করিমগঞ্জ যেভাবে ভারতের

সিলেটের একটি মহকুমা—নাম করিমগঞ্জ। এখন আর সিলেটের সঙ্গে নেই। সাতচল্লিশের দেশ ভাগের সময় এই মহকুমাটি কেটে রেখে দেওয়া হয় ভারতে। করিমগঞ্জকে সিলেটের সঙ্গে রাখার চেষ্টার সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তির অজানা সংগ্রামের কথা আজ বলব।
অনেকে জানেন, অনেকে জানেন না ইতিহাসের কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা। দু-তিন সপ্তাহ আগে প্রথম আলোর জম্পেশ আড্ডায় এল প্রসঙ্গটি। শুরু হয়েছিল সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে। আড্ডায় সিলেটের বন্ধুরা তাদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলেন। লক্ষ্য করি, এই প্রজন্মের এক লেখিকা দীর্ঘক্ষণ হা করে তাকিয়ে আছেন। একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, এই কথোপকথনের কিছু কি তিনি বুঝতে পেরেছেন? বললেন, একটুও না। বিন্দুবিসর্গও বোঝেননি। কথায় কথা বাড়ে। একপর্যায়ে মনে হলো, কারও কারও ধারণা—সিলেট মনে হয় বাংলার অংশই ছিল না। বাইরে থেকে এনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমি সুযোগটি নিলাম, এই ফাঁকে ছোট-খাটো একটা বক্তৃতা দিয়ে দিলাম।
বক্তৃতার সারকথা: ‘সিলেট বাংলারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গ করে, বাংলাকে ভাগ করে ফেলে, যার প্রতিবাদ রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন। ওই সময় তুলনামূলক অনুন্নত আসামের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বাংলা থেকে সিলেটকে কেটে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয় ব্রিটিশরা। শিক্ষায়-সম্পদে সিলেট তখন অগ্রসর ছিল। আসামের সচিবালয়ের প্রাণশক্তি ছিলেন সিলেটীরা। সিলেটকে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া তখন মেনে নিতে পারেননি বাঙালিরা, প্রতিবাদ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এ নিয়ে কবিতাও লিখেছিলেন—‘বাংলা হতে নির্বাসিতা-হে সুন্দরী শ্রীভূমি’।
এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় সিলেটকে নিয়ে গণভোটের আয়োজন করা হয়। ভারত না পাকিস্তান, সিলেট কার সঙ্গে যাবে—এ প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে সিলেটের জনগণ রায় দেন, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে যাবেন। এ গণভোটের ফলে সিলেট আবার ফিরে এল বাংলায়। তবে সম্পূর্ণ এল না, অঙ্গহানি ঘটল। এটা ঘটল র‌্যাডক্লিফের বদৌলতে অথবা কথিত কারসাজিতে। ব্রিটিশরা যখন সিদ্ধান্ত নেয়, ভারত-পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্র বানিয়ে তারা ভারতবর্ষ ছেড়ে যাবে, তখন দুটি রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণের জন্য স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফের নেতৃত্বে কমিশন গঠন করা হয়। তারা চিহ্নিত করে সীমানা। সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ ছাড়াও তখন সিলেটের আরেকটি মহকুমা ছিল, যার নাম করিমগঞ্জ। র‌্যাডক্লিফের সিদ্ধান্তের ফলে করিমগঞ্জসহ সাড়ে তিনটি থানা রেখে দেওয়া হয় ভারতে। এ গুলো এখন ভারতের অংশ।
আড্ডার এক তরুণ লেখক আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, এই ইতিহাস তিনি জানতেন না। আজ তার ভুল ভাঙল। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের সময় করিমগঞ্জ মহকুমার এসডিপিও (মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা) ছিলেন এম এ হক। তাঁর কাছ থেকে শোনা ঘটনাই আজ বলব।
এম এ হককে আপনারা অনেকেই চিনেন। তিনি বাংলাদেশের ভূমিমন্ত্রী ছিলেন। ডিআইজি হিসেবে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিল। ঢাকাস্থ জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও ছিলেন। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখলের পর যে সব পদস্থ আমলাকে চাকরিচ্যুত করেন এম এ হক ছিলেন তাদের একজন। তাঁর বাড়ি ও সংসদীয় এলাকা ছিল জকিগঞ্জ, যার অন্য পারেই করিমগঞ্জ। এম এ হকের মেয়ে ফারহানা হক বাংলাদেশ টেলিভিশনের ইংরেজি সংবাদ পাঠিকা, আরেক মেয়ে রেহানা আশিকুর রহমান সংগীতশিল্পী।
প্রায় চার দশক আগের কথা। আমি তখন দুটি পত্রিকায় কাজ করি। দৈনিক সংবাদের স্টাফ করেসপনডেন্ট ও সাপ্তাহিক যুগভেরীর সহকারী সম্পাদক। একদিন এম এ হকের ফোন পেলাম। তাঁর সঙ্গে যেতে হবে জকিগঞ্জ। সিলেট থেকে তাঁর সঙ্গে তাঁর জিপে করে রওনা হলাম। নতুন জিপ। কাঁচা-পাকা রাস্তা, ভাঙা-পাথরময়। এত খারাপ রাস্তা জানলে রাজি হতাম না। কী আর করা, এখনতো আর ফেরা যাবে না। হেলে-দুলে, আছড়ে-বিছড়ে এগিয়ে যাচ্ছে জিপ। বেশি জ্বালাচ্ছে রাস্তায় বিছানো বোল্ডার। এই কষ্টের মধ্যেও ভালো লাগল এম এ হকের গল্প। কত অজানা বিষয়ে কথা বললেন। ভুলে গেলাম রাস্তার কষ্ট।
গত সপ্তাহে নিউইয়র্কে দেখা হলো বিয়ানীবাজারের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ মইনুল ইসলামের সঙ্গে। তাকে ওই রাস্তার দুর্দশার কথা বললাম। তিনি জানালেন, ওই অবস্থা এখন আর নেই। এখন জকিগঞ্জের সঙ্গে দুটি রাস্তার মাধ্যমে সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি চূড়খাই হয়ে, অপরটি অন্য পথে এবং রাস্তা এখন পাকা। শুনে ভালো লাগল।
সেদিন জকিগঞ্জে পৌঁছে দেখলাম এক ভয়াবহ দৃশ্য। জকিগঞ্জের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে স্রোতস্বিনী কুশিয়ারা। এপারে জকিগঞ্জ, ওপারে করিমগঞ্জ। র‌্যাডক্লিপের বদৌলতে দুই দেশের সীমানা হচ্ছে নদীর মধ্য স্রোত। তীব্র স্রোতে নদী ভাঙছে এপার, আর গড়ছে ওপার। অর্থাৎ বাংলাদেশ হারাচ্ছে ভূমি, লাভবান হচ্ছে ভারত। নদী গ্রাস করছে বাংলাদেশের ভূমি, সেই ভূমি জেগে উঠছে ভারতে। সীমানা যেহেতু নদীর মধ্য স্রোত, তাই সব লাভ ভারতের।
সে সময় যুগভেরীতে জকিগঞ্জের খবর পাঠাতেন মাওলানা আবদুল মালিক। তিনি আমাকে নদী তীরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে দেখালেন। নদীর ওপারে প্রায় আধ মাইল দূরের জায়গা-জমি দেখিয়ে বললেন, ওগুলো ছিল আমাদের, নদীটা আগে ওখান দিয়ে প্রবাহিত হতো, ভাঙতে ভাঙতে এখন নদী চলে এসেছে এখানে। এভাবে ভাঙতে থাকলে একদিন হারিয়ে যাবে জকিগঞ্জ।
মনে পড়ে, এ নিয়ে আমি পত্রিকায় বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছিলাম। সরকারও ভাঙনরোধের পদক্ষেপ নিয়েছিল। এত বছর পর ওখানটা কী রকম আছে জানি না।
আবার ফিরে আসি এম এ হকের কথায়।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। ওই সময় এম এ হক করিমগঞ্জ মহকুমার এসডিপিও ছিলেন। জিপে বসে বললেন, তিনি আমার বাবাকে চিনতেন। তাঁর সিনিয়র ছিলেন।
আমার বাবা মরহুম বজলুর রহমান ব্রিটিশ ভারতে মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। আসামের বিভিন্ন জেলা-মহকুমায় দায়িত্ব পালন করেছেন। বাবার জবানিতে শুনেছি, মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল।
এম এ হক বললেন, তিনি এক সপ্তাহ পর্যন্ত করিমগঞ্জকে তাঁর দখলে রেখেছিলেন। পরে ভারতীয় বাহিনী চলে আসায় তাঁকে বিদায় নিতে হয়।
এম এ হক ১৪ আগস্ট করিমগঞ্জ মহকুমা পুলিশ কার্যালয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেন এবং সিলেটে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঘন ঘন তারবার্তা পাঠাতে থাকেন সামরিক সাহায্য পাঠানোর জন্য। ওই সময় সিলেটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন সিলেটেরই সন্তান সৈয়দ নবীব আলী। বিয়ানীবাজারের আলীনগরে তাঁর বাড়ি।
এম এ হক বললেন, প্রতিদিন আমি অপেক্ষায় থাকি, এই এল বুঝি ফোর্স। না, আসে না। এভাবে একদিন/দুদিন করে সাত দিন কেটে গেল। এ দিকে ভারতীয় বাহিনী চলে এল করিমগঞ্জ শহরে। আমি তখন নিরুপায়। আর কিইবা করতে পারি। মহকুমা পুলিশ কার্যালয় থেকে পাকিস্তানের পতাকাটা নামিয়ে গুটিয়ে নিলাম। তারপর চলে এলাম এপারে অর্থাৎ পাকিস্তানে। এভাবেই অবসান ঘটল এই অধ্যায়ের।
করিমগঞ্জ, রাতাবাড়ি, পাথারকান্দিসহ সিলেটের সাড়ে তিনটি থানা রয়ে গেল ভারতে। ওই সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কেন সাড়া দেননি বা দিতে পারেননি—সেই ভাষ্য জানার সুযোগ আমার হয়নি অথবা এ ব্যাপারে এম এ হকও আমাকে কিছু বলেননি। তাই এই অধ্যায়টুকু অজানাই রয়ে গেল।

লেখক: নিউইয়র্কপ্রবাসী সাংবাদিক।