মেয়েটি কি বিচার পাবে?

নুসরাত জাহান
নুসরাত জাহান

প্রবাসে থেকে যখন দেশের এমন খবর দেখি, তখন মনে হয় যেন আইয়্যামে জাহেলিয়াতের বা অন্ধকার যুগে ফিরে যাচ্ছে দেশ। আমার এ লেখা যখন প্রকাশ হবে, আমি জানি না মেয়েটির কী অবস্থা হবে তখন। কারণ মেয়েটি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আগুনে পুরে গেছে তার শরীরের পঁচাত্তর শতাংশ। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করাই কী ছিল মেয়েটির অপরাধ? যে অধ্যক্ষ তাকে নিরাপত্তার আশ্রয় দেবে, তাকে আলোর পথ দেখাবে, তাকে সুশিক্ষা দেবে, সে কিনা লাঞ্ছিত করে, যৌন হয়রানি করে, শ্লীলতাহানি করে? ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আগুন দেওয়ার ঘটনাটি ঘটে। গত ২৭ মার্চ ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদদৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেন। আর প্রতিবাদ করলেই, মামলা করলেই ক্ষমতার বলে ভয় দেখিয়ে মামলা তুলে নিতে বলে। মেয়েটি তার অবস্থানে অনড় ছিল। সে সত্যের পক্ষে ছিল, ন্যায় বিচার চেয়েছিল।
ফলে তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় অধ্যক্ষের পোষা লোকগুলো।
ফলে আজ তার এই পরিণতি। নুসরাত এখন মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে।
এই পরিণতি আমাদের সমাজের জন্য এক ভয়াবহ বার্তা বহন করছে যে, যার ক্ষমতা আছে সে সবকিছুই করতে পারে। আইন কিছুই করতে পারবে না। লম্পট ব্যক্তিটি কিছুদিন জেলে থাকবে তারপর জামিনে বেড়িয়ে আসবে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল তার যেন কিছুই হয়নি।
বাবা-মা তাদের সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষা দিতে চান, তাদের ধারণা, মাদ্রাসা হচ্ছে সেই পবিত্র জায়গা। অথচ তারা জানে না প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মাদ্রাসার ছেলেমেয়েরা। ভয়ে কেউ মুখ খোলে না। আর বললে অবস্থা যে নুসরাতের মতো হবে তা সহজে অনুমেয়। একজন অধ্যক্ষ, মাওলানা এ রকম করবে কেউ কী বিশ্বাস করবে? করবে না। কিন্তু আস্তিনের নিচে লুকিয়ে আছে তার আসল চরিত্র। সুযোগ বুঝে কাল সাপের মতো ছোবল মারে।
চেহারায় পোশাকে এমন পরহেজগার বিনয়ী মানুষটি ভেতরে-ভেতরে নারীর প্রতি এত লোভী তা কে জানত। এরা সমাজে ধর্মের আভরণে নিজেদের চরিত্র ঢেকে রাখে। তাদের ধারণা, আর যা-ই কিছু হোক দাড়ি ,টুপি থাকলে কেউ বিশ্বাস করবে না এ লোক চরিত্রহীন । বরং যে অভিযোগ করবে তাকেই সবাই ধিক্কার দেবে।এই চরিত্রহীন অধ্যক্ষ সিরাজ নাকি জামাতের রুকন ছিল। তাকে নাকি বরখাস্তও করা হয়েছিল ২০১৬ সালে তার বিভিন্ন খারাপ কৃতকর্মের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে সে আবার একটা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হয় কী করে? আরও অবাক ব্যাপার হচ্ছে নুসরাতকে শ্লীলতাহানি জন্য, অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য অন্যদের যেখানে এগিয়ে আসার কথা সেখানে তার গায়ে উলটা আগুন দেওয়া হয়েছে। যারা আগুন দিয়েছে তারা বোরকা পরা ছিল। বোরকা আগে মানুষ পর্দা হিসেবে ব্যবহার করত । আর এখন কিছু অপদার্থ বেছে নিয়েছে খারাপ কাছে ব্যবহারের জন্য।
বিচারহীনতার কারণে দিনদিন অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে । এই জঘন্য অপরাধের যদি বিচার না হয় মেয়েদের গায়ে আরও আগুন দেওয়া হবে। একসময় বিষয়টা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এমন দিন আসবে ধর্ষণ হবে, শ্লীলতাহানি হবে, সেই সঙ্গে সব দোষ মেয়েটির ওপর চাপিয়ে তাকে হত্যা করা হবে। বা তার গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হবে।
বাংলাদেশে যেকোনো মেয়ে যখন লাঞ্ছিত হয় প্রথমেই মেয়েটির পোশাক, বা চরিত্র নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। বলা হয়, তুমি খারাপ মেয়ে তাই তোমার সঙ্গে এ রকম হয়েছে। আর না হয় পোশাকের ঠিক ছিল না। যেভাবেই হোক সমাজে মেয়েটিকে হেয় করে তামা তামা করা হয় চরিত্র । এমন একটা অবস্থা তৈরি করা হয়, শেষ পর্যন্ত মেয়েটি বিচার তো পায় না উলটা তাকে প্রতিনিয়ত কথা শুনতে হয় প্রতিবেশীদের কাছ থেকে, আত্মীয়র কাছ থেকে, সমাজের কাছ থেকে। মানে তুমি ভালো না তাই তোমার সঙ্গে এমন হয়েছে বা করেছে।
আচ্ছা নুসরাতের কী দোষ ছিল? সে তো পর্দাও করত। একজন অধ্যক্ষ এমন ন্যক্কারজনক কাজ করার পরও তার পক্ষে কিছু কুলাঙ্গার কথা বলছে, বলছে মেয়েটি লজ্জায় আত্মহত্যা করতে গিয়েছে। তার গায়ে কেউ আগুন দেয়নি। লজ্জা তো তাদের হওয়ার কথা একজন চরিত্রহীনের পক্ষে কথা বলার জন্য। অবশ্য অমানুষদের পক্ষে যেকোনো কাজ করা সম্ভব।
অনেকে বলবে বিদেশে নারীরা নির্যাতিত হয় না? শ্লীলতাহানি হয় না? আমি বলব, ‘হয়। তবে বিচার ও হয়।’ আইনের ফাঁক দিয়ে বের হওয়ার রাস্তা নাই। অপরাধ করলে বিচার হবেই। বর্তমানে বাংলাদেশে যা ঘটছে মেয়েদের ক্ষেত্রে আমি বলব এ এক অন্ধকার সমাজের প্রতিচ্ছবি। কোনো কিছু হলেই ধর্মের দোহাই দিয়ে অপরাধ জায়েজ করার জন্য নামে একদল ধর্মান্ধ। অপরাধী কে তা না দেখে আগে দেখে মেয়েটির পোশাক। আগে দেখে মেয়েটির সামাজিক অবস্থান। অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল হলে ক্ষমতাবান হলে তখন পিছু হটে। তবে সমাজের নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত মেয়েরাই বেশি শিকার হয় হয়রানির, শ্লীলতাহানির, যৌন নিপীড়নের। কারণ, লম্পট সিরাজের মতো লোকেরা জানে মেয়েটির অর্থনৈতিক অবস্থান দুর্বল, কিছুই করতে পারবে না।
নুসরাতের জন্য খারাপ লাগছে। এ রকম হাজারো নুসরাত আমাদের সমাজে আছে, প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে ভয়ে
মুখ খুলছে না। আছে মুখোশধারী
অসভ্যরা, ইতর প্রজাতির কিছু প্রাণী। এরা ধর্মের আভরণে নিজেদের ঢেকে রাখে। সুস্থ হয়ে উঠুক নুসরাত, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক এটাই চাই। সেই সঙ্গে বিচার হোক, এমন বিচার যেন সমাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।