হৃদয় দিয়ে রান্না

রান্না করা আমার প্রিয় শখ, আমার প্যাশন, কথাটি বেশ চাউর সাম্প্রতিক। আমি ভালো রান্না করি, এটি আমাকে বিব্রত করে না। প্রশংসাসূচক আন্তরিক মন্তব্যটিতে আমি উৎসাহ বোধ করি। পরীক্ষায় বসতে হয়েছে অনেক অনেকবার। পরীক্ষকগণ সমঝদার, গুণী, রসিকজন, বিখ্যাত সব মানুষ। বাংলাদেশের, যুক্তরাষ্ট্রের। উতরে যাই। উত্তীর্ণ হই বারবার। প্রশ্ন শুনি, এত ভালো কেমন করে রাঁধি? আমার বিনীত জবাব,‘আমি তো চোখ দিয়ে দেখে, হাত দিয়ে ধরে রান্না করি না। হৃদয় দিয়ে রান্না করি।’ যাঁদের জন্য রান্না, তাঁদের প্রতি আমার ভালোবাসাই আমাকে ভালো রান্নায় একনিষ্ঠ মনোযোগী করে ধরে রাখে।
রান্নার ক্ষেত্রে আমি যেসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে থাকি: (১) ভালো পাচককে ভোজনরসিক হওয়া বাঞ্ছনীয় (২) ভালোবেসে রান্নার কাজটি করতে হবে (৩) ভালো রান্নার প্রাথমিক শর্ত, ভালো বাজার করতে জানা (৪) খাবারের রসায়ন ও কম্বিনেশান জানা অত্যাবশ্যক (কোন মাছ বা মাংসের সঙ্গে কোন্ সবজি বা মসলা দিলে দেখতে সুন্দর ও খেতে মজার হবে)।
আমি একটি আপ্তবাক্য মাথায় রাখি: ‘প্রথমে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী’। রান্নার পদগুলোকে দর্শনধারী করতে হবে। এ জন্য পরিচ্ছন্নতার দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং অবশ্যই সেন্স অব আর্ট থাকতে হবে। সে রান্নার ক্ষেত্রে, পরিবেশনায় তো অবশ্যই। কত কতই তো খাবার! এক একটি আমিষ কি নিরামিষ অনুষঙ্গেরই তৈরি হতে পারে দশ কুড়িটি পদ।
আজকের দিনে রন্ধনশিল্প বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত বৃহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। আজ এই শিল্পের খাতিরে বিশ্বখ্যাত শেফ গর্ডন রামজে, অ্যান্থনি বোরডেইনদের সঙ্গে বাংলাদেশের আহমেদ হোসাইন, টমি মিয়া, টনি খান, শেলি নূরুজ্জামানদের নাম সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। কিন্তু রান্নায় আমার মনোযোগ আমাদের মা, চাচি, খালাদের রান্নাঘরের দিকে। মায়ের হাতের রান্নায়ই তো জাদু! সেটিই আসলে বিশ্বসেরা। আজকের রান্নার আসরে মায়ের হাতের রান্নার কথাই উঠে আসুক তবে!

সর্ষে চিংড়ি
সর্ষে চিংড়ি


সর্ষে চিংড়ি
সর্ষে ইলিশ বহুল জনপ্রিয় একটি খাবার। প্রত্যেক বাঙালির কাছেই বড় আদরণীয় খাবারের এই পদ। কিন্তু আজ আমরা রান্না করব সর্ষে চিংড়ি।
বড় আকারের মাথা ছাড়ানো, শেল ছাড়ানো ও পরিষ্কার করা, ধুয়ে নেওয়া ১২টি চিংড়ি রেডি রাখি। এবার ফ্রাই প্যানে তেল গরম করে নিয়ে পেঁয়াজ বাটা, সামান্য পাপড়িকা, আদা রসুন বাটা, মরিচ বাটা অথবা লাল মরিচের গুঁড়ো, লবণ, অল্প জিরার গুঁড়া, অল্প পরিমাণ গুঁড়ো গরম মসলা দিয়ে মসলা কষিয়ে চিংড়িগুলো ওপরে বসিয়ে দিই। নেড়েচেড়ে ঢাকনা দিয়ে রাখি। কিছুক্ষণ পর ঢাকনা খুলে আগে করে রাখা হলুদ, সর্ষে বাটা দিয়ে (সর্ষে বাটা দেওয়ার সময় পরিমাণ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে, বেশি হলে তেতো স্বাদ হয়ে যাবে, খেতে ভালো লাগবে না) নেড়েচেড়ে একটু গরম পানি দিয়ে ঢেকে দিই। শুকিয়ে মাখো মাখো হলে নামিয়ে ফেলি।

আলু-মুরগির ঝাল
আলু-মুরগির ঝাল


আলু-মুরগির ঝাল
দুটি বেবি চিকেন কেটে মাঝারি টুকরো করে চর্বি ছাড়িয়ে, ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে রাখি। পাতিলে তেল গরম করে বেশি করে পেঁয়াজ বাটা অথবা পেঁয়াজ কুঁচি, আদা-রসুন বাটা, লাল মরিচ বাটা, সম্ভব না হলে লাল মরিচের গুঁড়ো, হলুদ, লবণ, জিরা ও ধনের গুঁড়ো, কয়েকটি এলাচ, দারুচিনি ও একটু পাপড়িকা (লালচে কালার আনার জন্যে) দিয়ে নাড়াচাড়া করে একটু গরম পানি দিয়ে ঢেকে রাখুন। একটু পর এই কষানো মসলায় মাংস দিয়ে নেড়ে দিয়ে ঢাকনা দিয়ে রাখুন। অল্প আঁচে মাংস খানিকটা সিদ্ধ হয়ে এলে, আগে ছিলে চার টুকরো করে কেটে ধুয়ে রাখা আলু দিয়ে দিন। কয়েকটা লাল কাঁচা মরিচ আস্ত ছেড়ে দিন, দেখতে ভালো লাগবে, সুঘ্রাণ ছড়াবে। নাড়াচাড়া করে ঢেকে রাখুন। ঝোল ঘন হয়ে এলে ভেজে গুঁড়ো করে রাখা জিরা মাংসের ওপর ছড়িয়ে ঢেকে দিন।

করলা-চিংড়ি ভাজি
করলা-চিংড়ি ভাজি


করলা-চিংড়ি ভাজি
বড় আকারের আটটি চিংড়ি শেল ছাড়িয়ে, ভেতরের কালো সুতোর মতো জিনিসটি ফর্ক অথবা নখের সাহায্যে ছাড়িয়ে তিন টুকরো করে কেটে ধুয়ে রাখুন। পাঁচ/ছয়টি মাঝারি আকারের সতেজ করলা চিকন চাকা চাকা করে কেটে ভেতরের বিচির অংশ ফেলে দিয়ে ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে রেখে দিন। এবার বড় কড়াইয়ে তেল গরম করে তাতে পেঁয়াজ কুঁচি, মুখ ফেঁড়ে নেওয়া কাঁচা মরিচ, কাটা রসুন, লবণ, জিরা দানা ও একটু হলুদ দিয়ে নেড়েচেড়ে তাতে করলা এবং তার ওপর চিংড়ির টুকরোগুলো ছড়িয়ে দিন। ঢেকে রাখুন। কিছুক্ষণ পর উল্টেপাল্টে দিন। একটু সরিষার তেল কড়াইয়ের সব দিকে ছড়িয়ে দিয়ে ভেজে নিন। কড়া ভাজা হলে নামিয়ে ফেলুন। গরম ভাতে গাওয়া ঘি পাতে গরম ভাজা অসাধারণ লাগবে।

ধানি কোরাল মাছের ঝোল
ধানি কোরাল মাছের ঝোল


ধানি কোরাল মাছের ঝোল
মাছের আকার অনুযায়ী আস্ত রাখুন অথবা দুভাগ করে কেটে ধুয়ে পরিষ্কার করে পানি শুষে নিয়ে লবণ ও হলুদ দিয়ে মেখে রাখুন। প্যাকেটের ফ্রোজেন ডাঁটা ভালো করে ধুয়ে নিন। ছোট ছোট গোল লাল আলু ছয়টি, না পেলে মাঝারি সাইজের চারটি লাল আলু নিজের পছন্দ অনুযায়ী দৃষ্টিনন্দন হয় এমন করে কেটে ধুয়ে রাখুন। সবজি কাটা ধোয়ার ফাঁকে মাছগুলো আলতো হলুদ লালচে করে ভেজে রেখে দিন। এবার রান্নার পাতিলে তেল গরম করে পেঁয়াজ কুঁচি, রসুন বাটা, পরিমাণমতো লবণ, জিরা দানা লাল গুঁড়া মরিচ ও হলুদ দিয়ে মসলা একটু কষিয়ে নিয়ে ডাঁটা ও আলু ছেড়ে দিয়ে মসলা যাতে মাখে এ রকম করে নেড়ে ঢেকে রাখুন। একটু পর আবার নেড়ে দিন। কিছুক্ষণ পর ঝোলের জন্য পরিমাণ মতো গরম পানি দিয়ে ঢেকে রাখুন। একটু পর ভাজা মাছগুলো ওপরে সাজিয়ে বসিয়ে দিন। ঝোল গাঢ় ঘন হয়ে এলে আগে করে রাখা ভেজে নেওয়া জিরা গুঁড়া খানিকটা ছড়িয়ে নামিয়ে ফেলুন। ব্যস, হয়ে গেল সুস্বাদু আলু ডাঁটা সহযোগে কোরাল মাছের ঝোল।

ঈদের দু–একটি পদ দিয়েই শুরু করা যাক
আনন্দময় ঈদোৎসব। ধর্মীয় মর্যাদা যেমন আছে, তেমনি আছে সামাজিক মেলামেশার গুরুত্ব। তাই আনন্দের পাশাপাশি থাকে ভুরিভোজেরও আয়োজন। সাদা পোলাও, জাফরান পোলাও, নানা নামে পদে বিরিয়ানি খাসি, গরু, মুরগি আলাদা আলাদা মাংসের আলাদা প্লেইন বিরিয়ানি, আবার গরু, খাসি, মুরগির নানা পদ যেমন—তেহারি, কাচ্চি, মোরগ পোলাও, মোরগ মুসল্লম ইত্যাদি শানদার সব নাম।
এসব খাবারের রেসিপি, রান্নার পদ্ধতি আপনারা জানেন। আমি বরং সাদা পোলাওয়ের সঙ্গে খাওয়ার দুটি মজাদার খানদানি খাবারের কথা বলি—

চিতল মাছের কোফতা কারি
চিতল মাছের কোফতা কারি


চিতল মাছের কোফতা কারি 
বাংলাদেশি গ্রোসারিতে ছোট কন্টেইনার ও প্লাস্টিক পেপারে মোড়া প্যাকে চিতল মাছের কিমা পাওয়া যায়। বেশ কিছুক্ষণ বাইরে রেখে ডিফ্রস্ট করে হাতের চাপে পানি একেবারে ঝরিয়ে একটা বউলে নিয়ে পরিমাণ মতো হলুদ, লবণ, সঙ্গে লাল মরিচের গুঁড়ো, জিরা, ধনে ও গরম মসলার গুঁড়া দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে হাতের তালুতে গোলাকার ছোট ছোট ডোউ চ্যাপ্টা গোল কাবাব বানিয়ে নিই। এবার কাবাবগুলো গরম আধা ডুবো তেলে লালচে করে ভেজে নিই। হয়ে গেল চিতল মাছের কোফতা। কারি বানাতে আরেকটি কড়াইয়ে তেল গরম করে পেঁয়াজ বাটা, আদা, রসুন বাটা, আরেকটু করে লবণ ও মরিচ গুঁড়া দিয়ে কাবাবগুলো কষিয়ে নামিয়ে নিই। ওপরে ধনে পাতা, লাল কাঁচা মরিচ ও গাজরের টুকরো দিয়ে সাজিয়ে দিই।

গরুর চাপ
গরুর চাপ


গরুর চাপ
বড় বড় ছয় পিস টি-বোন স্টেক মাংসের প্রতিটি পিস আলাদা করে হ্যামার দিয়ে পিটিয়ে একটু নরম করে নিন। ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে বড় পাত্রে নিয়ে পরিমাণমতো টক দই, অল্প আদা, রসুন বাটা, হলুদ, লবণ, লাল মরিচের গুঁড়া, জিরার গুঁড়া, ধনের গুঁড়া, গরম মসলার গুঁড়া দিয়ে ভালো কর মাখিয়ে ঘণ্টা তিনেক রেখে দিন। এবার বড় একটা পাত্রে সাজিয়ে পানিবিহীন অল্প আঁচে সিদ্ধ করুন। মাঝে মাঝে উল্টে পাল্টে দিন। সিদ্ধ হয়ে এলে নামিয়ে মাংস থেকে বেরিয়ে আসা মসলা চর্বিযুক্ত পানি আলাদা করুন। কিছুক্ষণ রেখে দিন। এরপর কড়াইয়ে তেল গরম করে স্টেকগুলো একটা একটা করে ভেজে রেখে দিন। এরপর আলাদা পাত্রে তেল গরম করে পেঁয়াজ কুঁচি, অল্প করে আদা রসুন বাটা দিয়ে কিছুক্ষণ অল্প আঁচে রান্না করে দেখে নিন ঝাল লবণ ঠিক আছে কিনা! এবার তুলে রাখা চর্বিযুক্ত পানি দিয়ে দিন। ঢেকে রাখুন। শুকিয়ে গেলে ভাজা ভাজা মতো হয়ে এলে সাদা পোলাও এর সঙ্গে পরিবেশন করুন।