প্রবাসে ঈদ এখন

নিউইয়র্কে এখন ঈদের নামাজে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত হয়, কয়েক বছর আগে যেটা ভাবাই যেত না
নিউইয়র্কে এখন ঈদের নামাজে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত হয়, কয়েক বছর আগে যেটা ভাবাই যেত না

শৈশবের জীবনটা ছিল বড় নিখাদ। জীবনের চাঞ্চল্য ছিল, উদ্দামতায় ছুটে চলার প্রয়াসে দিগন্ত বিস্তৃত উদ্যোগ ছিল, ছিল অনেক আশা খুনসুটি আর ভালোবাসা। পবিত্র রমজান মাসের রোজার শেষে বড়রা যখন ঈদের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হতেন, আমরা ছোটরা তখন চাঁদ দেখা নিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টি ছুড়ে দিতাম আকাশের বিশালতায়। মেঘ ভাসছে আকাশে, তারই ফাঁকে বিভিন্নভাবে কসরত করে ঈদের চাঁদ দেখার চেষ্টা করতাম। দৃষ্টিকে প্রসারিত করে চাঁদ দেখার এক ধরনের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতাম।

ঈদ উপলক্ষে বিশেষ একটি আকর্ষণ থাকত নতুন কাপড়ের। যেন চাঁদ দেখার পর্বটা শেষ হলেই নতুন জামার স্পর্শটা পাওয়া যাবে। পরবর্তীতে ঠিক একই ধারাবাহিকতা দেখেছি আমার সন্তানদের মধ্যে। পৃথিবীর প্রত্যেক মা–বাবার একটা দৃঢ়তা কাজ করে সন্তানদের মুখে হাসি ফোটানোর। ব্যবসায়িক কাজে প্রায়ই ঢাকায় যেতাম। ফেরার পথে আমার বাচ্চাদের জামা–জুতায় ব্যাগটা ভরা থাকত। ব্যাগটি খুলতে না খুলতেই তাদের চোখেমুখে আমি ঈদের খুশি খুঁজে পেতাম।

নব্বইয়ের দশকে এলাম আমেরিকায়, প্রথম ঈদুল ফিতর আমাকে ভীষণভাবে কাঁদাল। ভীষণভাবে আপ্লুত হলাম। আমার পরিবার, সন্তান সবাইকে দেশে রেখে প্রবাসে প্রথম ঈদ। তখনকার দিনে নিউইয়র্কে অধিকাংশই আমার মতো বিবাহিত–ব্যাচেলর। দু-একজন বন্ধুর আনুকূল্যে মাঝেমধ্যে পারিবারিক স্বাদ পেতাম। তখনকার সময়ে রমজান মাসের এত আড়ম্বর ছিল না। কাজের তাড়নায় এই ব্যস্ত জীবনে নীরবে–নিভৃতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতাম।

ঈদের নামাজের জন্য তেমন প্রশস্থ কোনো জায়গা ছিল না। হাতে গোনা গুটিকয়েক মসজিদ ছিল। বর্তমান জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার তখন ছিল অনেক ছোট্ট পরিসরে। ঈদের নামাজ পড়তে হতো জ্যামাইকার ইনডোর বাস্কেট বল মাঠে। তিন দশক পরের গোটা আমেরিকায় রমজান মাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই সহস্রাধিক মসজিদে চলছে নিয়মিত খতমে কোরআন, তারাবির নামাজ। নিউইয়র্ক শহরকে আজকাল মসজিদের শহর বলে অবিহিত করা চলে। আশি ভাগ মসজিদের পরিচালনায় বাংলাদেশি কমিউনিটি এগিয়ে এসেছে। নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন। রমজান মাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গে শহরের প্রত্যেকটি মসজিদে বিশেষ ইফতারির ব্যবস্থা করা হয়। মুসল্লিদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইফতারির ব্যবস্থা হয়ে থাকে। কোন কোন মসজিদে কমিটির ব্যবস্থাপনায় ইফতারির ব্যবস্থা হয়ে থাকে।

বাঙালি মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত রেস্তোরাঁগুলো বাহারি ইফতারির পসরা সাজিয়ে দেদার ব্যবস্থা করছে, এমনকি মুসলিম মালিকানাধীন সুপারমার্কেটে বিশেষ খাদ্যসামগ্রীর আয়োজন পরিলক্ষিত হয়। প্রবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতির স্পর্শকাতরতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। পবিত্র রমজান মাসের চেতনাকে ধারণ করে আরও সমতাপূর্ণ সমাজ গঠন করা সম্ভব বলে প্রবাসী ধর্মপ্রাণ মানুষ দেশীয় অনুভূতির সমতা বজায় রেখে বর্তমান প্রজন্মকে উৎসাহিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আজকাল কোন ঈদে পর্বে হাজারো বাঙালি নরনারী, আবালবৃদ্ধ বনিতাকে বাহারি পোশাক পরে শহরের রাস্তায় ঘুরতে দেখা যায়, যা তিন দশক আগের প্রবাসে ছিল অকল্পনীয়।