জুনিয়র টাইগার্সের বিদ্রোহ

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সকালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী আব্দুর রকীবের মনে হলো সেকেন্ড বেঙ্গলে বা জুনিয়ার টাইগার্সে তাঁর পোস্টিং না হলেই ভালো হতো। ২৫ মার্চ এখানে আসার পর থেকে তিনি স্বস্তি পাননি। বেঙ্গল রেজিমেন্টে এর আগে চাকরি করেননি তিনি। ১৯৫১ সালে কমিশন পাওয়ার পর থেকে তাঁর জীবন কেটেছে পাঞ্জাব রেজিমেন্টে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট সম্পর্কে তাঁর ধারণা বরাবরই অস্পষ্ট। পাঞ্জাবিরা যখন বাঙালিদের যুদ্ধের অনভিজ্ঞতা নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করত তিনি তাতে যোগ দিতেন না বটে, তবে প্রতিবাদও করতেন না।
ব্রিটিশ আমলের সরকারি কর্মকর্তার ছেলে রকিব কলকাতার রিপন কলেজ থেকে এফএ পাস করেই, আর্মিতে ঢুকে গিয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে কলকাতায় রায়টের মুখে পড়তে হয়েছিল। তবে নিজে কখনো জড়াননি। তিনি জানতেন, উন্নতির জন্য লয়্যালটি আর ডিসিপ্লিনের বিকল্প নেই। মিলিটারি একাডেমিতে গিয়ে ধারণাটি আরও পোক্ত হলো। পাসিং আউটের দিন ‘জল, স্থল অন্তরিক্ষে যেখানেই যাইবার আদেশ করা হউক’ শপথ নিতে নিতে শব্দগুলো তাঁর অন্তরে গেঁথে গেল। তাই ২৫ মার্চ সকালে যখন ব্রিগেড কমান্ডার বললেন, ‘আপকা সেকেন্ড বেঙ্গল টেক ওভার করনা হোগা’, তিনি ‘রাইট স্যার’ বলে বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে জয়দেবপুর রওনা হলেন। যাওয়ার সময় স্ত্রীর সঙ্গে ঠিকমতো কথাও হলো না। তিনি ভেবেছিলেন, জয়দেবপুর তো ঘণ্টা দেড়েকের পথ। দায়িত্ব বুঝে নিয়ে বাসার কথা ভাববেন।
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদারকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় উড়িয়ে আনা হয়েছিল নতুন অধিনায়ককে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। তিনি চলে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর মনে হতে থাকল, বেঙ্গল রেজিমেন্ট সম্পর্কে তিনি এত দিন যা শুনেছেন, তা পুরোপুরি মিথ্যে নয়। এরা অন্য রেজিমেন্ট থেকে আসা কর্মকর্তাদের পছন্দ করে না। অফিসাররা খুব একটা তাঁর কাছে ঘেঁষছে না। সৈনিকদের মধ্যেও কোনো স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। ব্যাটালিয়নে যে নতুন অধিনায়ক এসেছেন, তারা যেন তা বুঝতেই পারছে না। তিনি একবার ভাবলেন অফিসারদের সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু বাঙালি মেজর শফিউল্লাহ ও পাঞ্জাবি কাজেম কামাল ছাড়া কারও সঙ্গে তাঁর পরিচয়ই নেই। ডিনারের পর নিজের রুমে গিয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা থেকে তার বড় ছেলে ফোন করে জানাল, বাসায় নাকি কারা টেলিফোন করে হুমকি দিচ্ছে। ঘটনাটি তাঁকে বিচলিত করে তুলল। ঢাকা সেনানিবাসে তোফায়েল কলোনিতে টেলিফোনে হুমকি দেওয়ার সাহস কার! দেশে হচ্ছে কী? কিছুদিন তিনি ইপিআর সদর দপ্তরে কাজ করেছিলেন। শফিউল্লাহকে বললেন ইপিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর বাসায় গার্ডের ব্যবস্থা করতে।
মাঝরাতে আবার তাঁকে অফিসে ছুটতে হলো টিক্কা খানের ফোনের কথা শুনে। গভর্নর মহোদয় স্বয়ং তাঁকে ফোন করেছেন। তিনি ইউনিফর্ম পরে অফিসে এসে ফোন ধরলেন। কথা হলো সামান্যই। টিক্কা খান বললেন, ‘সব ঠিক ঠাক হ্যায়?’
-হ্যা সার
-হোয়াট অ্যাবাউট গাজীপুর?
-সার, উই হ্যাভ এ প্লাটুন দেয়ার
-ওয়ান প্লাটুন মে নট বি এনাফ। দেয়ার মে বি সাম ক্যাওস, ইউ শুড মুভ এ কোম্পানি দেয়ার
-রাইট স্যার
ফোন শেষ করে, তিনি শফিউল্লাহকে ডেকে গাজীপুরে একটি কোম্পানি পাঠাতে বললেন। শফিউল্লাহকে খুব আগ্রহী মনে হলো না। কোম্পানিগুলোকে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ পাঠিয়ে এমনিতেই ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারের শক্তি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিভিলিয়ানদের কাছে তিনি খবর পেয়েছেন, যেকোনো সময় বড় ধরনের গোলমাল শুরু হতে পারে। নতুন অধিনায়ককে সেসব বলার সাহস পাচ্ছেন না। কর্নেল মাসুদ থাকলে কোনো সমস্যা হতো না। তিনি পরিস্থিতি খুব ভালো বুঝতেন। তাঁকে ১৯ তারিখের ঘটনার জন্য স্টেশন হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একে তো রকিব পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কর্মকর্তা, তার ওপর মার্চের শুরু থেকে ঢাকায় যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কানাঘুষো আছে সেসব কার্যকর করেছে ৩২ পাঞ্জাব। শফিউল্লাহ বললেন, ‘ওখানে তো আসজাদ লতিফের কোম্পানির একটা প্লাটুন আছেই। তা ছাড়া রাজেন্দ্রপুরেও বেলুচ রেজিমেন্ট ও ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের একটি করে প্লাটুন আছে।’
ধৈর্য না হারিয়ে রকিব বললেন, ‘কাজেম কামালের বাকি দুটো প্লাটুনও পাঠিয়ে দাও।’
কাজেম কামালকে সিওর আদেশ শুনিয়ে অফিসে গিয়ে মাসুদের ফোন পেলেন শফিউল্লাহ। মাসুদ বললেন, ‘ঢাকায় খুব গুলির আওয়াজ পাচ্ছি। সাবধানে থেকো। অ্যাসিস্ট রকীব। ও তো বেঙ্গল রেজিমেন্টে আগে চাকরি করেনি। আর কিছু বলার আগেই লাইন ডেড হয়ে গেল।’
২৬ মার্চ সকালে নাশতার পর টুআইসিকে নিয়ে রকিব কমান্ড ভয়েসে গিয়েছিলেন ব্রিগেডের সঙ্গে কথা বলতে। কয়েকজন অবাঙালি অপারেটর সেখানে কাজ করছিল। সিওকে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি ফ্রিকোয়েন্সি বদলে ফেলল তারা। শফিউল্লাহ সিওর পেছন থেকে বললেন, ‘ফ্রিকোয়েন্সি কিউ চেঞ্জ কিয়া?’ অপারেটর থতমত খেয়ে বলল, ‘স্যার কন্ট্রোল কা উধার তুফান হোতা হ্যায় ইসি লিয়ে দুসরা ফ্রিকোয়েন্সিপে জানে কা হুকুম মিলা।’
আকাশ একটু মেঘাচ্ছন্ন ছিল। তবে সেটি ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনে ব্যাঘাত ঘটার মতো নয়। শফিউল্লাহ বুঝলেন ঢাকা থেকে অপারেটরদের বিশেষ কোনো আদেশ দেওয়া হয়েছে, যা তিনি জানেন না। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইব্রাহিমকে সিগন্যাল প্লাটুনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাকে একবার জিজ্ঞাসা করা দরকার। কমান্ড ভয়েস থেকে বেরিয়ে তিনি অধিনায়ককে বললেন, ‘স্যা দেয়ার মাস্ট হ্যাভ সামথিং সিরিয়াস হ্যাপেনড ইন ঢাকা। দ্যাট ইজ হোয়াই ঢাকা ডাজ’নট ওয়ান্ট আস টু হিয়ার দ্য কনভারসেশন’। এরপর তিনি একজন বাঙালি অপারেটরকে ডেকে পাঞ্জাবিদের দিকে খেয়াল রাখতে বলে অফিসে ফিরে গেলেন।
অফিসে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ব্যাটালিয়নের একজন নিজস্ব অপারেটর এসে জানাল, ময়মনসিংহ থেকে মেজর নুরুল ইসলাম জরুরি কথা বলতে চান। ময়মনসিংহের সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। শফিউল্লাহ তড়িঘড়ি করে ছুটলেন ওয়্যারলেস রুমে। মেজর নুরুল ইসলামের গলায় চরম উত্তেজনা; তিনি বললেন, ‘স্যার কয়েক হাজার লোক আমাদের ঘিরে রেখেছে। তারা আমাদেরকে ইপিআরের পাঞ্জাবিদের সঙ্গে লড়াই করতে বলছে।’
শফিউল্লাহ বললেন, ‘ইপিআরে পাঞ্জাবি এল কোথা থেকে?’ টুআইসির এতসব সওয়াল জবাব দেওয়ার মানসিকতা নুরুল ইসলামের নেই। তিনি বললেন, ‘স্যার সেসব কথা পরে হবে। আমরা ঝামেলায় আছি। রাতে ইপিআরের সঙ্গে গোলাগুলি হয়েছে। শফিউল্লহা হতবাক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আর ইউ শিউর? ইপিআরে না বাঙালি বেশি!’
নুরুল বললেন, ‘তা-ই ছিল; কমর আব্বাস কাল বিওপি থেকে সব অবাঙালি সৈনিকদের হেড কোয়ার্টারে নিয়ে এসে বাঙালিদের কৌশলে ডিসার্ম করার চেষ্টা করেছে।’
শফিউল্লাহ কমর আব্বাসের নাম শুনেছিলেন। পাকিস্তানি এই ক্যাপ্টেনকে কিছুদিন হলো ইপিআর ২নং উইংয়ের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বললেন, ‘আমি
রিইনফোর্সমেন্টের ব্যবস্থা করছি। তুমি আগে বাঙালিদের সঙ্গে কথা বল।’ দু একজন নেতা ধরনের লোককে বল, ‘তোমরা তাদের সঙ্গে আছ। সময় হলেই তারা দেখতে পাবে। এখন তারা পারলে ইপিআরদের ব্যস্ত রাখুক।’
শফিউল্লাহর মনে হলো অধিনায়ককে বিষয়গুলো বিস্তারিত জানানো দরকার। সবকিছু শুনে রকিব বললেন, ‘আমাকে কী করতে বল?’
-সার, অবস্থা ভালো নয়। সকালে রাজেন্দ্রপুরে হেলিকপ্টার এসেছিল, অনেক এমোনিউশন নিয়ে গেছে।
-তাতো যেতেই পারে। সেন্ট্রাল এমুনিশন ডিপো ওখানে।
-স্যার, আমরা বেশ কিছুদিন ধরেই শুনছি আমাদের ডিসার্ম করানো হতে পারে।
-ইউ আর টকিং লাইক এ পলিটিশিয়ান।
শফিউল্লাহ একটু ঘাবড়ে গেলেন, বললেন, ‘তা নয় স্যার, উই হ্যাভ টু সেভ আওয়ার ট্রুপস।’ রকিবকে একটু চিন্তামগ্ন মনে হলো। বললেন, ‘ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারকে না জানিয়ে কী করে কিছু করি?’
শফিউল্লাহ বললেন, ‘স্যার ঢাকার সঙ্গে তো যোগাযোগ নেই। আমরা ট্রুপস নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে কনসেন্ট্রেট করি।’ সিও কোনো উত্তর দিলেন না। ২৬ মার্চ এভাবেই শেষ হলো।
নতুন জায়গায় রকিবের ভালো ঘুম হয় না। রাতে বিছানায় গেলেও রকিবের মনের ভেতরে সারা দিনের ঘটনাগুলো ঘুরপাক খেতে থাকল। তিনি বুঝেছেন যে, ইউনিটের বাঙালি অফিসার-সৈনিক সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ঠিকমতো সামলে না রাখলে যেকোনো সময় যা কিছু ঘটে যেতে পারে। টুআইসির ওপরও ভরসা করা যাচ্ছে না। দুপুরের কথায় পলিটিক্যালি মোটিভেটেড মনে হয়েছে। ভোর রাতে চোখ লেগে আসতেই শফিউল্লাহ এসে হাজির। একবার ভাবলেন পরে আসতে বলবেন। তারপর মত বদলালেন। এত ভোরে টুআইসি যখন এসেছেন গুরুতর কিছু নিশ্চয় ঘটেছে।
বাইরে এসে দেখলেন শফিউল্লাহ দাঁড়িয়ে আছেন সুবেদার নুরুল হককে সঙ্গে নিয়ে। নুরুল হক সুবেদার মেজরের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বললেন, ‘স্যার অবস্থা মোটেই ভালো না। গাজীপুরে গোলাগুলি ওইতাছে, দুজন সিপাই ভাইগা আয়া পড়ছে।’
রকীব বললেন, ‘বলেন কী সাব! সত্যি নাকি টুআইসি?’
শফিউল্লাহ বললেন, ‘স্যার সিপাই দুজনকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আপনি কথা বলে দেখতে পারেন।’
রকিব বললেন, ‘কথা যা বলার তুমিই বল।’
একটু পর ক্যাপ্টেন আজিজ এলেন সিওর অফিসে। তিনি ব্যাটালিয়নের অ্যাডজুট্যান্ট। তাঁকে দেখে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘স্যার আমাদের ট্রুপসের ওপর গুলি চালাবে, হাউ ক্যান উই অ্যাকসেপ্ট ইট?’
সিও বললেন, ‘হাউ আর ইউ শিউর যে, গুলি চালানো হয়েছে?’
আজিজ বললেন, ‘স্যার আওয়ার ট্রুপস উইল নট লাই উইথ আস।’
রকিব উত্তেজিত হলেন না। ভালো কমান্ডাররা উড়ো কথায় উত্তেজিত হন না। তিনি শফিউল্লাহকে বললেন, ‘হোল্ড এ কোর্ট অব ইনকোয়ারি। লেট আজিজ বি দ্য প্রেসিডেন্ট।’
একটু পর মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী এসে একই কথা বললেন। এই অফিসারটিকে তিনি পছন্দ করতে শুরু করেছিলেন। মইনুলের প্রোফাইল ভালো। কিছুদিন আগেও তিনি এক জেনারেলের এডিসি ছিলেন। কিন্তু মইনুলের কথা শুনে আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। গতকাল শফিউল্লাহ যে কথা বলেছিলেন, আজ মইনুলের মুখেও সেই একই কথা। মইনুল বললেন, ‘স্যার উই শুড অল মুভ আউট। আমি আমার কোম্পানি নিয়ে ক্রসকান্ট্রি গফরগাঁও হয়ে ময়মনসিংহ পৌঁছে যাব।’
রকিবের তখন আবার মনে হলো তিনি ৩২ পাঞ্জাবেই ভালো ছিলেন। অফিসাররা এ রকম উইয়ার্ড আইডিয়া নিয়ে কথা বলত না। সেকেন্ড বেঙ্গলের আরপি চেকপোস্টে দুপুরের কিছু আগে এক যুবক হাজির হলেন। আরপি গেটের সান্ত্রি তাঁকে ভিতরে ঢুকতে দিতে চাইছিলেন না। তিনি বললেন, ‘আমি ৩/৪ মাইল হাইটা একটা খবর দিতে এলাম আমারে মেজর শফিউল্লাহর কাছে যাইতে দ্যান।’
-আপনার পরিচয়?
-আমার নাম মোহাম্মাদ সিরাজুদ্দিন। আমি ঢাকা থেইকা লে. কর্নেল রেজার সঙ্গে আসছি।
-কুন রেজা স্যার, কুন ইউনিট?
-আমি জানি না।
শেষ পর্যন্ত আরপি হাবিলাদারকে ডাকা হলো। ইউনিটের টুআইসির মেহমান বলে তিনি যুবককে মেজর শফিউল্লাহর কাছে পাঠালেন। বর্ণনা শুনে শফিউল্লাহ বুঝলেন, আজিমপুরের ব্রাঞ্চ রিক্রুটিং ইউনিটের সিও লে. কর্নেল সালাহুদ্দিন মো. রেজা ধীরাশ্রম রেল স্টেশন থেকে ছেলেটাকে পাঠিয়েছেন লে. কর্নেল মাসুদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। ভোরে ঢাকা থেকে রওনা দেওয়ার পর সিরাজুদ্দিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছে টঙ্গীর কাছে। সিরাজুদ্দিনের বাড়ি ঢাকার কালাচাঁদপুরে। তিনি কর্নেল সাহেবের সঙ্গে ঢাকা থেকে এসেছেন। লে. কর্নেল রেজার সঙ্গে শফিউল্লাহর পরিচয় ছিল। তিনি বললেন, স্যারকে গিয়ে বলেন, কর্নেল মাসুদ তো নেই, আমরা আছি। স্যার এখানে চলে আসতে পারেন। এর পর নানা রকম ঝামেলার মধ্যে পড়ে তাঁর কথা আর মনে থাকল না। একটু পর ব্রিগেড কমান্ডার রকিবকে সেটে ডেকে পাঠালেন। জাহাঞ্জেব আবরার বেশি কথার মানুষ না। দু’এক কথার পরেই বললেন, ‘আওয়ার ট্রুপস আর ফেসিং ডিফিকাল্টিস অ্যাট টঙ্গী, সেন্ড আ কোম্পানি টু ডু সাম শুটিং।’
রকিব শফিউল্লাহকে বললেন, ‘পাঠানো যাবে না?’ শফিউল্লাহ কোনো বাঙালি ট্রুপস হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি বললেন, ‘এখানে তো একটি মাত্র কোম্পানি আছে। আমরা বরং রাজেন্দ্রপুর থেকে একটি প্লাটুন পাঠিয়ে দিই। মেজর আসজাদ লতিফ সঙ্গে যাক।’
বিকেলে প্লাটুনটি জয়দেবপুরে ফিরে এলে লতিফ জানালেন। তেমন কিছু নয়। টঙ্গী ব্রিজের ওপর জনতা ব্যারিকেড তৈরি করছিল। তাই নিয়ে গোলাগুলি হয়েছে। ড্রাইভারদের কাছে জানা গেল অন্য কথা। টঙ্গী পৌঁছানোর পরপরই সেন্ট্রিরা তাদেরকে চ্যালঞ্জে করে। হাত উঁচু করে সামনে এগোতে বললে মেজর আসজাদ লতিফ যখন তাদের পাঞ্জাবি ভাষায় বকাবকি করছিলেন, তখন একজন সেন্ট্রি বলে, ‘দেখ, সালে পাঞ্জাবি ভি শিখ লিয়া।’
শফিউল্লাহ বুঝলেন তাঁর ধারণাই ঠিক। আসলে এরা কৌশলে বাঙালি অফিসারদের আটকাতে চাইছিল। তিনি সিওকে বললেন, ‘স্যার, এখনো যদি আমরা কিছু না করি অনেক দেরি হয়ে যাবে।’ এদিকে সমস্যা একটা নয়। অফিসার্স মেসে পশ্চিম পাকিস্তানি দুজন অফিসার আগে থেকেই ছিলেন। তারপর এসে জড়ো হয়েছেন আসজাদ লতিফ। টঙ্গী থেকে রাজেন্দ্রপুরে না ফিরে তিনি জয়দেবপুর এসে অন্য দুজন পাঞ্জাবি অফিসারের সঙ্গে ফুসুর ফুসুর করছেন। একজন জুনিয়র অফিসার জানালেন, ‘স্যার, মনে হয় মেজর কাজেম কামালের কাছ থেকে তাদের জন্য কোনো মেসেজ নিয়ে এসেছে। বাঙালি অফিসার সামনে গেলেই তাদের কথা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’ শফিউল্লাহ আর দেরি না করে লতিফকে জোর করে গাজীপুরে পাঠিয়ে দিয়ে অন্য অফিসারদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন।
অধিনায়ককে বলা হলো, ২৮ মার্চ সকাল ১০টায় শফিউল্লাহ অ্যাডভান্স পার্টি নিয়ে টাঙ্গাইলের পথে রওনা হবেন। টাঙ্গাইলের কোম্পানির কোম্পানি অফিসার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ সঙ্গে যাবেন। ময়মনসিংহে যে কোম্পানি আক্রান্ত হয়েছে, তার কথা গোপন রাখতে হবে। আর যেহেতু রাজেন্দ্রপুর ও অন্যান্য জায়গা থেকেও বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে যেতে হবে, তাই এসব ব্যাপারে প্রকাশ্য আলোচনা করা যাবে না। ওয়াপদার সঙ্গে কথা বলে সন্ধ্যা থেকে জয়দেবপুরে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার ব্যবস্থাও করা হলো। অধিনায়কের মুভটা হবে গোপনে সন্ধ্যা সাতটার পর।
অধিনায়ক বললেন, ‘রাজেন্দ্রপুর, গাজীপুরের প্লাটুনগুলোকে সতর্ক করা দরকার। কোনো একটা সংকেতে তারা যেন একই সঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারে।’ কোয়ার্টার মাস্টার লেফটেন্যান্ট এজাজকে একটি বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হলো। তিনি প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ ও রসদের ব্যবস্থা করবেন। ২৮ মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন আজিজ রাজেন্দ্রপুরে গেলেন বাঙালি প্লাটুনগুলোকে খবর দিতে।
সকাল দশটায় যথাক্রমে ৪ ও ৩টি ট্রাক নিয়ে শফিউল্লাহ ও হেলাল মোরশেদ রওনা হলেন অ্যাডভান্স পার্টি নিয়ে। তাঁরা গাজীপুর চৌরাস্তায় এসে দেখলেন প্রতিটি বাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। শফিউল্লাহ নিজের গাড়িতেও লালসবুজের একটি পতাকা উড়িয়ে দিলেন। রাস্তার দুপাশের মানুষ জয় বাংলা স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলল চরাচর।
টাঙ্গাইলের কাছে পৌঁছানোর পর তাঁদের থামতে হলো। উল্টো দিক থেকে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে একটি জিপ আসছিল। গাড়ি থেকে একজন যুবক এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনারা একটু অপেক্ষা করেন, আমাদের লোকজন পজিশন নিয়ে আছে। তাদের থামিয়ে আসি।’
এরপর বিশাল জনতা ব্যান্ড পার্টিসহ হাজির হলো তাদের অভ্যর্থনা দিতে। শহরে ঢুকতে না ঢুকতেই তিনি খবর পেলেন, চট্টগ্রাম থেকে কোনো এক মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আবেগে শফিউল্লাহর চোখে পানি চলে এল। এই কোনো এক জিয়াকে তিনি চেনেন। তিনি তাঁরই কোর্সমেট। শফিউল্লাহর আগে তিনিই ছিলেন সেকেন্ড বেঙ্গলের টুআইসি। তাঁর শুধু মনে হতে লাগল তিনি একা নন। তাঁর সাহস তিন গুণ বেড়ে গেল।

সূত্র:
Major General K M Shafiullah, BU (Retd) Bangladesh at war/ Siddik Salik; Witness to Surrendar/ কাদের সিদ্দিকী, স্বাধীনতা ৭১/ মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী; এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য/ আলাপ চারিতা; লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএসএম নাসিম বীর বিক্রম, মেজর জুনায়েদ আহমেদ ও মেজর এস এম সাইদুল ইসলাম/ আলাপ চারিতা; মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান, বীর উত্তম, মেজর জেনারেল এজাজ আহম্মেদ চৌধুরী/ সাপ্তাহিক বিচত্রা; প্রতিবাদ লিপি; লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী আব্দুর রকীব (অব.),/ মেজর এস এম সাইদুল ইসলাম; বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধযাত্রা ১৯৭১