বাংলার বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি ঘাটু গান

কথায় আছে বার মাসে তেরো পার্বণের দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এমনি এক পার্বণ হচ্ছে পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ। বাংলার প্রথম ঋতু বৈশাখ, নববর্ষকে ঘিরে বাংলার সংস্কৃতির রূপ বদলায়। কারণ তার সঙ্গে আছে বাঙালির দীর্ঘকালের সাংস্কৃতিক বন্ধন। হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। প্রত্যেক জাতির রয়েছে তাদের নিজস্ব ভাষা, আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তেমনি বাঙালির মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাঙালির সংস্কৃতি। তাই আমরা নববর্ষকে বরণ করি নানা উৎসবের মাধ্যমে। হালখাতা থেকে শুরু করে বৈশাখী মেলা, নাচ-গান, মঞ্চনাটক, পথনাটক, আবৃতি, শিল্পকলা প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়।
প্রাচীনকালে নববর্ষ পালনে আরও একটি সংস্কৃতি যোগ হতো। তা ছিল ঘেটু গান বা ঘাটু গান। ঘাটু গানের সঙ্গে নাচটা ছিল খুবই উপভোগ্য। একটা অল্প বয়সী ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে সহজ নাচের মুদ্রা শিখিয়ে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে বাইজির নাচের মতো করে এই অনুষ্ঠান হতো। বঙ্গজ ঢোল, হারমোনিয়াম, বেহালা, মন্দিরা, বাঁশি—এসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হতো। বাড়ির আঙিনায় গোলাকার প্যান্ডেল সাজিয়ে শ্রোতারা বসে উপভোগ করত ঘাটুর গান, দেখতেন আর শুনতেন নাচের মুদ্রার সঙ্গে ঘুঙরুর আওয়াজ। দর্শকদের মাঝ থেকে কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে ঘাটুকে মুদ্রা ছুড়ে দিতেন, এমনই রেওয়াজ ছিল।
এক সহজ বর্ণনায় বলা হতো, ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে যে গান গীত হতো, সেটাই ঘাটু গান।
প্রাচীন যুগে সামন্ত প্রভুরা অন্দরমহলে বাইজির নাচ-গানের আয়োজন করত। তাতে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। তখন কিছু মধ্যবিত্ত শৌখিন যুবকের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে ঘাটু গানের প্রচলন। ঘাটু গান মূলত ছুকরাভিত্তিক গান, বারো থেকে পনেরো বছরের ছেলে ছুকরাকে ঘাটু বানাবার জন্য মেয়েলি চেহারার ছেলেকে ঘাগড়ি বা শাড়ি পড়িয়ে ম্যাচিং করা ব্লাউজ, কানে দুল, দুহাতে রঙিন রুমাল বেঁধে মঞ্চে উঠানো হতো। ঘাটুর নাচে অঙ্গভঙ্গি ছিল দর্শক মনোরঞ্জনের প্রধান আকর্ষণ। সেই সঙ্গে একজন গানের সুন্দর কণ্ঠধারী লোক থাকত, যে ঘাটুকে পোষণ করত। ঘাটুগান সাধারণত রাধা কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে রচিত হতো।
যেমন শ্যাম বলছে এমন—
নারী তো বেইমানের জাত গো
তোর বাড়ি আর যাইমু না
রাই বলে-পুরুষ তো বেইমানের জাত গো
আসবার কইয়া আইল না।
পয়সার কথা কইয়ারে কইয়া
প্রেম করিল শুইয়ারে শুইয়া
পয়সা দিল না।
২) তুই আমারে চিনলে নারে
আমি তো রসের কমলা।
বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি
মধ্যে নলের বেড়া।
৩) ঘুমাইলা ঘুমাইলারে বন্ধু
পান খাইলায়না
এক বালিশে দুইটি মাথা
সুন্দর কইরা কওরে কথা।
ঘাটু গানের মধ্যেও আবার মালজুরা গানের প্রভাব দেখা যায়। অনেক গানে আবার কবিগানেরও ছোঁয়া মিলে। ঘাটু গান সাধারণত প্রেম আর রসাত্মক গানের সমন্বয়ে গীত হতো।
ঘাটুকে গানে সাহায্য করতে একজন লোকের প্রয়োজন হতো, যাকে স্থানীয় ভাষায় মরাধার নামে সম্বোধন করা হতো। মরাধার ঘাটুর সঙ্গে নেচে নেচে তাকে প্রশ্ন করত, ঘাটুকে গানের মাধ্যমে তার উত্তর দিতে হতো। অনেকটা মালজুরার মতো।
ঘাটু গানের প্রচলন কবে, কখন শুরু হয়েছিল—তা সঠিক করে বলা মুশকিল। তবে কারও কারও মতে বৃহত্তর সিলেটের আজমিরীগঞ্জের উদয় আচার্য ছিলেন ঘাটু গানের প্রবর্তক। তাঁর মাধ্যমে ঘাটু গানের প্রবর্তন হয়। তখন ঘাটু গান গাওয়া হতো পূজা বা অর্চনার মতো একটি পবিত্র মাধ্যম হিসেবে। তার মৃত্যুর পর এই ঘাটু গানকে বাণিজ্যিক করে বেশ জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হয়। আদি রসাত্মক কথাবার্তা চালু করে অনেক গান রচনা করা হয়। এর ফলে ঘাটু গানটা তার আগের ধরন ছেড়ে নতুন এক ধরনের গানে চলে আসে। যার পরিপ্রেক্ষিতে গানগুলো লোকের মুখে মুখে গীত হতে থাকে। গানগুলো হলো—
১) ভাইছাব আমায় জলে ভাসা
সাবান আইন্না দিলায়না
সাবান আছে ঘরে পরে
তার পরোয়া কেবা করে।
২) আইও বন্ধু বইও পাশে
মুখে দিয়া পান
দেইখ্যা যাওরে ঘাটুর নাচন
পূর্ণিমারও চান।
৩) পালং সাজাও প্রাণ সজনি
আসব তোমার কুঞ্জে।
৪) আইস বন্ধু বইস পাশে
হাত দিয়োনা ডালিম গাছে।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শৈশবে লেটু দলে যোগ দেন, পরবর্তীতে লেটু গানের ওপর তাঁর রচিত রাজপুত্রের সং, চাষার সং, আকবর বাদশাহ—এসব লেখায় যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে ঘাটুগানের সঙ্গে লেটু গানের দারুণ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। শুধু স্থান কাল ভেদে যদিও কথা এবং সুরে কিছু পার্থক্য লক্ষণীয়। ঘাটু গান ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করে সিলেটের সীমানা অতিক্রম করে সারা দেশের গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পরে। ঘাটু গানের বিভিন্ন পর্যায় আছে—যেমন রংবাউলা, মুড়ালি, বিচ্ছেদ। প্রত্যেক গানের সঙ্গে তাল-লয় ঠিক রেখে ঘাটুকে নেচেগেয়ে দর্শকদের বাহবা অর্জন করে।
আমাদের কৈশোরে সিলেট অঞ্চলে তখন ঘাটু গানের সংস্কৃতির যৌবন তলানিতে চলে আসে। আষাঢ়ের বর্ষার অথই পানিতে আমাদের এলাকায় নৌকা বাইচের প্রচলন ছিল। অনেক দূরের গ্রামাঞ্চল থেকে সুন্দর কারুকার্য খচিত নৌকাগুলো সারিগানের মহড়ার মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় যোগ দিত। হাওরের বিরাট অংশে নৌকা বাইছ প্রতিযোগিতা হতো। হাজার হাজার দর্শক ছোট ছোট নৌকায় বসে প্রতিযোগিতা উপভোগ করত। হাওরের অন্য পাশে বসতো ঘাটু গানের আসর। দুটো খোলা নৌকা একসঙ্গে জড়ো করে তার ওপর পাটাতন লাগিয়ে মঞ্চ তৈরি করা হতো। ওপরে চাঁদ-তারা খচিত শামিয়ানা খাঁটিয়ে রঙিন কাগজের নিশান দিয়ে মঞ্চটা আরও আকর্ষণীয় করা হতো, তারই মধ্যে চলতো ঘাটু গানের আসর।
আমরা ছোট নৌকায় চড়ে দূর থেকে উঁকি দিতাম, তখন কানে বাজত চিকন কণ্ঠের গান আর উচ্চ শব্দে ঢোল হারমোনিয়ামের আওয়াজ। চোখে ভাসত কিছু মাশুলধারী মাস্তান টাইপের লোক লাঠি সুলফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা তখন সত্যিই ভয়ে ত্বরিত স্থান ত্যাগ করতাম। পরে অবশ্য গল্প শুনেছি, একদল মাস্তান লোক নাকি ঘাটু শিকারি থাকে, তারা কখনো অতর্কিতে ঘাটুকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। যার দরুন অপর পক্ষের এই সতর্কতা। তারপর গল্প শুনতাম, ঘাটু নাকি বেচাকেনাও হতো। এখন বুঝতে পারি, এটি মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। এখন মনে হয় এই ব্যাপারটা আর সংস্কৃতির মধ্যে ছিল না। ঘাটু গানের যে লোকজ ঐতিহ্য ছিল, তা যেন ধীরে ধীরে লোকজ স্মৃতির অগোচরে এক অপসংস্কৃতির রূপ ধারণ করেছিল।
ঘাটুদের নিয়ে নানা ধরনের যৌন লালসা চরিতার্থ করত এক ধরনের বিকারগ্রস্ত প্রভাবশালী মানুষ। এর ফলে সমকামিতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে, যা কখনো বাংলার ধর্মপ্রাণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি বা প্রত্যাশা করেনি। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে ঘাটু গানের সংস্কৃতি।
প্রাচীন ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক চন্দ্রা কুমার দে বলেন, ঘাটুদের কেনাবেচা ও দর্শকদের কাছে নোংরাভাবে প্রদর্শন করা নিয়ে সমাজে নানা সংঘাত দেখা দেয়। ঘাটুদের যৌন আকর্ষণীয় করে তুলে অপসংস্কৃতির দোরগোড়ায় পৌঁছাতে সহায়তা করে।
আসল ঘাটু গান হারিয়ে যাওয়া আরও দশটা লোকালয়ের মতো মুছে গেছে আমাদের যাপিত জীবনের পাতা থেকে। প্রমত্তা নদীর ভাঙনের উপাখ্যানে রূপ নিয়েছে। আজকাল বাংলার আনাচেকানাচে যে ঘাটুগানের উল্লেখ আমরা পাই, তা অনেকটা আমাদের অগ্রজদের হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপি থেকে তুলে আনা আসল ঘাটু গানের সংকল্পিত কিছু অনুরণন।