প্রবাস জীবনের কথা

প্রবাসী অভিবাসীদের, বছরগুলো দ্রুত যায়। প্রতিদিনের পড়ন্ত বিকেলের মতো। প্রকৃতির দিনের আলো যেমন ১২ ঘণ্টায় হারিয়ে যায়। প্রবাসীদের জীবনের বছরগুলো তেমনি দ্রুত হারিয়ে যায়। খ্রিষ্ট বর্ষের চার মাসের মধ্যেই চলে আসে, এসো হে বৈশাখ-এসো এসো। বাংলা নববর্ষ।
বছর অতিক্রমের দিনগুলো, ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার মতো এগোতে থাকে। সোনালি, বর্ণালি পেছনের দিনগুলোর কোলাহলের চিত্রের ইতিহাস স্মৃতিতে ভাসতে থাকে। সাগরের তরঙ্গের ঢেউয়ের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে যেভাবে ভাসমান থাকে ছোট তরী। প্রবাসী অভিবাসীদের জীবন অনেকটা তেমনি। কঠিন কঠোর প্রতিদিনের লড়াইয়ে পলকেই নতুন বছরের আগমন। শুভ আগমন শুভ বার্তা আদান-প্রদান।
বিমর্ষতা, বিবর্ণতা, নিত্যকার সাথি। প্রবাসী অভিবাসীদের চলমান জীবনের পরিক্রমা এমনই। থেমে নেই সংগ্রাম, থেমে নেই লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের যুদ্ধ। পরিপূর্ণ সার্থক জীবন গড়ার পাশাপাশি দেশের ফেলে আসা পরিবার স্বজনের স্বপ্ন। সময়ের স্বল্পতায় কারও জয়, কারও পরাজয়। হাজারো কল্প চিন্তা নিয়ে, দেশ ছেড়ে বিদেশে আগমন। মমতাময়ী মা, বাবা, স্বজন, বন্ধু, ভালোবাসা, সবই বিসর্জন। ভাবা হয়, বিদেশে কয়েকটি বছর উপার্জন করেই প্রবাসী জীবনের ইতি টেনে ফিরে যাওয়া হবে। কিন্তু প্রবাস জীবনের ইতিহাস ও বাস্তবতা ভিন্ন। লাখো প্রবাসী অভিবাসী, প্রবাসে বছরের পর বছর দিন রাত শ্রম দিয়ে, দেশের পরিবার পরিজনকে স্বাবলম্বী করেছে ঠিকই। কিন্তু তার ভাগ্যে জোটেনি পরিবার স্বজনের নিকটাত্মীয়দের সাক্ষাৎ। ভাগ্যে জোটেনি স্ত্রী-সন্তানের আদর পাওয়ার শুভক্ষণ। অভাগারা ভাগাভাগি করতে পারেনি অভিবাসী জীবনের মর্মান্তিক অনেক কাহিনি। বুকে ধারণ করে রাখা বেদনার গল্পগুলো সঙ্গে নিয়েই বিদায় নিচ্ছেন ইহজগৎ থেকে। নিয়তির ডাকে, পরিহাসের বাক্সবন্দী লাশ হয়েই ফিরে গেছেন অনেক হতভাগা অভিবাসী।
প্রবাসীদের প্রবাস জীবন যদি দুভাগে ভাগ করি। প্রথমে মধ্যপ্রাচ্য, দ্বিতীয় ইউরোপ কিংবা আমেরিকা। দুই ভাগের প্রবাসী অভিবাসীদের জীবন পরিচালনার মান তুলনা বা বিশ্লেষণ কঠিন। ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় বৈধ প্রবাসী অভিবাসীদের মান উন্নত। দেশের চলমান আইনে প্রবাসী অভিবাসী ভোগ করেন সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। স্বাস্থ্য, বাসস্থান, স্বল্প আয়ের ক্ষেত্রে খাবারের, এমনকি চলাফেরার জন্যও সরকারি সহায়তা পাওয়া যায়। কাজের মজুরি সমভাবে নির্ধারণ করা হয়। যদি কেউ কর্মক্ষেত্রে কিংবা যেকোনো ক্ষেত্রে অবহেলা বা বৈষম্যের শিকার হয়, তবে চলমান আইনের আওতায় বিচার নিশ্চিত করা আছে।
পক্ষান্তরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর চিত্র ভিন্ন। বৈধতার সুযোগ নেই। বিভিন্ন গরিব দেশ থেকে চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিকদের নিয়ে আসে। সামান্য মাসিক মজুরি ধার্য করে নিয়ে আসে। অমানবিক, অসামাজিক নির্যাতনের মাধ্যমে প্রবাহিত তাঁদের প্রবাস জীবন। নেই থাকার ভালো ব্যবস্থা, নেই প্রয়োজনীয় শারীরিক চিকিৎসার ব্যবস্থা, নেই কোনো অভিযোগ কেন্দ্র, মধ্যযুগের বর্বরোচিত নিষ্ঠুর আচরণের শিকার তাঁরা প্রতিনিয়ত।
পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থার সামাজিক অ্যাক্টিভিটির পরিবর্তন হলেও, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। বর্তমান যুগের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রতিদিনই চোখে পড়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কোথাও পড়ে আছে প্রবাসী অভিবাসীর অবহেলিত লাশ। কেউ মর্গে অথবা অভাগা কারও লাশ বাথরুমে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। চল্লিশের ঊর্ধ্বে পদার্পণ থেকেই বিভিন্ন রোগের আলামত দেখা দেয়। চোখের দৃষ্টি শক্তির লোপ পেতে থাকে। শরীরে বিভিন্ন রোগের আলামত দেখা দেয়। প্রাথমিক পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক মারাত্মক রোগ নির্ণয় করা যায়। বাঁচানো সম্ভব হয়। মধ্যপ্রাচ্যে অনেকে মারা যায় হার্ট অ্যাটাক করে। কারণ তাঁ;দের অনেকেই জানেন না, তাঁদের অনেকের রয়েছে হার্টের সমস্যা। কোম্পানিগুলোর চেক আপের ব্যবস্থা নেই। যদি নিয়মিত রুটিনে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকত, তবে হাড়ভাঙা পরিশ্রমী অনেকে বেঁচে যেতেন।
উন্নত বিশ্বে সর্বোত্তম সেবা চালু থাকলেও, মধ্যপ্রাচ্যে ন্যূনতমও নেই। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে অমানবিক অসামাজিক নির্যাতনের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসলে, উপকৃত হবে লাখো নিরীহ শ্রমিক। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ায় যাতে মামলা দায়ের করা যায় সেই ব্যবস্থা করলে, অসহায় শ্রমিকেরা লাভবান হবেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সরকারেরও টনক নড়বে।