শবে বরাতে করণীয়

শবে বরাতের বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা কোরআন শরিফ ও হাদিসের আলোকে প্রমাণিত। আমরা আল্লাহর বান্দা। বন্দেগিই আমাদের কাজ। বান্দার ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট দিন ও রাত আল্লাহ তায়ালা দান করেছেন। দিনের মধ্যে ঈদ-উল-ফিতর, ঈদে মিলাদুন্নবী (স.), আশুরার দিন, আরাফার দিন, জুমার দিন। রাতের মধ্যে শবে কদর, শবে মিরাজ, শবে বরাত, দুই ঈদের রাত। লক্ষ্য করা যায়, বিভিন্ন সরকারও বছরে কিছু কিছুদিন ধার্য করে কয়েদিদের মুক্ত করার জন্য। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তেমনি এসব দিন ও রাত। মূলত এই দিবস ও রজনী আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় নবী (স.)-কে দেওয়া আল্লাহর বিশেষ উপহার। এসব উপহারের মর্যাদা যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের সৌভাগ্য অর্জন করা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

শবে বরাত: শব অর্থ রাত বরাত অর্থ ভাগ্য—অতএব এর সমষ্টিগত অর্থ হলো ভাগ্যের রাত বা ভাগ্য নির্ধারণের রাত। এ ছাড়া শবে বরাত মুক্ত হওয়া বা বিচ্ছেদের রাত অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেহেতু, অপরাধীরা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত থাকে। এ ক্ষেত্রে বান্দার বন্দেগির সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়। আর আল্লাহর ওলিগণ পার্থিব অপমান-লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত হয়ে যায় (ইবনে মাজাহ)। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতই শবে বরাতের রাত। শাবান অর্থ শাখা-প্রশাখা হওয়া। অর্থাৎ মাহে রমজানের অবারিত কল্যাণ ও বরকত হাসিলের বিভিন্নমুখী দ্বার খুলে দেওয়া হয়। আর তাই রসুলে করিম (স.) রজব মাস থেকে দোয়া করেছেন। হে আল্লাহ, রজব ও শাবানের অবারিত কল্যাণ ও বরকত দান কর এবং রমজান পর্যন্ত পৌঁছার তৌফিক দান কর।
পবিত্র কোরআনের আলোকে শবে বরাত: সুরা দুখানের ৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি একে (কোরআন মজিদকে) বরকতপূর্ণ রাতে নাজিল করেছি।’ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (র.), আবু হুরায়রা (রা.), হজরত ইকরামা (রা.)-সহ বহু সাহাবি-তাবেয়ির মতে, ১৪ শাবান দিবাগত রাতকেই বোঝানো হয়েছে।
হাদিস শরিফের আলোকে শবে বরাত: আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হা-মিম অর্থাৎ আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন কিয়ামত পর্যন্ত যা ঘটবে।
কিতাব-সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ! লাইলাতুল মুরাবকাহ হলো-শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত, আর তাই লাইলাতুল বরাত (গুনিয়াতুত তালিবিন)। ইকরামা (রা.) বলেন, রাসুল (স.) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা জিবরাইল (আ.)-কে ওই রাতে প্রথম আকাশে প্রেরণ করেন। ওই রাত হলো শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাত। এ রাতকে মোবারক নাম রাখার কারণ হলো যেহেতু ওই রাতে বরকত কল্যাণ নাজিল হয়। (গিয়াসুল লুগাত)। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় রাসুলে করিম (স.) ইরশাদ করেছে, যখন শাবানের ১৫ তারিখ হয়, সে রাতে আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়িয়ে ইবাদত কর, দিনে রোজা রাখ। কেন না, এ রাতে সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমান থেকে বলতে থাকেন কেউ কী আছে ক্ষমাপ্রার্থী, যাকে আমি ক্ষমা করব? রিজিক প্রার্থী কেউ আছে কী, যাকে আমি রিজিক দেব? বিপদগ্রস্ত কেউ আছে কী? যাকে আমি সুস্থতা দান করব। এমনিভাবে সুবেহ সাদিক পর্যন্ত আল্লাহর তরফ থেকে বান্দাদের উদ্দেশ্য ঘোষণা হতে থাকে। (ইবনে মাজাহ)
শবে বরাতে যা যা করণীয়: বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়—এ রাতে আমাদের করণীয় কী। নিম্নে বিশদ আলোচনা করা হলো-
ইবাদত করা: এ রাতে গোসল করা মোস্তাহাব, গোসলের পর দুরাকাত তাহিয়াতুল অজুর নামাজ, অতঃপর দুরাকাতের নিয়তে প্রত্যেক রাকাতে আলহামদু (সুরা ফাতিহা) সুরা ইখলাছ সহকারে ৮ রাকাত নামাজ পড়তে হয় বলে বর্ণিত আছে। আরও দুই রাকাত নামাজ আছে, যিনি পড়বেন তাকে আল্লাহ তায়ালা তিনটি পুরস্কার দেবেন। ক. রিজিক বাড়িয়ে দেবেন। খ. দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করবেন। গ. গুনাহ মাফ করবেন।
রোজা রাখা: রোজা রেখে ইবাদত করা, ইবাদত করে রোজা রাখা-দুটোই উত্তম। কেন না, সারা দিন রোজা রেখে ইবাদত করলে ইবাদতে মন বসে। যাবতীয় গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। কোরআন তিলাওয়াত করতে হবে। রিজিকের জন্য দোয়া করতে হবে। তওবা করতে হবে। তওবা তিনটির সমন্বয়ে হয়- ক. কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে হবে খ. পাপ সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে হবে এবং গ. ভবিষ্যতে পাপ না-করার অঙ্গীকার করতে হবে। উভয় জাহানের কল্যাণ কামনা করতে হবে। নফল নামাজ পড়তে হবে।
কবর জিয়ারত করতে হবে। কবর জিয়ারতের নিয়ম হলো ক. একবার সুরা ফাতিহা খ. তিনবার সুরা ইখলাছ গ. ১১ বার দরুদ শরিফ। আল্লাহর রহমত কামনা করতে হবে। কেননা, আল্লাহর রহমত না-হলে এ রাতে কোনো ইবাদতই করতে পারব না। আর ইবাদত করার পর কবুল হবে না কারণ, আল্লাহর রহমত না-হলে ইবাদত কবুল হবে না। এ জন্য ইবাদতের বড়াই বা অহংকার করা যাবে না।
এ রাতে আমাদের বর্জনীয়: আতশবাজি, অপ্রয়োজনীয় আলোকসজ্জা, হালুয়া রুটি এ রাতেই বানাতে হবে —এমন ধারণা দূর করতে হবে। শিরনি বা জিয়াফতের নিয়মে খাদ্য পাকানো বা অন্য যেকোনো খাদ্যোপকরণ শুধু এ রাতেই নয়, অন্য যেকোনো দিনও তা করা যেতে পারে। মসুর ডাল পাকাতে হবে এ ধারণাও দূর করতে হবে। শবে বরাতে প্রচুর শিরনি বানাতে গিয়ে মহিলাদের ইবাদত থেকে বঞ্চিত রাখার প্রথা বর্জন করতে হবে। হিন্দু, খ্রিস্টান ও ইহুদি তথা সবাই মনে করে, নবী মোহাম্মদ (স.)-এর উম্মত সবাই যদি এ রাতে ইবাদত করে, চোখের পানি ফেলে দোয়া করে, তবে তাদের দোয়া কবুল হবে এবং এদের সঙ্গে আমরা বিজয়ী হতে পারব না। তাই তারা তরুণদের হাতে সুকৌশলে আতশবাজি, পটকা তুলে দিয়েছে যাতে মোহাম্মদ (স.)-এর উম্মতেরা ইবাদতে একাগ্রতা ও মনোযোগ হারিয়ে ফেলে, আর এভাবে দাবিয়ে রাখা যাবে। অতএব, আগে থেকেই কিশোর, যুবক ও অজ্ঞ লোকদের বোঝাতে হবে। সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মসজিদে, মহল্লায়, বাসায় ওয়াজ মাহফিলে আগে থেকেই এ রাতের করণীয় ও বর্জনীয় দিকগুলো বুঝিয়ে দিতে হবে।
খালেছ তওবা ব্যতীত যাদের দোয়া এ রাতে কবুল হবে না—মুশরিক: যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করে। মনে করে অর্থনীতি, সমাজনীতি ও রাজনীতিতে মানুষ বা শয়তানের দেওয়া ব্যবস্থাই সঠিক। তারা যদি এ রাতে খালেছ তওবা করে এভাবে যে, আল্লাহ সার্বভৌমত্বের মালিক, তিনিই বিধানদাতা, আইনদাতা, রিজিকদাতা—তবে তার দোয়া কবুল হতে পারে। 
জাদুকর ও ব্যভিচারী: খালেছ তওবা ব্যতীত জাদুকর ও ব্যভিচারীকে এ রাতে ক্ষমা করা হবে না। জিনা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে-চোখের জিনা, অন্তরের জিনা, শারীরিক জিনা। এ তিন জিনাকর্মে কমবেশি সমাজের অনেকেই লিপ্ত। ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে রক্ষা করে সমাজকে রক্ষার জন্য সম্মিলিত প্রয়াস চালাতে হবে। এটাই তওবা, আর তওবার পর ইনশা আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল হবে।
সুদখোর: যে ব্যক্তি সুদ খায়, দেয় ও সাক্ষী হয়—সবাই হারামে লিপ্ত। সুদি কারবার হলো আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করার শামিল। তাই এ নিষিদ্ধ কর্ম তওবা করে পরিহার করতে হবে। তবেই ক্ষমা আশা করা যাবে। ✴মাদকাসক্ত: আল্লাহ মদ হারাম করেছেন, যারা মদসহ অপরাপর হারাম নেশা গ্রহণে অভ্যস্ত, খালেছ তওবা ব্যতীত তাদের দোয়াও কবুল হবে না। 
গণক: গণক ও গণকের কথায় যারা বিশ্বাস করে তাদের দোয়া তওবা ছাড়া কবুল হবে না। 
হিংসুক: খালেছ তওবা ছাড়া এদের দোয়াও আল্লাহ কবুল করবেন না।
বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান: যে সন্তান মা-বাবাকে কষ্ট দিয়েছে যতক্ষণ না তাদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেবে ততক্ষণে তাদের দোয়া কবুল হবে না।
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী: যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপন করে, আত্মীয়ের হক আদায় করে না, তাদের দোয়াও আল্লাহ কবুল করবেন না। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের এ জাতীয় কোনো শ্রেণির কোনো একটিতে শামিল না-করেন। এ শ্রেণির লোকদের আগে থেকেই খালেছ তওবা করে পাপ কাজ পরিহার করে এ রাতের বরকত লাভের আশায় নিজেদের সংশোধন করে নেওয়া উচিত। অন্যথায় দোয়া কবুলের এই রাতে তাদের কোনো আবদারই আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না।
শবে বরাত ও সামাজিক গুরুত্ব: আমাদের সমাজে মিলাদুন্নবী (স.), আশুরা, শবে মিরাজ, মাহে রমজান মুসলমানদের মধ্যে দ্বীনি প্রেরণা ও দ্বীনি মানসিকতা সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ মদদ জোগায়। কাউকে কাউকে কখনো মসজিদে দেখা যায় না। কিন্তু তাকে এ রাতে ভালো পোশাক পরে মসজিদে আসতে দেখা যায়। তারা এসে ওয়াজ শোনে, মুসল্লিগণ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আলেমদের ওয়াজ শোনেন। কোরআনের তাফসির ও হাদিস শোনেন। সবার সঙ্গে দুহাত তুলে মোনাজাত করার ফলে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে। মাতা-পিতার কবরের পাশে গিয়ে কাঁদে। হতে পারে এতে তার জীবনের মোড় ঘুরে যাবে। অতএব এ সুস্থ মানসিকতাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। সর্বোপরি এ রাতে ইবাদত কবুল হবে, যদি আমরা সারা বছর ইবাদত করি। বোনাস তো তারাই পায় যাদের চাকরি আছে। সারা বছর যে চাকরি করেনি, সে কী করে বোনাস পাবে? এ কথা তো এ রাতের মাহফিলে অনেকের কাছে পৌঁছানো যেতে পারে। তাই আসুন, আমরা সবাই খালেছ তওবা করে এ রাত থেকে ধন্য হই।