জীবন এখানে এমনই

সকাল থেকে মনটা প্রচণ্ড বিষণ্ন হয়ে আছে। কাজে এসেছি সকালে। সিয়াটল থেকে ফেরার পর আজ প্রথম ক্লাস নিয়েছি। কয়েকটা ছাত্র-ছাত্রী এসেছিল ক্লাসের পর। ওদের বিদায় করে দিয়ে ঝিম মেরে বসে আছি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। পিটসবার্গের আকাশে সারাক্ষণ মেঘের আনাগোনা থাকলেও দূরের আকাশচুম্বী ভবনগুলো চোখে না পড়ার কথা না। কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে না। চোখ থাকলেই সব সময় সবকিছু দেখা যায় না!
মোর্শেদ ভাই শুয়ে আছেন রাস্তার উল্টো দিকের হাসপাতালটায়। বন্ধু ও বড় ভাই মোর্শেদ বয়সে আমার চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড়। আমাদের সম্পর্কে সেই বড়ত্বের প্রভাব ছিল না কখনো। দেশি ভাই-বেরাদর সম্পর্কটাই বড় হয়ে থাকত। একে অন্যকে খোঁচাখুঁচি করেই কাটাতাম আমরা আমাদের সময়গুলো। মোর্শেদ ভাইয়ের একটা বড় গুণ ছিল- উনি হাসতে জানতেন। অন্যের কথায় খুব হাসতেন, আর নিজে হাসির কথা বলে স্বভাবসুলভ ভঙ্গি নিয়ে বসে থাকতেন, যেন উনি কিছুই বলেননি, কিছুই শোনেননি।
বিতর্ক করতে পছন্দ করতেন খুব। বিশেষ করে আমেরিকান ও বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারি নির্বাচনের সময় বাংলাদেশি-আমেরিকান নীনা আহমেদকে জেতানোর জন্য রীতিমতো মাঠে নেমে গিয়েছিলেন। কংগ্রেসম্যান কনর ল্যাম্বের নির্বাচনী প্রচারণায় সরব উপস্থিতি ছিল তাঁর। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক কমই হতো। কিন্তু বাংলাদেশে কিসের কীভাবে উন্নতি হতে পারে, সে বিষয়ে তাঁর ভাবনার অন্ত ছিল না।
আমেরিকান মুসলিম সম্প্রদায় কীভাবে নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পারে, তার প্রেসক্রিপশন ছিল তাঁর কাছে। তিনি বলতেন, ‘শুধু নামাজ পড়ে, মসজিদে বসে ইবাদত করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। আমাদের যেতে হবে রাস্তায়। কমিউনিটি অর্গানাইজেশনে। হোমলেস শেল্টারে। স্বেচ্ছাসেবার কোনো বিকল্প নেই। মিশনারিরা ধর্ম প্রচার করেছিল কিভাবে? মানুষকে সাহায্য করে। মানুষের বিপদে এগিয়ে এসে।’
এখন এই সবই স্মৃতি। মাস তিনেক আগে বাংলাদেশে ভ্রমণের উদ্দেশে পিটসবার্গ বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন মোর্শেদ ভাই। কে জানত তখন যে, বাংলাদেশের মঙ্গলের জন্য ব্যাকুল লোকটির বাংলাদেশ সফরের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে নিজেরই শরীর। বিমানবন্দরে প্লেনে ওঠার ঠিক আগে আগে হৃৎপিণ্ডের প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মাটিতে ঢলে পড়েন মোর্শেদ ভাই। জরুরি চিকিৎসাসেবা দিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে তুলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। হৃৎপিণ্ডে ধাতব চাকতি নিয়ে বাসায় ফেরেন মোর্শেদ ভাই।
সেই ফেরাটা স্থায়ী হয়নি বেশি দিন। স্ত্রী এনা, বড় ছেলে ইজান, কন্যা রিয়া আর ছোট ছেলে জেয়ানকে নিয়ে ছিল তাঁর জীবন। হৃদ্‌যন্ত্রের অসুস্থতা তাঁকে ভোগাচ্ছিল ভেতরে-ভেতরে। সেটি কাউকে জানতে দেননি একবারও। সেই হাসি হাসি মুখটিই ধরে রাখতে চেয়েছিলেন সব সময়। নিজে সারা জীবন ওষুধের রুটিনে অবহেলা দেখালেও সময় নিয়ে সমবয়সী বন্ধুদের জানাচ্ছিলেন স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেওয়া কেন জরুরি। বেশির ভাগ সময় কাটাতেন বাসায় জেয়ান ও রিয়ার সঙ্গে। নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন ঘরের ভেতরের অর্কিড, অ্যালোভেরা, জেইড, ইস্টার ক্যাকটাস ও নানা ধরনের ক্ষুদ্রাকার সরেস উদ্ভিদরাজির যত্নে। অপেক্ষা করছিলেন বসন্তের; বাইরের বাগানের পাতাবিহীন গাছগুলো ও মাটির নিচের টিউলিপগুলোর ডাকের অপেক্ষায়। এ জায়গাটায় মোর্শেদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রচণ্ড মিল। বসন্তের অপেক্ষায় থাকি আমরা; বসন্তের সৌন্দর্য উপভোগ করব বলে নয়, সে সৌন্দর্য সৃষ্টি করব বলে।
সেই বার হাসপাতাল থেকে ফেরার ঠিক তিন মাসের মাথায় প্রিয় ভাগনির ফোন এল। ওর বাচ্চাটার প্রথম জন্মদিন। ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে অন্য মামা-খালার সঙ্গে মোর্শেদ মামাকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছে। প্রিয় ভাগনির অনুরোধ, তার ওপর প্রিয় নাতিটার প্রথম জন্মদিন। ইন্টারনেটে বসে টিকিট কেটে ফেললেন মোর্শেদ ভাই। বিমানবন্দরে মোর্শেদ ভাইকে নামিয়ে দিয়ে গেছেন এনা। যথারীতি নিরাপত্তাবলয় অতিক্রম করে নির্দিষ্ট গেটের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন। আর তখনই ঘটল আবার ঘটনাটা। বুকে অসম্ভব ব্যথা নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন মোর্শেদ ভাই। বিমানবন্দরের জরুরি স্বাস্থ্যসেবার লোকেরা এসে পৌঁছানোর আগে শুধু একটা কথাই বললেন, ‘আমার কার্ডিওলজিস্ট রহমান (ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ মেডিকেল সেন্টারের বাংলাদেশি হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ আরেফ রহমান)।’ তারপর আর কোনো কথা শোনেনি কেউ তাঁর। বহু চেষ্টার পর জরুরি স্বাস্থ্যসেবার লোকেরা তাঁর হৃৎস্পন্দন ফিরল। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো নিকটস্থ বিভার হাসপাতালে।
এ ঘটনা যখন ঘটছে, তখন আমি আড়াই হাজার মাইল দূরে। সিয়াটলের ফ্রেড হাচিনসন ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রে দুদিনের জন্য এসেছি। আমার কর্মসূচিগুলোর মধ্যে রয়েছে সকালে একটা বক্তৃতা দেওয়া, সারা দিন ধরে সহকর্মীদের সঙ্গে গবেষণা নিয়ে আলোচনা এবং দুপুর ও রাতে ওদের সঙ্গে খাবারের নিমন্ত্রণ। সে সূচিকে অনুসরণ করতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম যে, সিয়াটলের সঙ্গে পিটসবার্গের সময়ের ব্যবধান তিন ঘণ্টার। খেয়াল হলো যখন, তখন পিটসবার্গে রাত এগারোটা। লোপা, আমার স্ত্রী, ফোন ধরেই জানাল মোর্শেদ ভাইয়ের অবস্থার কথা।
পিটসবার্গে বাংলাদেশিদের সংখ্যা হাতে গোনা। বড়জোর শ দুই কি আড়াই। এখানে একঘরে বিপদ হলে অন্য ঘরে তার আঁচড় লাগে। অনেকটা পুকুরে ঢিল ছোড়ার মতো। সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিটির ছোট ভাই ডা. আরেফ রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ওর কাছে জানলাম বিস্তারিত। বিভার হাসপাতাল থেকে তাঁকে মৃত ঘোষণার সব ব্যবস্থাই করে ফেলা হচ্ছিল। আরেফ রহমানের উদ্যোগে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে স্থানান্তর করা হলো ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ মেডিকেল সেন্টারের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। তার পরের ঘটনা মৃত্যুর সঙ্গে মোর্শেদ ভাইয়ের লড়াই।
আমি আমার চেয়ার ছেড়ে উঠি। অফিসের দরজা বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসি। সিঁড়িতে সিঁড়িতে হোঁচট লাগে। পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পাশের রেলিং ধরে নামি। এক কদম দু কদম করে রাস্তা পার হয়ে পৌঁছে যাই ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ মেডিকেল সেন্টারের সামনে। এ পথে আমার যাওয়া আসা নিয়মিত। অফিসে যাওয়ার সময় পার্কিং করতে আমাকে এ রাস্তা নিতে হয়। জরুরি বিভাগের নার্সদের তৎপরতা আমার দৃষ্টি এড়ায় না কখনো। আজ মনে হচ্ছে কোনো শোরগোল নেই এখানে। এস্কেলেটরে করে আমি পৌঁছে যাই প্রথম তলায়। সেখান থেকে আর একটা এলিভেটরে দোতলায়। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের বেশ কিছু চিকিৎসকের সঙ্গে গবেষণায় অংশ নেওয়ায় এ জায়গা আমার চিরচেনা। কিন্তু আজ যেন সবকিছুকেই কেমন অচেনা লাগে। ধীরে ধীরে পৌঁছে যাই রোগীদের পরিবার-পরিজনদের জন্য নির্ধারিত বিশ্রাম কক্ষে।
এ কক্ষটি বেশির ভাগ সময়েই খালি থাকে। আমেরিকার চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা প্রবল। কোনো রোগী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে থাকলে কেউ কখনো ঘুণাক্ষরে ভাবে না যে, তার যত্নের অভাব করবে চিকিৎসক বা নার্সরা। সে জন্য ওরা সকালে বা সন্ধ্যায় অল্প সময় ছাড়া আর কখনো আসার প্রয়োজনবোধ করে না। টাকার ব্যবহার যেমন ওরা বুঝেশুনে করে, আবেগের ব্যবহারও তেমনি। আমার এক বুড়ো শিক্ষক একবার ক্লাসে এসে বলেছিলেন, ‘স্ত্রীকে ফিউনারেল হোমে রেখে এলাম।’ দায়িত্বের তাড়নাকে ওরা আবেগের ওপরে স্থান দেয় সর্বদা। কিন্তু আমরা পারি না। হারিয়ে ফেলার ভয় আমাদের খুব। আমরা মুষড়ে পড়ি।
মুরাদ ভাই (মোর্শেদ ভাইয়ের অগ্রজ), লুবনা আপা (তাঁর বড় ভাবি), চাচা ও চাচি বসে আছেন বিশ্রামকক্ষে। হাতের কোরআন শরিফ বন্ধ করে মুরাদ ভাই বললেন, ‘সময় ঘনিয়ে এসেছে। ইমাম আনতে পাঠানো হয়েছে। খুব বেশি হলে বিশ থেকে তিরিশ মিনিট।’ তাঁর ভেজা চোখের দিকে তাকাতেই আমার চোখে জলের অস্তিত্ব অনুভব করলাম। মুরাদ ভাইয়ের হাতটা শক্ত করে ধরলাম। মনে হয় বুঝি তাঁকে না ধরলে আমাদের দুজনের মধ্যে কেউ এখনই কোনো পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে যাব গহিন খাদে। বললেন, ‘যাবে একবার দেখতে?’ আমি বুঝতে পারছিলাম না, যাব কি যাব না। মুরাদ ভাই হাত ধরে বললেন, ‘চল, শেষবারের মতো দেখবে একবার!’
মুরাদ ভাইয়ের হাত ধরে আমি চলে যাই বিশ নম্বর বেডে। মোর্শেদ ভাই শুয়ে আছেন। শুয়ে আছেন বলা ঠিক হলো না, তাঁকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। অনুভূতিহীন নিস্তেজ শরীর। ঘুমন্ত মানুষটির কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে বুকের ওঠানামায়। অদ্ভুত লোকটা। এত কিছুর মাঝেও মুখে তাঁর স্বভাবসুলভ হাসিটি লেগেই আছে। যন্ত্র-জঞ্জাল সদা হাস্যময় লোকটির মুখ থেকে এই হাসি কেড়ে নিতে পারেনি।
একপাশে বসে এনা কোরআন শরিফ পড়ছে, আর অন্য পাশে রিয়া ও জেয়ান বিলি কাটছে মোর্শেদ ভাইয়ের বাঁ হাতে। ইজান দূরে দাঁড়িয়ে। বাচ্চাগুলোকে দেখে আমার ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। রিয়ার বয়সী আমার মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। যেন আমি আমাকে দেখলাম বেডে, আর আমার মেয়েটাকে দেখলাম পাশে। মুরাদ ভাই বললেন, ‘চল সবাই মিলে দোয়া করি।’ আমি মোর্শেদ ভাইয়ের মাথার কাছে গেলাম। ওপরের দিকে হাত তুললাম। আমার দেখাদেখি বাকি সবাই। আমার কোনো দোয়াই মাথায় আসছে না। আমি কি সব দোয়া ভুলে গেছি? রাব্বানা... আমিন।
দোয়া শেষ করে আলতো করে মোর্শেদ ভাইয়ের মাথায় হাত রাখলাম। আমার ইচ্ছে হলো কানে কানে বলি, ‘মোর্শেদ ভাই, বসন্ত এসেছে। বাইরে তাপমাত্রা ৬০ ডিগ্রি। বাগানে কাজ করার উপযুক্ত সময়। টিউলিপগুলোতে সার দিতে হবে। ঘরের রজনীগন্ধাটাকে বাইরে রাখার সময় এসেছে।’ হয়তো বাগান-পাগল এই লোকটি আমার কথা শুনে জেগে উঠতেও পারেন। মনের কথা মনেই রয়ে গেল। আমি নিজেকে সংবরণ করে বের হয়ে এলাম।
মুরাদ ভাই জানালেন, ‘ইমাম এসে পড়লেন বলে। তাঁর সাপোর্টগুলো সরিয়ে ফেলা হবে।’ ওপরওয়ালার ইচ্ছায় মানুষ চলে যাবে সত্যি, কিন্তু সে যাওয়া দেখার সাহস সবার থাকে না। তাঁর চলে যাওয়া দেখতে চাই না আমি। আমি বললাম, ‘মুরাদ ভাই, আমার একটা মিটিং আছে। আমাকে যেতেই হবে।’
যেভাবে এসেছিলাম, সেভাবেই বের হয়ে এলাম। পকেটের মোবাইলে ভাইব্রেশন জানান দিচ্ছে কেউ ফোন করছে। ফোন ধরতে ইচ্ছে করল না। টুং করে শব্দটা জানিয়ে দিল মেসেজ এসেছে। মেসেজে আহসানদের সুন্দর ফুটফুটে নবজাতকের ছবি। আমি ওপরের দিকে তাকাই। মনে মনে বলি, ‘অপার মহিমা তোমার। ওপারে নতুনের আগমন, এপারে প্রস্থানের আয়োজন। জীবন এখানে এমনই।