জায়ান, এমন শোক তো প্রাপ্য নয়

জায়ান চৌধুরী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
জায়ান চৌধুরী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

প্রিয় জায়ান, গত কয়েক দিনে কম্পিউটারের স্ক্রিনে যতবার আমার চোখ পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা রাতের আকাশের লাখোকোটি তারার আলোর ঝলকানি ও সৌন্দর্যের চেয়েও বহুগুণ সুন্দর তোমার মায়াবী দু চোখে চোখ রাখতে চেয়েছে, ঠিক ততবারই আমার দু চোখ অশ্রুতে ভরে গেছে। বাঁধভাঙা পানির মতো আমার সে অশ্রু মুখমণ্ডল বেয়ে তোমাকে নিয়ে লিখে চলা কাগজ ও কলমের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। বিশ্বাস করো জায়ান, সেই অশ্রু ও কাগজ-কলমকে আমি আলাদা করতে পারিনি। হৃদয়কে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া সে সীমাহীন কষ্ট ও বেদনাকে এ ক্ষুদ্র লেখনীর মাধ্যমে আদৌ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। জায়ান, আমি জানি না গত কয়েক দিনে কত অসংখ্যবার আমি তোমার ছবিটি দেখেছি। যতই দেখি, মনে হয় আরও দেখি। তোমার ওই ভুবনভোলানো হাসিমাখা মুখ দেখে ক্লান্তি আসে না। আমি দীর্ঘ সময় নিয়ে তোমার দু চোখে চোখ রেখে তার বিস্ময়ভরা অভিব্যক্তি পড়তে চেয়েছি। কি আছে সেখানে? অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা এ পৃথিবী ও তার সৃষ্টির কাছে নিঃশঙ্কচিত্ত তোমার বিস্ময়মাখা আবেদন, আকাঙ্ক্ষা, কৃতজ্ঞতা, নাকি আর কিছু?
বিশ্বাস করো জায়ান, পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ওই হাসি ও সীমাহীন তৃপ্ত মুখমণ্ডল দেখে তোমার অভিব্যক্তি বোঝার আগেই বারবার আমি নিজেকে হারিয়েছি। মনে হয়েছে, পৃথিবীর সব সৌন্দর্য, লাবণ্য ও বিস্ময় তোমার ওই ছোট্ট মুখখানিতে এসে ভর করেছে। কে বলে লিওনার্দো-দা-ভিঞ্ছির ‘মোনালিসা’ই পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় চিত্রকর্ম? বিশ্বাস করো জায়ান, আজ এই এখন থেকে তোমার এ হাসিমাখা ছবিটিই আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ও রহস্যঘেরা প্রতিমূর্তি। আমি বিশ্বাস করি যে, তোমার এ ছবিই স্মরণকালের সব সেরা চিত্রকর্মকে হার মানাবে।
অথচ এই রহস্যময় ছবি আমরা চাইনি। আমরা নিঃসন্দেহে তোমার প্রস্ফুটিত জীবন ও আলোকিত ভবিষ্যৎ দেখতে চেয়েছিলাম। বাবা-মায়ের কোল আলোকিত করে যে তুমি এ সুন্দর ধরণিতে পা রেখেছিলে, সেই তুমি তোমার আলোর ঝলকানিতে পরিবার-পরিজন ছাড়িয়ে আশপাশের সমাজ ও একসময় প্রিয় মাতৃভূমির সর্বত্র ছড়িয়ে দেবে—এটাই তো আমরা দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেন এমন হলো?
মাত্র আট বছর বয়স। বিস্ময়ভরা চোখ দিয়ে তুমি হয়তো পৃথিবীকে বলেছিলে, ‘তোমাকে আবিষ্কার করব।’ হায় কপাল! কী নিষ্ঠুর! এই পৃথিবীই কিনা তোমাকে বিহ্বল করে দিল। কিন্তু এভাবে তো তুমি কখনো বিস্মিত হতে চাওনি। মানুষ নামধারী কিছু নরপিশাচ, বিপথগামী হায়েনার দল ফুলের পাপড়ির মতো তোমার সুন্দর দেহটাকে মুহূর্তেই তছনছ করে দিল। কিন্তু কেন? তুমি ছিলে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ এবং তোমার মতোই অন্যরাও। তুমি তো কোনো অপরাধ করোনি জায়ান। তোমার মতো এক নিষ্পাপ শিশুকে মানুষ নামের কলঙ্ক, ঘৃণ্য অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের কাছে জীবন দিতে হলো!
বনানীর যে বাড়িতে তোমার দীপ্ত পদচারণা ছিল; ভুবনভরা হাসি, সুমধুর কণ্ঠ ও চঞ্চলতা যে তোমার বাবা-মা, ভাই, নানা-নানিসহ অসংখ্য প্রিয়জনকে সীমাহীন আনন্দ ও আবেগে আপ্লুত করে রাখত, আজ সেখানে নিশ্চয় রাজ্যের নীরবতা! সীমাহীন দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা ও বেদনায় বিমূঢ় তোমার প্রিয় মানুষগুলো। তোমার দীপ্ত পদচারণা ও অম্লমধুর স্মৃতিতে যে প্রাঙ্গণ ভাস্বর ছিল একদিন, তা আজ নিমেষেই ম্রিয়মাণ। অথচ এমনতো হওয়ার কথা ছিল না! এমন শোক তো প্রাপ্য নয়। পরিবারের সঙ্গে অপার আনন্দে সময় কাটাতে তুমি দেশের বাইরে গেছ। সে সময় তুমি নিশ্চয় অসীম আনন্দে তোমার কল্পনার আকাশ ধরতে চেয়েছিলে, পাখির মতো ডানা মেলে আনন্দ-আকাশে বিচরণ করতে চেয়েছিলে! কিন্তু জঘন্য অপরাধী ও মানবতা বিবর্জিত মানুষ নামের অমানুষগুলো তোমার কল্পনার আকাশের সীমাহীন আনন্দানুভূতিকে মৃত্যুতে বদলে দিল। কী হিংস্র, কী কুৎসিত মনোবৃত্তি ওদের!
প্রিয় জায়ান, তোমার বিস্ময়মাখা, ভুবনভোলানো অকৃত্রিম হাসি ও অপার সৌন্দর্য দিয়ে যে তুমি তোমার প্রিয় মাতৃভূমিকে অপার আলোয় আলোকিত করে দিতে পারতে, তোমার মর্মান্তিক আকস্মিক বিদায়ে তা রুদ্ধ হলেও তুমি অপার ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদয়ে হাজার বছর। আমাদের হৃদয়ে যে ভালোবাসা ও আলোর ঝলকানি তুমি সৃষ্টি করেছ কার সাধ্য সেখান থেকে তোমাকে সরায়। হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তুমি আমাদের চিন্তা, অনুভূতি ও মননে অবস্থান করবে বছরের পর বছর। মহান রাব্বুল আলামিন নিশ্চয়ই তোমাকে বেহেশতের সর্বোচ্চ শান্তিময় স্থানে কবুল করবেন। সেখানে নিশ্চয় তুমি ভালো থাকবে।