শিশুকে স্বাভাবিকভাবে বড় হতে দিন

মা-বাবারা ছিনিয়ে নিচ্ছেন বাচ্চাদের কিউটনেস। ইংরেজিতে কিউটনেস বলার কারণ, বাংলা শব্দটা একটু বেশি ভারী, যার মানে বুদ্ধিসম্পন্ন। বাচ্চারা নিজে থেকে যখন অশুদ্ধভাবে, ভুলভাবে কিছু উপস্থাপন করে, তখন তার মাঝে কিউটনেস থাকে, যা একজন মা-বাবাকে দেয় বিশুদ্ধ আনন্দ। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ভাবতে গেলে একটা শিশু আর এখন শিশু নেই। ছোট্ট মেয়েটা এখন চাইলেই তার মতো করে পুতুল বানিয়ে খেলতে পারে না যে, সে তার বুদ্ধিমত্তা দেখাবে। ছোট্ট বাবু সোনাটা চাইলেই খেলায় মগ্ন থাকতে পারে না। ছেলে হিসেবে সে হয়তো ঘরের একটু বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে, সেও আজ বঞ্চিত। তাদের সে সময় কোথায়? এখন পড়াশোনার পাশাপাশি সংস্কৃতির নামে মা-বাবার সামাজিক স্ট্যাটাস প্রতিযোগিতা আর চাহিদার বলি হচ্ছে তাদের শিশুকাল, শিশুসুপ্ত মন। তাদের নিজস্ব সৃজনশীলতার সুযোগ খুব কম। এখন তারা তাই করে যা তাদের তোতা পাখির মতো শেখানোর কসরত চলে।
শিশু নিজের বুদ্ধি দিয়ে যা করছে তাই তার বুদ্ধিসম্পন্ন কাজ। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নির্ভুলভাবে কিছু উপস্থাপনে চমক এবং মুগ্ধতা দুটোই থাকে, কিন্তু তখন যাচাইয়ের স্কেল বা মাপকাঠি বদলে দেখতে হয়। কেননা, তা কেবল বুদ্ধি সম্পন্নতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সঙ্গে যোগ হয় মা–বাবার নিজস্ব কৃতিত্ব। আমরা মা-বাবাকেই সব যোগ্যতার আঁধার ভাবি এবং এটাই ভাবা উচিত, কেননা এমন গুণী মা-বাবা না থাকলে বাচ্চার কী সাধ্য পাঁচ–সাত বছর বয়সে অ্যাওয়ার্ড ছিনিয়ে নেয়। তবে পাশাপাশি স্বতঃস্ফূর্ত যে কিউটনেস তা আর থাকে না!
বলিউডের অভিনেতা আমির খানের ‘থ্রি ইডিয়ট’ সিনেমা যারা দেখেছেন, তাদের নিশ্চয় মনে আছে, বাবা রেঞ্চর দাস ছেঁঞ্চড় শ্রেণিকক্ষে তাদের ডিরেক্টরকে বলেছিল, চাবুকের ভয়ে বাঘও চেয়ারে ওঠা বসা শিখে যায়। আর আমরা তো মানুষ, প্রথম হলেই কি?...পড়ে ভালো ছাত্র হব। এদের বলে ‘we’ll trained not well educated’। এখন যা হয় তা হচ্ছে রেস বা দৌড় প্রতিযোগিতা...হাসির খোরাকের পাশে এরকম উচ্চ মার্গের সংলাপ আছে। এই উচ্চ দর্শনমূলক ছবি দেখেও আমরা অনেক সময় কিছু শিখি না। আমরা সবাই চাই, ছেলেমেয়েদের চিকিৎসক বা প্রকৌশলী বানিয়ে ফেলতে। আমাদের শিশুরা এখন প্রতি মুহূর্তে ওয়েল ট্রেইন্ড, তাদের মধ্যে স্বশিক্ষিত ভাব থাকলেও এই প্রশিক্ষণের চাপে তা ক্রমশ বিলুপ্ত হতে চলেছে। জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে হয়তো তারা মিস করবে, ভাববে সেই স্বাধীনতা তাদের ছিল না। বড় হয়ে না চাইলেও পায়ে অনেক বাঁধা পড়ে যায়। অনেক অনেক প্রশিক্ষণ, প্রতি মুহূর্ত সমাজে নিজেকে টিকিয়ে রাখার প্রতিযোগিতায় আপগ্রেডেশন চলতেই থাকে, থাকবে।
শিল্পী আশা ভোঁসলে বেশ আগে একবার এক সাক্ষাৎকারে একটা কথা বলেছেন। বাচ্চাদের প্রতিযোগিতামূলক একটি অনুষ্ঠানের জন্য তাঁকে বিচারক করতে চাইলে তিনি রাজি হননি। বরং এর ঘোর বিরোধিতা করে তিনি বলেছিলেন, এগুলো বাচ্চাদের নিজস্ব সৃজনশীলতার অন্তরায়। একটা বাচ্চা যদি গান ভালোবাসে, তবে ছোটবেলায় সে নিজে অনুভব করবে নিজে থেকে গাইবে। তাকে পারিবারিক পরিসরে বা ছোট ছোট অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বা পুরস্কারের জন্য তৈরি করা অনেক সময় তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
আশা ভোঁসলে উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, শিশুকালের পুরস্কার প্রতিযোগিতা যদি কাউকে খুব বড় তারকা বানিয়ে দিত, তবে যুগল হংসরাজ হতেন বোম্বের সবচেয়ে বড় তারকা। কারণ তিনি মাসুম সিনেমা থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন, গানসহ অন্যান্য ছবির জন্য অনেক শিশুপুরস্কার পেয়েছে।
কথাগুলো আমার হঠাৎ মনে আসার কারণ, ইদানীং দেখছি অনলাইনে বাচ্চাদের নিয়ে এক ধরনের শীতল প্রতিযোগিতা হচ্ছে। লাইক কমেন্টের জোছনায় মা-বাবারা ভেসে যাচ্ছেন কিন্তু এক মুহূর্তও ভাবছেন না, কীভাবে এই শিশুর শিশুতোষ মনটাকে মুছে দিচ্ছেন নিজের হাতে। একজন হয় তো ছোট বাচ্চাকে দিয়ে বড়দের একটা কবিতা আবৃত্তি করিয়েছেন। অনলাইনে পোস্ট দিতেই হাজার পাঁচ লাইক/ভিউ ছাড়িয়ে গেছে। সে যখন বড়দের একটা কবিতা আবৃত্তি করছে অসম্ভব সুন্দরভাবে, আমরা পরম মুগ্ধ হচ্ছি। আশীর্বাদের বন্যায় ভরে যাচ্ছে মন্তব্য বক্স। আনন্দে আত্মহারা মা-বাবা এখন প্রতিদিন বসিয়ে রাখছেন, মুখস্থ করো জীবনানন্দ, রবি ঠাকুরের সব কবিতা। মেশিনের মতো বাচ্চারা তাই করছে। তবে এটা যদি শুধু ওই বাচ্চাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে কথা ছিল না। মা-বাবাও বসে নেই। তারাও উঠে পড়ে লেগেছেন।
ছোট বাচ্চাদের কাছে মা-বাবা বিরাট কিছু। মা-বাবা তাদের যেভাবে চাবি দেন সেভাবেই চলে, বিশেষ করে ১০–১১ বছর পর্যন্ত। তারপর তারা একটা সময় বুঝতে পারে, মা-বাবা যা চেয়েছেন তারা তাই করেছে। এটা খুব সত্য, মাঝে মাঝে আমি আমার মেয়েকে বলি, ‘তোমাকে আমি ছোটবেলায় বললেই গান শোনাতে, এখন শোনাও না। সে হেসে বলে, ‘আমি এবং সব শিশুরা তখন নিরেট বোকা থাকে। তাই তোমরা যা বলো, আমরা তাই করি’। কথাটা মিথ্যা নয় মোটেও। খুব জাঁদরেল অভিভাবক হলে হয়তো দুই দুটি লাগিয়ে বলতেন, ‘তুই গাইবি না তোর বাপ/মা গাইবে’। কিন্তু আমার আবার নীতি উল্টো। আমি পড়াশোনায় বাচ্চাদের চাপ দেওয়ার ঘোর বিরুদ্ধে। গান–বাজনা তো দূরের ব্যাপার। সে খুশি মনে পিয়ানো শেখে, সেটাই ভালো মনে হয়।
পড়াশোনা হোক আর অন্য কাজকর্ম—একটিবারও আমরা ভাবি না, এর জন্য যা ক্যাপাসিটি বা ধারণক্ষমতা দরকার, তা আমার বাচ্চাটির নেই। বাচ্চা কেন প্রতিটা মানুষ মননে গড়নে পৃথক। আমার হয় তো ডাল রান্না করার যোগ্যতাটুকুই আছে, কিন্তু এখন কেউ যদি মাংস রান্নার জন্য চাপ দেয়, তা রান্না হলেও তাতে প্রকৃত মাংসের স্বাদ থাকবে না—এটাই স্বাভাবিক। সামাজিক প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে আমরা ভুলতে বসেছি নিজস্ব সত্তা, অবস্থান, সম্পর্ক সবকিছু। আমাদের প্রত্যাশা খুব বেশি কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। বাচ্চাগুলোকে তাদের স্বাভাবিক আনন্দধারা নিয়ে বড় হতে দিন।