রাষ্ট্রপতির ধমক!

জিয়াউর রহমান
জিয়াউর রহমান

আচ্ছা বলুন তো, জিয়াউর রহমান কেন সব সময় কালো চশমা পরে থাকতেন?
এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে নিজের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে দু-চারটি কথা বলি। আমি দলীয় রাজনীতি করি না। এ নিয়ে আমার লেখালেখিও কম। কথাটার সত্য-মিথ্যা কখনো যাচাই করার সুযোগ মেলেনি, রাজনীতি নিয়ে লিখতে হলে কোনো এক পক্ষে আপনাকে যেতেই হবে। এখানে ভান-ভণিতার সুযোগ নেই। সর্বজনপ্রিয় সাধু হওয়ারও অবকাশ নেই।
বেশ কিছুদিন ধরে যে বিষয় নিয়ে লিখব ভাবছি, তার প্রধান চরিত্রে আছেন একজন রাজনীতিবিদ- রাষ্ট্রনায়ক। লেখার পর যদি তাঁর অন্ধ সমর্থকদের কোপানলে পড়ি, তা হলে কেমন দাঁড়ায়?
এ নিয়ে দু-এক লেখক বন্ধুর সঙ্গে কথা বললাম। তাঁরা সাহস জোগালেন এ কথা বলে যে, আগেই কেন এত নেতিবাচক ভাবছি। বিষয় যদি সত্য হয়, লিখুন। ইতিহাসতো এভাবেই রচিত হয়।
বিষয় তো শতভাগ সত্য। কোনো ফিকশন বা বানানো গল্প নয়। কারও অমর্যাদা হোক এমন বিন্দু বিসর্গ ইচ্ছাও আমার নেই। শুধু নৈর্ব্যক্তিকভাবে বলার চেষ্টা করব।
শুরুতেই যে কথাটা বলেছিলাম, প্রয়াত জিয়াউর রহমান সব সময় কালো চশমা পরে থাকতেন কেন, এ প্রশ্নটি যিনি আমাকে করেছিলেন, বহুদিন হয় নিউইয়র্কে তাঁকে দেখি না। তিনি আনোয়ারুল ইসলাম, বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, বগুড়া পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে তাঁর মেশার বা ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর প্রশ্নে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। এর উত্তর তো আমার জানা নেই। মাথা নাড়লাম, জানি না।
আনোয়ারুল আমার আরও কাছে এসে নিচু স্বরে উত্তরটি দিলেন। চশমাবিহীন তাঁর চোখে আপনি তাকাতে পারবেন না। চোখ দুটি অগ্নিশর্মা, লাল। এক–দুই পলকের বেশি চাইতে পারবেন না। ভয় পাবেন। এটা জেনেই হয়তো তিনি চশমা পরে থাকতেন, যাতে সহজে সবাই তাঁর কাছে যেতে পারে, কথা বলতে পারে।
আনোয়ারুল ইসলামের এই অভিজ্ঞতা কারও সঙ্গে শেয়ার অথবা এর সত্যাসত্য যাচাই করার কোনো সুযোগ আমার হয়নি।
পরলোকগত সৈয়দ আলী আহসান একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। তাঁর রয়েছে বর্ণাঢ্য জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, সাহিত্য চর্চা, বাংলা একাডেমিসহ নানা দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রয়াত জিয়াউর রহমানের ক্যাবিনেটে ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। তবে তাঁর যে দিকটি আমার খুব ভালো লাগত, তা তাঁর কথা বলা। বাচনভঙ্গি ছিল অপূর্ব। গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলতেন। শুনতে ভালো লাগত। কখনো বিরক্তি বোধ হতো না।
দিন-তারিখ মনে নেই, অনুমান দুই দশক আগের কথা। সৈয়দ আলী আহসান ব্যক্তিগত সফরে এসেছেন নিউইয়র্কে। এ সময় তাঁর সান্নিধ্যে কিছু কিছু মুহূর্ত কাটানোর সুযোগ আমার হয়েছিল। মনে পড়ে, একদিন আমার গাড়িতে ড্রাইভ করে কুইন্সের উডহ্যাভেনে তাঁর মেয়ের বাসায় তাঁকে নামিয়ে দিয়েছিলাম। অন্তরঙ্গ মুহূর্তে অনেক অজানা কথা শুনেছি তাঁর কাছ থেকে।
একদিন স্মৃতিচারণ করলেন মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের। বললেন, জিয়াউর রহমান আচমকা আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি কখনো কাউকে ‘স্যার’ বলে ডাকেন না? তিনি লক্ষ্য করেছেন, ক্যাবিনেটের প্রায় সবাই তাঁকে (জিয়াউর রহমানকে) ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন, একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলাম আমি। আমি তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতাম না। বিষয়টি তাঁর নজর এড়ায়নি। এ ব্যাপারে সরাসরি আমাকে কিছু বলতেও পারছেন না। তাই আজ পরোক্ষভাবে জিজ্ঞেস করে বসলেন। উত্তরে আমি বললাম, ডাকব না কেন? ‘স্যার’ ডেকেছি যখন স্কুলে মাস্টার মশাইয়ের কাছে পড়েছি, ‘স্যার’ ডেকেছি আমার শিক্ষকদের, যাদের কাছে আমি শিখেছি...। উত্তর শুনে জিয়াউর রহমান আর কিছু বললেন না।
আরেক দিন। আসলে দিনে নয়, রাতে। জিয়াউর রহমান তখন দেশের গ্রাম-গ্রামান্তর, শহর-বন্দর ঘুরে বেড়াতেন, জনসভা করতেন, জনগণের অভাব-অভিযোগ, দাবি-দাওয়া শুনতেন। পূরণ করার দিতেন আশ্বাস।
এ সময় একদিন কুমিল্লায় জনসভা করে রাতে ফিরেছেন ঢাকায়। রাত তখন গভীর, দেড়টা বা দুটো বাজে। আমি গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। এ সময় বেজে উঠল লাল ফোন। আমার স্ত্রী জাগিয়ে দিলেন। ফোনের অন্যপ্রান্তে রাষ্ট্রপতি। হ্যালো বলতেই ভেসে এল, কি প্রফেসর সাহেব, ঘুমোচ্ছেন? কুমিল্লার ওই (স্কুল বা কলেজ) প্রজেক্টের অগ্রগতি কি হলো।’ মনে মনে খুব বিরক্ত হলাম। অনুচ্চারিত কটূক্তিও করলাম। মাঝরাতে এটা কি ধরনের ইমার্জেন্সি? যার জন্য ঘুম ভাঙাতে হবে? আসলে কোথাও তিনি (জিয়াউর রহমান) ওয়াদা করে এসেছিলেন সরকারিকরণের, আজ কুমিল্লা সফরকালে তা স্মরণ করিয়ে দিতে মধ্যরাতে এই লাল ফোন।
বললাম, ওটার অগ্রগতি আছে। কাল মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সব জানাতে পারব।
এবার সিলেটে।
পরলোকগত মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সাংবাদিক, সিলেটের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তাঁকে প্রথম দেখি, ষাটের দশকের প্রথম দিকে, যখন আমি মোগলাবাজারের রেবতী রমণ হাইস্কুলে। একদিন স্কুল পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি কৃপেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য জানালেন, মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী স্কুলে আসবেন। তিনি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। স্কুলের সব ছাত্র-শিক্ষকের উপস্থিতিতে মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বক্তৃতা করলেন, এককথায় অনবদ্য। এমন বক্তৃতা এই প্রথম শুনলাম। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতা একটার পর একটা আবৃত্তি করে গেলেন। ‘যেতে নাহি দিব–তবু যেতে দিতে হয়’, ‘ বিদ্রোহী রণক্লান্ত-আমি সেই দিন হব শান্ত’। কবিতার সঙ্গে উদ্দীপনামূলক বক্তব্য, উপদেশ। প্রথম দেখাতেই তিনি আমার প্রিয় মানুষ হয়ে গেলেন।
এরপর অবসরজীবনে তিনি পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, সভা-সেমিনারে বক্তৃতা, রেডিওতে কথিকা লিখে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি ছিলেন সিলেটের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান মুসলিম সাহিত্য সংসদের সভাপতি। আমেরিকা সফরের ওপর তাঁর একটি গ্রন্থও রয়েছে। তিনি কৌতুক করে আমাদের শোনাতেন, আমেরিকানদের আমি বলতাম, তোমরা তোমাদের সৃষ্টি এসব উঁচু উঁচু ভবনের কাছে বন্দী। আমরা আমাদের সৃষ্টির কাছে বন্দী নই। খড়ের ঘর ঝড়-বন্যায় বিধ্বস্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে বানিয়ে নিই আরেকটি।’
আমার পেশাগত জীবনে তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম। দুটি ঘটনার কথা মনে পড়ে, এর একটিতে প্রশংসা, অপরটিতে তিরস্কার জুটেছিল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেদিন পরলোকগমন করেন, সেদিন রেডিওতে ঘোষণার ঘণ্টা খানিকের মধ্যে আমি সোলেমান হলে (কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের মিলনায়তন) শোকসভার আয়োজন করি। সভায় আবেগতাড়িত যে বক্তব্য রাখি তা ভালো লেগে যায় মুসলিম চৌধুরীর। সভা শেষে আমার কাছে এসে খুবই প্রশংসা করলেন, বললেন, তুমি একটা কাগজে বক্তৃতার সারমর্ম লিখে দিয়ো, আমার কাজে লাগবে।
তিরস্কৃত হয়েছিলাম যে কারণে, তা আমার প্রাপ্যই ছিল। প্রাচীনতম সাপ্তাহিক যুগভেরীতে কাজ করতাম। যুগভেরীর নিজস্ব স্টাইল বুক ছিল, যা সম্পাদক আমীনুর রশীদ চৌধুরী নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এই যেমন, এর ভাষা সাধু, জনাব-বেগম-শ্রী-শ্রীমতি লেখা যাবে না, এর পরিবর্তে মি.–মিসেস-মিস লিখতে হবে।
যুগভেরীতে ছাপার জন্য একটি প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলেন মুসলিম চৌধুরী। ঝরঝরে চলতি ভাষায় লেখা। তাঁর হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর। ভাষা ছিল সাবলীল, গুছানো। যুগভেরীর স্টাইল বুক রক্ষা করতে গিয়ে আমি একে সাধু ভাষায় রূপান্তর করলাম। কিন্তু তা করতে গিয়ে লেখার সৌন্দর্য, গতি-ছন্দের যে বারোটা বাজিয়ে ফেলেছি, তা খেয়াল করিনি। এবং তা করেছি লেখকের অনুমতি ছাড়া। নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হলো। মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীও আমাকে ছাড়লেন না। অত্যন্ত মার্জিতভাবে রাগ প্রকাশ করে বললেন, ‘চেয়ে’ কে ‘চাইতে’, ‘থেকে’ কে ‘হইতে’—এসব সাধু কোথায় পেয়েছ।
আমি ক্ষমা চেয়ে নিলাম এবং প্রতিজ্ঞা করলাম আর কখনো কারও লেখা চলতি থেকে সাধু করতে যাব না।
সিলেটে সে সময় যত সরকারি-বেসরকারি সভা-অনুষ্ঠান হতো, তাতে সুধী সমাজের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিজীবী ও মুরব্বি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। সত্তরোর্ধ প্রবীণ এই নাগরিককে সবাই শ্রদ্ধা করতেন। সব জায়গায় তিনি উপদেশমূলক কিছু কথা বলতেন। সবাই তা শুনতো। তাঁর বক্তব্যের প্রতি সম্মান জানাতো। এভাবে আমিও দেখে আসছি। কিন্তু এক সময় এসে হোঁচট খেলেন, শুধু হোঁচট নয়, ধমক, রাষ্ট্রপতির ধমক।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একবার সিদ্ধান্ত নিলেন, রাজধানী ঢাকার বাইরে তাঁর মন্ত্রিসভার বৈঠক করবেন। সে অনুযায়ী সিলেটে অনুষ্ঠিত হলো মন্ত্রিসভার বৈঠক। বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় সিলেট সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হলো রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সুধী সমাজের মতবিনিময় সভার। এ সভায় আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলাম আমিও। মাঝখানে বসে আছেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, তাঁর দুই পাশে মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ। সামনে আমরা। এবার সুধী সমাজের বলার পালা। মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী দাঁড়িয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বক্তব্য শুরু করলেন। তাঁর বক্তব্যে যেভাবে থাকে কিছু ভূমিকা, কিছু উপদেশ। মিনিট পুরো না হতেই মন্ত্রিসভার সদস্য নূরুল ইসলাম শিশু মুসলিম চৌধুরীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, এ ধরনের বক্তব্য না দিয়ে তাঁর প্রশ্ন কী, তা পেশ করার জন্য। কিন্তু মুসলিম চৌধুরী তাঁর স্বভাবসুলভ গতিতে তাঁর কথা বলতে থাকলেন।
দ্বিতীয়বার নূরুল ইসলাম শিশু তাঁকে থামানোর চেষ্টা করলেন এবং বললেন প্রশ্ন করুন, বক্তৃতা নয়। কিন্তু দ্বিতীয়বারও সফল হলেন না। এবার রাষ্ট্রপতি। হাতের অঙ্গুলি উঁচিয়ে মুসলিম চৌধুরীকে ধমকের সুরে বললেন, বসেন, বসেন। হতভম্ব-হতচকিত মুসলিম চৌধুরী বসে পড়লেন। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণের জন্য সমাবেশে সুনসান নীরবতা। সভা আবার সচল হলো আরেক সুধীর প্রশ্নের মধ্য দিয়ে।
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।