করে একসময় উপলব্ধি করি দীর্ঘদিনের বিনা চর্চায় বাংলা ভাষায় আমার সীমাবদ্ধতা ও বাংলা লেখায় অনেক ভুলের সমাহার ঘটেছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্যের জন্য তৃষ্ণার্ত প্রাণ আমার তখন সন্ধান পায় সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্কের। সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক আমার মতো সাহিত্যপ্রেমীদের অনুপ্রেরণায় একটি অকৃপণ প্রতিষ্ঠান। বিনা চর্চায় বিদ্যা হ্রাস। ছোটবেলা থেকে লেখালিখি করলেও বিদেশে এসে লেখালিখি থেকে দূরে ছিটকে পড়েছিলাম। ব্যয়বহুল প্রবাস জীবনে চাইলেও শখের বিষয়গুলোর চর্চা অনেক সময় চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না।
যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা... আমি তোমার চরণ মা গো... আমি তোমার চরণ করব স্মরণ আর কারও ধার ধারব না কিংবা ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা—এই গানগুলো শুনে, গেয়ে বড় হওয়া আমি বিদেশে এসে পড়াশোনা, সংসার, সন্তান, কাজ এসব নিয়ে দারুণ ব্যস্ততায় প্রায় দেড় যুগ সময় ধরে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। যে বিষয়টি ঘটেছিল মনের অজান্তে সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত! সাহিত্য একাডেমির অনুপ্রেরণায় এতগুলো বছর ধরে বুকের এক কোণে অবচেতন মনে বিনা যত্নে পড়ে থাকা আমার দেশ, ভাষা, হিরের চেয়েও দামি বর্ণমালাগুলোকে মালা করে আবার গলায় পরেছি। ছোটবেলা থেকে লেখালেখির প্রতি জোঁক থাকলেও নিউইয়র্কের মতো ব্যস্ত, ব্যয়বহুল শহরে এসে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে মনের অজান্তেই আমি লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছিলাম। সাহিত্য একাডেমিতে এসে পুনরায় লেখালিখিতে ফিরে আসি। সাহিত্য একাডেমিতে গিয়ে পরিচয় হয়েছে এমন আরও অনেক লেখকদের সঙ্গে, যাঁরা দেশে থাকাকালে লেখালেখি করলেও প্রবাস জীবনের যান্ত্রিক ব্যস্ততায় হিমশিম খেয়ে লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছেন। পরিবেশ মানুষের মনের ওপর বিশাল প্রভাব বিস্তার করে। লেখালেখি থেকে দূরে সরে যাওয়া মানুষগুলো সাহিত্য একাডেমির অনুপ্রেরণায় আবার লেখালেখিতে ফিরে এসেছেন।
এটি সাহিত্য একাডেমির কৃতিত্ব! সাহিত্য একাডেমি উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত প্রবাসী লেখকদের নিয়মিত অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। নিউইয়র্কে সাহিত্য অঙ্গনের সর্বত্র সাহিত্য একাডেমির লেখকদের পদচারণায় মুখর থাকে। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আজকাল পত্রিকার সাংবাদিক মনজুর আহমেদ গত বছর কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমরা আগে পত্রিকায় লেখার জন্য লেখক খুঁজে পেতাম না। গত কয়েক বছরে তার ব্যাপক পরিবর্তন চোখে পড়ছে।’ আনন্দের বিষয় হলো নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো খুললেই এখন সাহিত্য একাডেমির লেখকদের লেখা গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ নিয়মিত দেখা যায়! তাঁদের নতুন ভাবনা, বোধ, সমৃদ্ধ চিন্তার আলোয় আলোকিত করে রেখেছেন পত্রিকাগুলোকে। সাহিত্য একাডেমিকে উদ্দেশ্য করেও প্রতি মাসেই লেখকেরা নতুন লেখা লেখেন। বিদেশ বিভুঁইয়ের শত ব্যস্ততার মাঝেও স্ব দেশীয় ভাষায় সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রাখা যা সত্যিই প্রশংসনীয়।
প্রায় আড়াই বছর আগে উন্নতমানের আড্ডা হতো গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে। জিমনেসিয়াম ছিল তাঁদের আড্ডার আখড়া। এথেন্সবাসী একই জায়গায় শরীর ও মনের চর্চা করত। ওসব আড্ডায় আসর জমিয়ে রাখতেন সক্রেটিস, প্লেটোর মতো গুণীজনেরা। তাঁদের আড্ডা থেকেই সৃষ্টি হতো অনেক উন্নতমানের শিল্প সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানের তত্ত্ব কথা। সাহিত্য একাডেমি লেখকদের জন্য একটি বড় মঞ্চ। ঝড়, বৃষ্টি, তুষারপাত প্রকৃতিতে যাই হোক না কেন, গত আট বছর ধরে মাসের শেষ শুক্রবার নিউইয়র্ক শহরের লেখকেরা সাহিত্যের আলোচনা, গল্প, কবিতা, আড্ডায় নিয়মিত ভাবে মুখর করে রেখেছেন সাহিত্য একাডেমির ঘরটিকে। সাহিত্য একাডেমিতে আগত দেশ-প্রবাসের অনেক গুণীজনই আশা ব্যক্ত করে বলেছেন, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কোনো একদিন সাহিত্য একাডেমির এই ঘর হতেই বেরিয়ে আসবে বাংলা সাহিত্যের কোনো উজ্জ্বল নক্ষত্র! অমর একুশের গ্রন্থমেলায় সাহিত্য একাডেমির লেখকদের নতুন বই বের হয়েছে। সাহিত্য একাডেমিকে ঘিরে লেখকদের মধ্যে উৎসাহ, উদ্দীপনা, সৃষ্টিশীলতা কাজ করে। লেখকদের এক জায়গায় সংগঠিত করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। সাহিত্য একাডেমি নিয়মতান্ত্রিক ভাবে অনেক কাঠ, খড় পুড়িয়ে ভালোবাসা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটি করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। সাহিত্য একাডেমি ছাড়া নিউইয়র্ক শহরে লেখকদের জন্য নিয়মিত চর্চার তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্য সংগঠন নেই। সাহিত্য একাডেমি নতুন লেখকদের যত্ন নেয়। তাঁদের প্রস্ফুটিত হতে সাহায্য করে। লেখকদের প্রাথমিক স্তর গঠনে সাহিত্য একাডেমি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রবাসের গতানুগতিক কর্মময় জীবন যাপন ও বাস্তব, নিষ্ঠুর, নির্দয় বাস্তবতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজ দেশীয় ভাষায় সাহিত্য চর্চায় কঠিন পরিশ্রম করছে সাহিত্য একাডেমি। নতুন প্রজন্মকে নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখে সাহিত্য একাডেমি। এ দেশে জন্মগ্রহণকারী আমাদের সন্তানেরা নিউইয়র্কের মূল ধারায় চলে গেলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে যেন দূরে সরে না যায় সে জন্য সাহিত্য একাডেমি চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ, ইতিমধ্যে আমাদের সন্তানেরা এসে সাহিত্য একাডেমিতে স্বরচিত কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি শুরু করেছে। বিশ্বের অষ্টম কথ্য ভাষাটি আমাদের বাংলা ভাষা। বিশ্বজুড়ে ২৪০ মিলিয়ন মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। সাহিত্য চর্চার জন্য বিশ্বের অনেক মানুষ বাংলা ভাষাকে পছন্দের তালিকায় বেছে নেয়। আমেরিকার সর্বত্র বাংলা ভাষা দ্রুত গতিতে বিস্তার লাভ করলেও সে বিচারে বাংলা ভাষা এখনো বিশ্বের দরবারে সমাদৃত নয়। বিশ্বের অন্যতম মধুর ভাষা, বাংলা ভাষায় রচিত নির্বাচিত সাহিত্যকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বের সাহিত্য দরবারে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে সাহিত্য একাডেমি।
মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, সম্মুখের পথে ধাবিত করে। স্বপ্ন দেখতে পারাটাও বিরাট একটা গুণ। স্বপ্ন দেখলেইতো একদিন সে স্বপ্ন পূরণ হবে। সাহিত্য একাডেমি স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রেরণা দেয়। লেখকদের মনের মন্দিরে স্নিগ্ধ স্বপ্নের বীজ বপনে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি শহীদ কাদরী বলেছিলেন, ‘দেশ থেকে বিদেশে আসলে লেখকদের লেখক সত্তার কবর হয়।’তাঁর কথার রেষ ধরে নির্দ্বিধায় বলতেই পারি, মৃতপ্রায় গাছে পানি, সার দিয়ে পরিচর্যার মাধ্যমে ফুল ফোটানোর নিদর্শন সাহিত্য একাডেমি। যার উদাহরণ আমি নিজেই এবং সাহিত্য একাডেমির উঠোনে অনু, পরমাণুর মতো মমতার বন্ধনে জড়িয়ে থাকা কবি লেখকেরা! প্রতি মাসের শেষ শুক্রবার সাহিত্য একাডেমির নিয়মিত আসরে সবার শুদ্ধ অনুভূতি প্রকাশে যার পরিস্ফুটন ঘটে। আমাদের ‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’ অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকুক লেখকদের ভালোবাসায়, ভাবনায়, কলমের কালিতে বইয়ের পাতায়!