বুড়ি, ছবি, হেনাদের কথা...

[দুই লাখ মা–বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আজকে আমার এই স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের শহরে গ্রামে ঢুকে যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল খুন, ধর্ষণ ও নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন। এই পাশবিক কাজে সহায়তা করেছিল বাংলারই কিছু কুসন্তান শান্তি কমিটি ও রাজাকার আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। দেখতে পাই, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৮ বছর পরেও এই রাজাকার, আলবদররা রং পালটে নতুন মুখোশ এঁটে বিভিন্ন স্থানে ঘাপটি মেরে বসে আছে, আছে গা ঢাকা দিয়ে। আমাদের এখন প্রয়োজন এই গা ঢাকা দেওয়া বর্ণচোরা রাজাকারদের মুখোশ উন্মোচন করে দেওয়া, বাংলার মাটিতে তাদের বিচার করা। আজকের এই পর্বে তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহকুমার রাজাকার, আলবদর ও পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত আমাদের কয়েকজন নারীদের ইতিহাস তুলে আনা হয়েছে। এই লেখাটি লিখতে সহযোগিতা করেছেন কিশোরগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নিরলস কাজ করে যাওয়া মু আ লতিফ । তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা।]

গল্প-২০
১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ মহকুমায় পাকিস্তানি সেনারা ঢুকে। তারা কিশোরগঞ্জ শহরে ঢুকেই জ্বালাও পোড়াও শুরু করে। শহরে শুরু হয় ত্রাসের রাজত্ব। সাধারণ মানুষ যে যার মতো দিগ্‌বিদিক পালিয়ে যেতে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনাদের শহরে ঢোকার পরই তাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় পিডিবি, জামায়াতে ইসলামি, নেজামে ইসলাম এবং মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা। প্রভুদের খুশি করতে তারা প্রতিদিন পাকিস্তানি আস্তানায় বিশেষ নজরানা দিতে শুরু করে। একাত্তরের জুন মাসের দিকে কিশোরগঞ্জে প্রথম শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির সভাপতি করা হয় পিডিপির নেতা মাওলানা মুসলেহউদ্দিনকে। সাধারণ সম্পাদক করা হয় স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতা আবদুল আউয়ালকে। শান্তি কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ১৩২ জন। শান্তি কমিটি গঠন হওয়ার সঙ্গেই সঙ্গেই রাজাকার–আলবদরদের সহযোগিতায় শুরু হয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। বলা যায় এক বাঙালি ভাইয়ের সঙ্গে আরেক বাঙালির যুদ্ধ। যে মাওলানা কিছুদিন আগেও বাড়িতে এসে মাছের মুড়ো দিয়ে ভাত খেয়ে গেছেন, সেই মাওলানা রাতারাতি পাকিস্তানিদের দলে যোগ দিয়ে বাংলার মুক্তিকামী মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে যান।
রাজাকার আর আলবদরদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় সাধারণ মানুষের জীবন তখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। গ্রামের উঠতি বয়সী মেয়েদের গোপনে লুকিয়ে রাখা হতো। রাজাকারদের অন্যতম কাজ ছিল শহর–গঞ্জে ঘুরে ঘুরে নারী জোগাড় করা এবং তাদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া। পাকিস্তানি সেনারা বাংলার এই নিরীহ নারীদের শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা ধর্ষণের পর তাদের হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিত। কখনো কখনো তারা মায়ের সামনে তার মেয়েকে ধর্ষণ করত। অথবা মেয়ের সামনে মাকে ধর্ষণ করত। এই ধর্ষণের দৃশ্য স্থানীয় রাজাকাররা দেখত আর উপভোগ করত। আজকের গল্প কিশোরগঞ্জ শহরের বত্রিশ গ্রামের সাইকেল ব্যবসায়ী নীরদ চন্দ্র সরকারকে নিয়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাঁর মতো এমন অনেক অজানা গল্প এখনো আমাদের অজানাই রয়ে গেছে।
কিশোরগঞ্জ শহরে পাকিস্তানি সেনাদের আগমনের সঙ্গেই সঙ্গেই গোটা শহরে যেন অন্ধকার নেমে আসে। হিন্দু–মুসলমান সবার চোখে তখন আতঙ্ক। কখন কী জানি হয়ে যায়। বিশেষ করে সবার বেশি ভয়, তার যুবতী স্ত্রী অথবা উঠতি বয়সী মেয়েটিকে নিয়ে। রাজাকার বাহিনী যদি টের পায়, তাহলে আর কোনো রক্ষে নেই। রাজাকার বাহিনীর অন্যতম একটি কাজ ছিল শহরের কার বাড়িতে তরুণী মেয়ে আছে, সেই তথ্য উদ্ধার করা। কারণ রাজাকারদের প্রতি পাকিস্তানি সেনাদের প্রত্যক্ষ হুকুম ছিল, তারা যেন প্রতি রাতে নতুন নতুন নারী জোগাড় করে দেয়। কিশোরগঞ্জের নারী লিপ্সু এমন দুজন পাকিস্তানি সেনার নাম ছিল মেজর ইফতেখার ও ক্যাপ্টেন বোখারি। এই দুজন তত দিনে রাজাকারদের কাছেও খুব প্রিয়। এই দুই পাকিস্তানি সেনার মন জয় করতে রাজাকাররা নিত্য–নতুন নারী সরবরাহে ব্যস্ত হয়ে পরেছিল। বিশেষ করে হিন্দু পরিবারের নারীদের ওপর ছিল রাজাকারদের বিশেষ দৃষ্টি। সে কারণে কিশোরগঞ্জের হিন্দুরা গোপনে শহর থেকে পালাতে শুরু করে। এবং তাদের অনেকেই নিজ ভিটা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে থাকে।
১৯৭১ সালের সম্ভবত জুন মাসের শেষের দিকের ঘটনা। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে খুব কাছেই বত্রিশ নামের একটি ছোট বাজারে নীরদ চন্দ্র সরকার বেশ পরিচিত একটি মুখ। তিনি ছিলেন খুব সাধারণ একজন সাধারণ সাইকেল ব্যবসায়ী। অসাধারণ ভালো একজন মানুষ হিসেবে এলাকায় তার বেশ সুনাম। সহজ সরল জীবন ছিল তার। এলাকার সবার খুব প্রিয় মানুষ নীরদ চন্দ্র সরকার। তার দুই মেয়ে। বুড়ি ও ছবি। আর তিন ছেলে। বুড়ি ও ছবি বয়সের দিক থেকে তরুণী। সে কারণে এই দুই মেয়েকে নিয়ে যত ভাবনা বাবা নীরদচন্দ্রের। যেভাবেই হোক রাজাকারদের হাত থেকে তাদের বাঁচাতে হবে।
নীরদ চন্দ্র একদিন কাক ডাকা ভোরে পরিবারের সবাইকে নিয়ে গোপনে বাড়ি থেকে পালালেন। উদ্দেশ্য ভারত চলে যাওয়া। কিন্তু ভাগ্য তার খারাপ ছিল। রাজাকারদের একটি দল হঠাৎ করে নীরদচন্দ্র সরকারের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। নীরদচন্দ্র সরকার ও তার তিন ছেলেকে সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়। মেয়ে বুড়ি ও ছবিকে তারা ধরে নিয়ে যায় নারী লিপ্সু মেজর ইফতেখার ও ক্যাপ্টেন বোখারির ডেরায়। পাকিস্তানি সেনারা এই দুই নারীকে দিনের পর দিন তাদের ক্যাম্পে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালায়। তারপর একদিন তাদের দুজনকেই গুলি করে মেরে নরসুন্দা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। নীরদচন্দ্রকে যে রাজাকাররা গুলি করে মেরেছিল, তারা সবাই একসময় নীরদচন্দ্রের খুব প্রিয় লোক ছিল।
বত্রিশের নীরদচন্দ্রের মতো ঠিক একইভাবে কালীবাড়ি এলাকার বাসিন্দা যোগেশ ঘোষের একমাত্র মেয়ে হেনা ঘোষ, খড়মপট্টি বকুলতলার খগেন্দ্র চন্দ্র রায়ের তরুণী স্ত্রী, শহীদ খগেন্দ্র কিশোর লোহের মেয়েদের ওপর পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার দালালদের পাশবিকতা নেমে এসেছিল। কিশোরগঞ্জের বাতাস এখনো এই পাকিস্তানভক্ত রাজাকার, আলবদরদের হাতের রক্তাক্ত ছাপ লেগে আছে। এই জানোয়ারগুলোর অনেকেই এখন প্রগতিশীলতার মুখোশ পরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। এদের অনেকের বিচার এখনো বাংলার মাটিতে হয়নি। কিন্তু কিশোরগঞ্জবাসী জানে, তাদের বিচার কোনো একদিন এই বাংলার মাটিতে হবেই। এদের অনেকেই এখন পলাতক। শান্তি কমিটির সভাপতি মাওলানা মুসলেহউদ্দীনের দুই কুপুত্র এখন পলাতক। যেদিন এই কুলাঙ্গারদের উপযুক্ত বিচার হবে, সেদিন বুড়ি, ছবি আর হেনাদের মতো নির্মম নির্যাতনের শিকার মেয়েদের আত্মা শান্তি পাবে।