ও-র সঙ্গে কথাবার্তা

২০১৮ সালে দুবার দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে। ‘কিরে, কী খবর, কেমন আছিস?’ এ রকমভাবেই কথাবার্তার শুরু। প্রথম দেখি, পারসনস বুলেভার্ডের মেট্রো স্টেশন বা সাবওয়ে থেকে খানিকটা এগিয়ে হাতের ডানে। এক বাড়ির দোতলায় বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। সেটা ছিল জানুয়ারি মাস। হ্যাঁ, শীত ছিল তখন। মৃদু বরফের আনাগোনা ছিল।

ওকে দেখে বললাম, ‘আমি তো গতকাল এলাম ঢাকা থেকে! তুই ভালো আছিস?’
হেসে জবাব দিল, ‘ভেবে দ্যাখ দোস্ত! আমি থাকি বিশ্বের সবচেয়ে বিচিত্র শহরে, পয়সাওয়ালা দেশে, তোর বসবাস যানজটের শহরে, দরিদ্র শহরে। অথচ এখানে আমিই বেঁচে আছি তোদের কল্যাণে! তোরা এক আলাদীনের প্রদীপ হাতে নিয়ে বললি, নিউইয়র্কে চাই প্রথম আলো। ব্যাস, সেভাবেই আমার জন্ম! অথচ সবখানেই আমার এই শহরের জয় জয়কার! আমিই শুধু তোদের ঢাকায় বাঁধা!’
যাঁরা পড়ছেন, তাঁরা বিশ্বাস করতে পারবেন না, একটি অফিসের সঙ্গে অফিসের এক কর্মীর এ রকম কথাবার্তা হতে পারে। শুধু শরীরটা দিয়েই সবকিছুর হিসাব করা যায় না—মন একটা বড় ব্যাপার, এ কথা মানলেই আপনি আমাদের এই কথোপকথন ধরতে পারবেন।
প্রথমবার ও আমাকে বলেছিল, ‘আসিস মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে। তোর মতো অনেক মানুষ এখানে আমার কলজে নিয়ে নাড়াচাড়া করে।’
আমি বলেছিলাম, ‘ওরা আছে বলেই তুই টিকে আছিস, নইলে কবে তলিয়ে যেতিস মহাশূন্যের অতলান্ত গহ্বরে!’
এটুকু বলেই বুঝতে পারি, কারও একজনের কবিতার লাইন বেমালুম মেরে দিয়েছি। শুধু ‘যেতাম’এর জায়গায় ‘যেতিস’ বসিয়ে দিয়েছি।
আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল ও। তারপর বলল, ‘তুইও দেখি রোমান্টিকতা ছাড়তে পারিস না!’
বললাম, ‘আরে না! দুটো মুখে দিতে পারব, এই আশায়ই তো চাকরি করি। রোমান্টিকতার কোনো জায়গা নেই এখানে।’
কথাটা ভালো লাগে না ওর। বলে, ‘বাহ! তুই যখন মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে যাবি, তখন কি অফিসটা কাঁধে করে নিয়ে যাবি? ওখানে কি কেউ তোকে বলবে, ভ্যান গঘ আর পিকাসো নয়, কারওয়ান বাজারের কথা ভাবতে থাক?’
এবার হাসলাম আমি। ‘আরে ইয়ার! তা হয়তো বলবে না। চোখে যা দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি মনে। তাই অফিসটা বয়ে বেড়াই মনে মনে। ওই যে কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা, জানিস না?’
‘তোদের রবীন্দ্রনাথ! হ্যাঁ, জানব না কেন? কিন্তু হারিয়ে গিয়েও যদি অফিসের কথা ভাবতে হয়, তাহলেই বিপদ!’
ওর কথাটা আমার মনে ধরে। ‘পলায়ে’ যাওয়া যায় না? বেমালুম অফিস ভুলে একদম ঝাড়া হাত–পা হয়ে থাকা যায় না?
হ্যাঁ, সেই শীতের জানুয়ারিতে চেষ্টা করলাম ‘পলায়ে’ যেতে। শুধু ব্রডওয়ে শো দেখার ছন্দে আন্দোলিত হতে হতে মনে হয়, নাহ! অফিসকে এড়ানো যাবে না। এই শো অবশ্যই উঠিয়ে আনতে হবে পত্রিকার পাতায়! আর কনকনে শীতে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দর্শনের স্মৃতি কি ভোলার?
এরপর জুলাই মাসে আবার গেছি নিউইয়র্কে। এবার আর পারসনস বুলেভার্ডে খুঁজে পেলাম না ওকে। বাড়ি বদলেছে ও। চলে গেছে জ্যাকসন হাইটস–এ। শীতকালেই আমার বড় ভাই বলেছিলেন, ‘এখানে তুই এক বর্ণ ইংরেজি না জেনে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে পারবি! শুধু বাংলা জানাই যথেষ্ট।’ সেবার জ্যাকসন হাইটস খুঁটিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এবার হলো। বিশ্বাস করলাম তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে।
একতলায় বেশ কয়েকজন মানুষকে পেটে পুরে বেশ রোদ পোহাচ্ছিল ও। আমাকে দেখে একটু হাসল। বলল, ‘আবার এলি তাহলে?’
বললাম, ‘এবার দুমাসের জন্য। অন্যদের সঙ্গে মিলে তোর কলজে খাব।’
এই অন্যদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আবার। জানুয়ারিতে ওর পেটের ভেতরে থাকা মানুষদের সবাইকে দেখেছিলাম, কথাও বলেছিলাম তাদের সঙ্গে, কিন্তু এবার যেন আলাদা আলাদা অবয়বগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করল। দাগ কাটতে থাকল মনে। হ্যাঁ, ইব্রাহিম খোকন বুধবার রাতে চলে আসেন নিউ জার্সি থেকে। বৃহস্পতিবার পাতা ছেড়ে তারপরই কেবল তাঁর ছুটি। আর সেদিন প্রথম আলো অফিসে বসে সাহিত্য আড্ডা। এটা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে আহমদ মাযহারের উপস্থিতিতে। কখনো চলে কবিতা, কখনো গান, কখনো শুধুই গল্প, সাহিত্য আলোচনা। হেলিম ভাই, মনজু ভাই, ঊর্মিরা বিজ্ঞাপন নিয়ে ব্যস্ত। জমাট আড্ডায় যোগ দেন রূপু ভাই, আনন্দে ভরপুর এক মানুষ। আসেন আদনান সৈয়দ, মনির হায়দার। মনিজাকেও সেদিনই দেখতে পাই সেখানে। স্মৃতি ভদ্র, সেলিনা, আরিফ—আরও কত মানুষ!
সেবার দুমাসে আমি হয়ে গেলাম পরিব্রাজক আর লেখক। অফিসটাকেও বুঝতে লাগলাম। সপ্তাহে চার দিন অফিস করি আর অন্য সময় ঘুরে বেড়াই গোটা নিউইয়র্ক। তারপর প্রতি সপ্তাহে গড়ে তিনটা করে লেখা দিই মাযহার ভাই, খোকন ভাইয়ের হাতে। ঢাকায় সেলিম খানের হাতেও পাঠাই। একসময় দেখি, নানা বিচিত্র বিষয়ে প্রায় ২১টি লেখা ছাপা হয়ে গেছে প্রথম আলো নিউইয়র্কের সংখ্যায়!
আমার ফেরার সময় হয়, তখন ও আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমাকে কেমন দেখলি?’
বললাম, ‘তোর সবকিছুই ভালো। কিন্তু তুই এমন একজনকে এখানে জায়গা দিসনি, যে লোক ঘুরে ঘুরে বাঙালিদের সমস্যা, সংকট, ভালোত্ব খুঁজে নিয়ে রিপোর্ট করবে। একজন রিপোর্টারের অভাব আছে তোর।’
ও বলল, ‘ঠিক বলেছিস! তুই ঢাকায় গিয়ে বলিস সে কথা।’ পরম উৎসাহে ঢাকায় ফিরে অপেক্ষা করতে থাকি, কখন উত্তর আমেরিকা নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের সঙ্গে বৈঠক করে আমার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেব।
দিন কেটে যায়। সে বৈঠক নিয়ে কারও মধ্যে কোনো উৎসাহ দেখি না।
দিন চলে যায়। কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে না, কী অভিজ্ঞতা হলো আমার।
তারপর একদিন আমার পর্যবেক্ষণ নিয়ে একটা মেইল করি কয়েকজনকে।
সে মেইলের কোনো জবাব আসে না।
তখন আমি ওর কথা মনে করি। একটু হেসে ওর কাছে খবর পাঠাই, ‘ভুল মানুষের সঙ্গে এত কথাবার্তা বলেছিলি দোস্ত! যার যা কাজ, সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকা দরকার। অন্য বিষয়ে অন্য মানুষ ভাববে।’ ও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তুই একেবারেই শুধরাবি না, দোস্ত!’
আমি আবার হেসে বললাম, ‘শোন দোস্ত! জ্যাকসন হাইটস আরও কিছু ইতিহাসের জন্ম দেবে। সেদিন পর্যন্ত অপেক্ষা কর।’
বোকার মতো প্রশ্ন করল ও, ‘তাতে তোর কী লাভ?’
এবার নির্দ্বিধায় বললাম, ‘আরে গাধা! তুই–ই তো বলেছিলি একদিন, আমি রোমান্টিক। লাভ নিয়ে কি রোমান্টিকেরা ভাবে?’

জাহীদ রেজা নূর: হেড অব কালচার অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট, প্রথম আলো