আছিয়া

সকাল থেকেই অপেক্ষায় আছি আছিয়ার জন্য। ঘরের সব কাজ পড়ে আছে। আমাকে যেতে হবে বাইরে। দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ে সদ্য মারা যাওয়া নুসরাতের বিষয়ে কিছু নতুন তথ্য নিয়ে আলোচনা আছে পত্রিকা অফিসে। এদিকে আছিয়া দেরি করছে। এই দেরি দেখে আমার ধৈর্যের বাঁধ যেন ভেঙে যাচ্ছে। কোনো রকমে এক কাপ চা বানিয়ে সঙ্গে পাউরুটি টোস্ট করে খাচ্ছি এমন সময় এল আছিয়া।

ঢুকেই বলল, ‘আফা, গরিবের ঘরে তো টেলিভিশন নাই, তাই মনে চাইলেও কামের শেষে দেখনের উপায় নাই। এক খালাম্মার বাসায় কামের ফাঁকেই উঁকি দিয়া খবর দেখছি, তাই দেরি হইয়া গেল। আপনের কামের দেরি হইতাছে; কী জরুরি কাম আছে কইয়া ফালান।’

আমি লক্ষ্য করলাম আছিয়া কিছুক্ষণ বিড় বিড় করে হঠাৎ গর্জে উঠে বলছে, ‘আমরা যদি কলঙ্কিত হই, আমাগো আবার ইজ্জত...! আমাগো নাম কি পেপারে লিক্ষা পেপার নষ্ট করব পেপারওয়ালারা? গরিবের জন্য কি আর পুলিশ আছে আফা? হেই ছেরিরে আফনেরা সুবিচার দিবেন, আর আমরা কামের বেডি, আমার লাইগা বিনা পয়সায় কেডা কথা কইব? আমার ঘটনা তো আর সমাজে হইচই ফালাইব না। যাক বাদ দেন; এখন জরুরি কী কাম সারতে হইব কন।’ আমি কিছুক্ষণের জন্য সমাজ নিয়ে চিন্তা করলাম। সত্যি তো, আছিয়াদের জীবন নিয়ে কি কেউ কখনো তুমুল আলোচনায় মেতেছে? আমি সময় নষ্ট না করে ওকে বললাম, ‘তুমি আমাকে বলবে কি তোমার সাথে এমন কী ঘটনা ঘটেছে যে, তুমি এতটা রিঅ্যাক্ট, মানে উত্তেজিত হচ্ছ?’
-আফা আপনের কামেরও দেরি হইছে, আমারও কামের বেনাল হইল। বাদ দ্যান।
-তবুও তুমি বল; আজ আর কাজে যাচ্ছি না।
-আফা গরিব আছিলাম দেইখ্যা ৯/১০ বছরে কাম শুরু করছি। মায়ের লগে কামে যাইতাম। মা আমারে কামে রাইখ্যা অন্য জায়গায় যাইতগা। হেগো কাম সাইরা বিবিসাব, সাব হেগো হাত পা মালিশ করতে কইত। সাবে হুদাই শরীরে হাত দিত। মায়েরে কইলে কয়দিন আর হেই বাসায় যাওয়া বাদ দিসি। যহন ১৩/১৫ বছর; এক পুলিশের বাসায় কাম করতাম। হেগো পোলা মনে হয় আমার থিকা ইকটু ডাঙ্গর আছিল। হ্যায় আমারে পিরিতের ফান্দে পোয়াতি বানাইল। তিন-চাইর মাস যখন, মায় বিবিসাবেরে কইতেই মায়েরে আর আমারে পিডাইল। পরে অন্য বাসার আফার বুদ্ধিতে মায়ে গিয়া কইছে আছিয়া আফনের বাসায়ই শুধু বান্দা কাম করছে, এহন আমি মাইনষেরে কইয়াা দিমু। অনেক ঝগড়ার পর বেডি মায়েরে কয় তোরে বাচ্চা ফলনের টাকা দিলে তুই আবার আসবি। কাল সকালে আসবি। আমি হসপিটালে নিয়া যামু। পরদিন মা আর আমারে বাসে কইরা নিয়া গেল। এক বেডা আর বেডি আইল গাড়ি দিয়া। হাসপাতালের ডাক্তারে কয়, এহন বাচ্চা ফালাইন কঠিন হইব, মইরা যাইতে পারে। বেডি কয় হের জামাই পুলিশের ডিআইজি; টেকা দিয়া সব ঠিক কইরালাইব। যহন হুঁশ ফিরছে, দেহি আমি গাড়ির সিটে শুইয়া আছি। ডাইবার নিয়া গেল বেগমসাবের বাসায়। দুই দিন রাখছে সেইহানে। কিন্তু কুত্তার মতো ব্যাবহার করছে। পরে কয় বাসাত থিকা বাইর হ। এই এলাকার ধারে কাছে আইবি তো চুরির কথা কইয়া জেলে দিয়া দিব। ডরে কোনো রকমে হাঁইটা ঘরে আইছি। আরেকবার হাসপাতালে কাম করে হেগো ঘরে কাম করনের সময় জোর কইরা থাইকা যখন পেটের কথা কইছি কী জানি ওষুধ দিছে। আফা, খাইয়া শরিলের সব রক্ত শেষ হইয়া গেছে। দুইবার বিয়া করছি। বাচ্চা অয় না দেইখ্যা ছাইরা দিছে। আমিও এহন আর সংসার করতে চাই না।’

শুধু আছিয়া না আমাদের সমাজে এমন হাজারো শিশু, কিশোরী বা নারী আছে, তাদের জন্য কখনো সমাজ ভাবে না। আছিয়ার কথাগুলো আমার ঘরে যেন গুঞ্জন করছিল। আমাকে যেন ধিক্কার দিয়ে বলছিল নারী হয়ে নারীর সম্মান আমরা যদি না করি, তা হলে আমিও একজন পশুর মতোই তো হলাম। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে লিখতে বসলাম আছিয়াকে নিয়ে, একটা পরিত্রাণের আশায়। যদি মানুষ জাগে; একটু হলেও।