ভুল পথে আমেরিকা

আমেরিকার তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। এমনকি আমেরিকার বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। আইনপ্রণেতা থেকে শুরু করে বয়স্ক অভিজ্ঞ ভোটাররা যখন আমেরিকার গতিপথ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করছে না, তখন তরুণ ভোটাররা নৈতিক মানদণ্ডে আমেরিকার গতিপথ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট নির্বিশেষে তরুণ ভোটারদের একটি বড় অংশই মনে করে, আমেরিকা ভুল পথে হাঁটছে। হার্ভার্ড ইনস্টিটিউট অব পলিটিকস পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। টাইম সাময়িকীর জন্য এই জরিপ করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেমোক্রেটিক দলের সমর্থক তরুণ ভোটারদের ৬৬ শতাংশই মনে করেন, আমেরিকা নৈতিকভাবে পথভ্রষ্ট হচ্ছে। ২০১৫ সালে এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন ৪২ শতাংশ তরুণ ভোটার। অন্যদিকে রিপাবলিকান দলের সমর্থক তরুণ ভোটারদের ৬৪ শতাংশ মনে করেন, আমেরিকা ভুল পথে হাঁটছে। ২০১৫ সালে এমন উদ্বেগ প্রকাশ করা রিপাবলিকান তরুণ ভোটারের সংখ্যা ছিল ৭৩ শতাংশ। দল–মত নির্বিশেষে তরুণ ভোটারদের এমন উদ্বেগের কারণ হিসেবে মার্কিন সমাজে বর্তমানে বিদ্যমান নানা অস্থিরতাকে দায়ী করেছেন গবেষকেরা।

গবেষকদের মতে, আমেরিকান সমাজে বিদ্যমান অস্থিরতা তরুণদের আরও রাজনীতিমনস্ক করে তুলছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনের প্রতি তরুণদের যে মনোযোগ ছিল, ২০২০ সালের নির্বাচনের প্রতি তার চেয়ে ঢের বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের ৪৩ শতাংশই আগামী দলীয় প্রাথমিক বাছাইয়ে ভোট দেওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। ২০১৫ সালে এমন আগ্রহী তরুণ ভোটারের সংখ্যা ছিল ৩৬ শতাংশ।

বিশেষত তরুণ ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বহুগুণে বেড়েছে। ২০১৫ সালে ভোট দিতে আগ্রহী তরুণ ডেমোক্র্যাটের সংখ্যা ছিল ৪৪ শতাংশ, যা চলতি বছর বেড়ে ৫৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কোনো দলের সমর্থক নয় এমন তরুণ ভোটারদের মধ্যেও এ প্রবণতা বেড়েছে। চার বছর আগের চেয়ে বর্তমানে ৫ শতাংশ বেশি তরুণ ভোটার নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে আগ্রহ কমেছে রিপাবলিকান তরুণদের।
১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী ৩ হাজারের বেশি তরুণের ওপর জরিপ চালিয়ে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। জরিপ ও গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন ইনস্টিটিউট অব পলিটিকসের জরিপ পরিচালক জন ডেলা ভোলপে। টাইম সাময়িকীকে তিনি বলেন, ‘মূলত ডেমোক্র্যাট তরুণদের মধ্যেই ভোট ও রাজনীতির প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। তরুণেরা শুধু রাজনীতি সচেতনই হচ্ছে না, তাদের মধ্যে প্রগতিশীল মনোভাবও বাড়ছে।’
হার্ভার্ড ইনস্টিটিউট অব পলিটিকস পরিচালিত এই জরিপে উঠে এসেছে আরও কিছু চমকপ্রদ তথ্য। জরিপে দেখা গেছে, তরুণ প্রজন্ম মধ্যবয়স্ক ও বয়স্ক প্রজন্মের বোধবুদ্ধির ওপর আর আস্থা রাখতে পারছে না। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণ ভোটারদের মাত্র ১৬ শতাংশ জানিয়েছে, তরুণদের প্রতি যত্নশীল হবে এমন আইনপ্রণেতাদের নির্বাচিত করায় বয়োজ্যেষ্ঠ (৫৫ থেকে ৭৩ বছর বয়স) প্রজন্ম অবদান রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করে। বয়স্ক এই প্রজন্মের ওপর মোটাদাগে আস্থা রাখে বলে জানিয়েছে ১৮ শতাংশ তরুণ। বিপরীতে ৪০ শতাংশের মতো তরুণ ভোটার জানিয়েছে, বয়স্ক প্রজন্মের প্রতি তাদের আস্থা নেই।
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী রিচার্ড সুইনির মতে, ‘মোটাদাগে বয়স্কদের ওপর তরুণদের আস্থা নেই বলতে হবে। তবে কোনো বয়স্ক ব্যক্তিকে ভোট দিতে তাদের সমস্যা নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা (প্রার্থীরা) তাদের (তরুণদের) কথা ভাবে, তাদের জন্য, তাদের আদর্শের জন্য লড়াই করে।’
এ ক্ষেত্রে বিরাট ব্যতিক্রম হচ্ছেন ভারমন্টের ৭৭ বছর বয়সী সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স, তরুণদের মধ্যে যাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। ২০১৬ সালেই স্যান্ডার্স তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হলে তেমন অবস্থাই দেখা যাবে বলে মনে হচ্ছে। টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনফরমেশন অ্যান্ড রিসার্চ অন সিভিক লার্নিং অ্যান্ড এঙ্গেজমেন্টের গবেষণার তথ্যমতে, ২০১৬ সালের প্রাথমিক নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও হিলারি ক্লিনটন মিলে তরুণ ভোটারদের যত ভোট পেয়েছিলেন, স্যান্ডার্স একাই পেয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি। এ অবস্থা এবার আরও বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ ট্রাম্প জমানায় তরুণদের একটি বড় অংশই ডেমোক্র্যাট রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছে।
জন ডেলা ভোলপে বলেন, ‘আমেরিকার বয়স্ক ও তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। ৫০ বা তদূর্ধ্ব বয়সীদের দুই-তৃতীয়াংশ যখন রিপাবলিকান সমর্থক, তখন তরুণদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ডেমোক্র্যাট সমর্থক।’
তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশ ভোটার ‘আমেরিকা সঠিক পথে চলছে না’ মনে করলেও রিপাবলিকান সমর্থক তরুণ ভোটারদের ট্রাম্পবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট নয়। বরং তাঁরা মনে করেন, রাজনীতি থেকে তাঁদের দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা বরং ট্রাম্পের সুরেই বলছেন, নির্বাচিত আইনপ্রণেতারা স্বার্থপর। রাজনীতির মূল কেন্দ্রটি নষ্ট হয়ে গেছে। রাজনীতিতে এতটাই মেরুকরণ হয়েছে যে, তাঁরা মনে করেন সরকারে সিদ্ধান্তে তাঁদের মতের কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। রিপাবলিকান তরুণদের মধ্যে অতিমাত্রায় রক্ষণশীলতারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিশেষত তাদের ৫৫ শতাংশই মনে করে, সমলিঙ্গের বিয়ে অনৈতিক। অভিবাসন, ধর্ম এমন বিভিন্ন বিষয়ে তারা এমনকি বয়স্ক রিপাবলিকানদের চেয়েও রক্ষণশীল মত ব্যক্ত করেছে।
সব মিলিয়ে তরুণ ভোটারদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকলেও মোটাদাগে অধিকাংশ তরুণ ভোটারই বর্তমান আমেরিকার গতিপথ নিয়ে অসুখী। আমেরিকার রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকে পথভ্রষ্ট হয়েছে বলে তারা মনে করে। এ বিষয়টি নিঃসন্দেহে আগামী নির্বাচনে বড় প্রভাবক হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।