বাঙালির কৌতূহল...

বাঙালিরা যতটা না কৌতুকপ্রিয় তার চেয়ে বেশি কৌতূহলপ্রিয়। বাঙালির কৌতূহল অপরিসীম। সব বিষয়ে আগ্রহ। অন্য জাতির মধ্যে এটা দেখিনি। তারা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন করে না সাধারণত।
কিন্তু আমরা অন্যের হাঁড়ির খবর জানার জন্য সদা ব্যস্ত। কেউ কেউ আছে প্রথম সাক্ষাতেই কিছু প্রশ্ন করে, বিশেষ করে যাঁরা বিদেশে থাকি তাঁরা এটা করি। আবার দেশে গেলেও নানা ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। ফেসবুকেও অনেক প্রশ্ন করি। অনেকের অনেক কৌতূহল। সম্প্রতি একজনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের নমুনা দিচ্ছি—
—ভাই কাজ করেন?
জি করি।
—কী কাজ?
এই একটা ছোটখাটো কাজ। তেমন উল্লেখ করার মতো না।
—কোথায় কাজের জায়গা?
কাছেই।
—কতক্ষণ লাগে যেতে?
মিনিট পনেরো।
—ওহ তাহলে তো কাছেই। ড্রাইভ করেন?
জি। গাড়ি ছাড়া কি চলে, বোঝেন তো উইন্টারের দেশ।
—এসইউভি না সেডান?
এসইউভি।
—ব্র্যান্ড নিউ না প্রি-ওল্ড?
নতুনই বলতে পারেন। গাড়ি কি আর নতুন থাকে। রাস্তায় নামলে পুরোনো।
—ফাইন্যান্স না লিজ?
ফাইন্যান্স।
—ইনস্যুরেন্স কি ফুল কভারেজ?
হ্যাঁ।
—কোন কোম্পানি?
বেলএয়ার।
—ভাবি কাজ করেন?
হ্যাঁ।
—কত দিন করে?
ফুলটাইম।
—কীভাবে যায়? ড্রাইভ করে?
না, ড্রাইভ জানে না। আমি পৌঁছে দিই সুযোগ পেলে।
—কী বলেন! এ দেশে ড্রাইভ না করলে চলে।
টরন্টো তো খুবই ভালো কমিউট সিস্টেম। বাস সার্ভিস অসাধারণ। পৃথিবীর কম শহরেই এমন আছে।
—ছেলে মেয়ে কতজন আপনার?
দুজন। এক ছেলে, এক মেয়ে।
—ও হ্যাঁ আপনার একটা লেখায় দেখেছি।
জি। আমি মাঝে মাঝে লিখি ওদের কথা।
—নিজের ফ্যামিলির কথা কেউ লেখে?
আমার তো ভালোই লাগে লিখতে।
—আপনি আর কী লেখেন?
গল্প, উপন্যাস এসব।
—বই-টই বের করেন না?
তাও করি। মানে পাবলিশার করে।
—টাকা দ্যায়!
দ্যায় যৎসামান্য।
—ছেলে মেয়ে কী করে?
পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে। বিয়েও হয়ে গেছে।
—বলেন কী! দেখলে তো মনে হয় না।
আরে কী বলেন। বুড়া হইছি।
—কোথায় বিয়ে করলেন, বাঙালি?
না।
—মুসলিম?
হ্যাঁ।
—নিজেদের পছন্দ?
হ্যাঁ।
—বাড়ি কিনেছেন?
না।
—ভাড়া বাসায় থাকেন?
জি।
—কিনবেন না?
প্ল্যান আছে।
—কত টাকা ভাড়া দেন?
এই তো দুই হাজার প্লাস...।
—দুজন মানুষ এত টাকা ভাড়া দিয়ে থাকেন?
টরন্টোতে বাড়ি ভাড়া অনেক, আপনি তো জানেন।
—দূরদর্শী হলে বাড়ি কিনতেন।
কথা ঠিক। বোকা টাইপ।
—ভাবিকে তো কোনো অনুষ্ঠানে দেখি না। নিয়ে আসেন না কেন? একলা বেড়াতে পছন্দ করেন?
তা না। ব্যস্ত থাকে তো তাই আসতে পারে না।
—আমার কথায় মাইন্ড করছেন?
না। মাইন্ড করিনি।
দেশে গেলেও এমনটা হয়। দেশের অনেক মানুষের ধারণা বিদেশ মানেই টাকার ছড়াছড়ি।
আবার সেই মানুষ যখন বিদেশে আসেন তখন বুঝতে পারেন বিদেশের জীবন কত কঠিন, তার চেয়েও কঠিন বিদেশের মানুষের মন বোঝা। বিদেশ এক কঠিন গ্যাঁড়াকল। দেশে গেলে যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তার নমুনা—
—শুকাইয়া গেছ ক্যান?
কই না তো।
—কানাডায় কী করো, ব্যবসা না চাকরি?
চাকরি।
—বেতন কেমন পাও?
ডিপেন্ডস। কেমন চাকরি তার ওপর।
—ওহ বলতে চাও না।
বলার মতো কিছু না।
—ভয় নাই টাকা চামু না।
আরে তা বলছি নাকি। বেতনের কথা বলতে কেমন লাগে না! ও দেশে এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। সব কাজই কাজ।
—তুমি তো কানাডায় বাড়ি কেননি। অনেকেই তো কিনছে। তোমার পরে গেছে যারা তারাও কিনছে।
হ্যাঁ তা ঠিক।
—দেশের সম্পত্তি দিয়া কী করবা?
কী করব জানি না!
—তুমি তো ফিরতে চাও। লাইব্রেরি করতে চাও। তোমার ওয়াইফের তো অনেক সম্পদ আছে।
কী জানি ফিরতে পারব কি না! একবার ঘর ছাড়লে ফেরা কঠিন হয়ে যায়।
—তোমার ছেলে-মেয়েরা কত টাকা বেতন পায়?
সেটা কি আমাকে বলে!
—তোমার ওয়াইফ চাকরি করে?
হ্যাঁ।
—তাহলে তো তোমাদের অনেক টাকা। চারজন আয় করো।
আরে ছেলে-মেয়েরা তো আলাদা থাকে, আলাদা সংসার। ওদেরটা তো আমরা চাই না।
—কেন ছেলে-মেয়েদের এত কষ্ট করে মানুষ করছ! ওরা টাকা পয়সা দেয় না!
দরকার হয় না। দরকার হলে দেবে।
—বাড়ি ভাড়া কেমন?
খারাপ না।
—বাংলাদেশের টাকায় কত হবে?
অনেকই হবে।
—গাড়ির দাম কেমন?
গাড়ি তুলনামূলক সস্তা। ফাইন্যান্স বা লিজে কেনা যায়।
—জলি নাকি আট কোটি টাকা দিয়া বাড়ি কিনছে। তোমার কত পরে গেছে ওরা।
আট কোটি টাকা না, আট শ হাজার ডলার দিয়া কিনছে। চাপা মারছে।
—তোমরা তো বছর বছর দেশে আসো। ওরা তো আসে না।
সে জন্যই কিনতে পারছে।
—ফোন করে অনেক গল্প করে বিদেশের। তুমি তো কোনো গল্প করো না। কিছু বলতে চাও না।
বলার মতো কিছু নাই। বেঁচে থাকাটাই আসল।