প্রবাসে বাংলা পত্রিকা কে পড়বে, কেন পড়বে?

প্রবাসে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকাগুলোও এখন পরিবর্তিত সময়ের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ছবি: প্রথম আলো
প্রবাসে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকাগুলোও এখন পরিবর্তিত সময়ের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ছবি: প্রথম আলো

মনে পড়ে শৈশবে তৃষিত চাতকের মতো দিনভর অপেক্ষার পর রাত এলে পত্রিকার দেখা পেতাম। আমার ক্লান্ত বাবা কাজ শেষে ঘরে ফিরলে দরজা থেকেই তাঁর হাত থেকে ছোঁ মেরে পত্রিকাটি হস্তগত করতাম। পত্রিকা নিয়ে ভাইদের মধ্যে কাড়াকাড়ি হতো। আমরা ভাইয়েরা পাতাগুলো ভাগাভাগি করে হামলে পড়তাম। সে আমলে সরকারি বেতার বা টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদ যুগের চাহিদা মেটাতে পারত না। সাধারণ মানুষের কাছে দুটি বিদেশি বেতারের বাংলা বিভাগের সংবাদের আলাদা কদর ছিল; তবে তা যেন জ্যৈষ্ঠের খরতাপে বর্ষণের মতো সামান্য। স্বাধীন, নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, তথ্য ও বিস্তারিত বিশ্লেষণের জন্য ভালো পত্রিকার ওপর নির্ভর করতেই হতো। যোগাযোগ মাধ্যমের অপ্রতুলতার দরুন সংবাদের জন্য অপেক্ষা করা ছিল খুব স্বাভাবিক নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। যেমন আমি বিদ্যুৎবিহীন এক গ্রামে থাকার দরুন নব্বইয়ের ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনালের দুদিন পর আমার প্রিয় দলটির পরাজয়ের খবর পেয়েছিলাম।

কে, কেন, কখন কোন সংবাদপত্র পড়ত, তা ছিল বেশ আগ্রহোদ্দীপক বিষয়। যেমন, আমার নানাবাড়িতে যে দৈনিক পত্রিকাটি রাখা হতো আমি চেষ্টা করেও সেটিকে পরিবর্তন করতে পারিনি। সেই পত্রিকার ছিল তিন প্রভাবশালী পাঠক। এক, আমার নানা যিনি ‘টারজান’ কার্টুনে অনুরক্ত-যে কার্টুন অন্য কোনো পত্রিকা ছাপত না। আমার বেকার মামা, যিনি চাকরির বিজ্ঞাপন খুঁজতেন-যা ওই পত্রিকাটিতেই বেশি আসত। সবার পড়া শেষ হলে সবশেষ ভোক্তা বাড়ির গৃহকর্মী, যে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সিনেমার বিজ্ঞাপন, নায়ক-নায়িকাদের ছবি ইত্যাদি দেখত। সে পত্রিকায় আরও থাকত শিশু-কিশোরদের মননশীলতা, সৃজনশীলতা ইত্যাদি প্রকাশের জন্য বিশেষ পাতা, দেশব্যাপী যার একটি বিপুল অনুগত ভোক্তা শ্রেণি তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ, একটি পত্রিকার অঙ্গসজ্জা পরিকল্পনা করতে গিয়ে নানান শ্রেণির ভোক্তার কথা তখন মাথায় রাখা হতো। একটি বাড়িতে একটি টেলিভিশন, একটি টেলিফোন, একটি দৈনিক পত্রিকা-এমনি একটি মডেল প্রচলিত ছিল মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে। এমনকি, কোন বাড়িতে কী পত্রিকা রাখা হয়, তা দিয়েও অনুমান করা যেত কে কোন রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ভাবধারার মানুষ।
’৯০ একটি ঘটনাবহুল দশক। পৃথিবী তখন অবলোকন করছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে বড় পরিবর্তনগুলো। ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষে মধ্যপ্রাচ্যে বেজে উঠেছে নতুন যুদ্ধের দামামা। এবার একদা মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাক একে অন্যের মূল প্রতিপক্ষ। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্ব। পেরেস্ত্রয়িকা ও গ্লাসনস্তের ধারাবাহিকতায় পতন ঘটল কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের। মানুষের ভালোবাসা আর চোখের জলে গণজাগরণ হলে বার্লিন ওয়াল ধসে পড়ল, পুনঃএকত্রিত হলো পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানি। এই পরিবর্তনের রেশ পড়ল অন্যান্য দেশে ও পৃথিবীর নানান প্রান্তে। রোমানিয়া, পোল্যান্ডের মতো দেশে গণতান্ত্রিক সরকার এল। সারা বিশ্ব বসল নড়েচড়ে। তখনো সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণে কিছু কিছু সংবাদ পেতাম না।

বাংলাদেশের মানুষের মনে বহির্বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহের প্রতি দৃষ্টিপাতের আগ্রহ তত দিনে অনেক বেড়েছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পথ ধরে সামরিক সরকারের পতন ঘটলে বাংলাদেশ পদার্পণ করল ‘গণতান্ত্রিক ধারা’য়। তখন সংবাদপত্র জগতেও দেখা দিল পরিবর্তন। বাংলাদেশে চালু হলো ‘মুক্তবাজার’ অর্থনীতি। মানুষ আরও বেশি ঝুঁকে পড়ল পত্রিকার ওপর। অনেক নতুন নতুন সংবাদপত্র বের হলো একে একে। স্বাধীন মতপ্রকাশে এল নতুন গতি, নতুন মাত্রা। মচমচে কাগজে ঝকঝকে ছাপা নিত্যনতুন অভিনব সংবাদ, ফিচার, রঙিন ছবি-পত্রিকাগুলো রাতারাতি তুমুল গ্রাহকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। মানুষের যত বিভ্রান্তি, প্রশ্ন, কৌতূহল সব মেটানো বা নিরসনের জন্য তখন দেশের স্বাধীন পত্রিকাগুলোই ছিল নির্ভরযোগ্য আঁধার। সংবাদপত্রের ভাষারীতিতেও এসেছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই নতুন জনপ্রিয় ধারার চাপ এমনই, এর ফলে এক সময় দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকাটিকেও পাঠকপ্রিয়তা ধরে রাখতে ভাষারীতিতে পরিবর্তন আনতে হয়েছিল। সাধু রীতিতে সংবাদ পরিবেশনের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য পরিহার করে পত্রিকাটি অন্যদের মতো চলিত ভাষায় সংবাদ প্রকাশ শুরু করল।

সুতরাং, যুগ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় পাঠকের রুচি, পছন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে নিজেকে পরিবর্তনের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। অন্য আট-দশটা ভোগ্যপণ্যের শিল্পের মতোই সংবাদ প্রকাশনাশিল্পের জন্য এটি একটি অবশ্যপালনীয় চর্চা। আগে পাঠকের কাছে দৈনিক পত্রিকা ছিল দৈনন্দিন চা-কফির মতো অভ্যস্ততার বিষয়, এক দিন না হলেই অস্বস্তি হতো। এমনকি যিনি যে পত্রিকার গ্রাহক, তাঁর সামনে অন্য পত্রিকা দিলে তিনি তাতে স্বস্তিবোধ করতেন না। এই আনুগত্যের বিষয়টি এখন আর নেই বললেই চলে। এখন অনেক বেশি সংবাদমাধ্যমের বিকল্প রয়েছে। একচেটিয়া বাজার আর নেই। চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি বলে পাঠককে এখন আর আগের মতো সংবাদের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বরং পাঠক ধরার জন্য ইলেকট্রনিক আর প্রিন্ট মিডিয়ার মধ্যে নিরন্তর প্রতিযোগিতা চলছে। সংবাদে তাই এখন আর স্থায়িত্বের বিষয় নেই, সংবাদ এখন নানান উৎস থেকে ও বিবিধ মাধ্যম দ্বারা চলমান একটি প্রবাহবিশেষ।

এখন সেই প্রবাহে গা ডুবিয়ে বসে থাকতে চায় মানুষ, অথবা বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। এই প্রবাহে ভালো, মন্দ, উষ্ণ, শীতল, সুগন্ধ ও দুর্গন্ধযুক্ত সব স্রোতই প্রবাহিত হয়, মানুষকে স্পর্শ করে যায়। বর্তমান নাগরিক জীবনে এ ছাড়া উপায়ও নেই। কারণ কোন সংবাদ কতটুকু স্পর্শকাতর ও সমাজে স্পন্দন তৈরি করবে তা আগেভাগে অনুমান করা কঠিন। যেমন, আগে একটি সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাড়ার লোকের কাছে পত্রিকান্তরে পৌঁছানো ছিল সৌভাগ্যের বিষয়। পৌঁছালেও তা আসত এক দুই দিনের ব্যবধানে। কেউ তা পেত, কেউ পেত না। এখন সেটি তাৎক্ষণিক পৌঁছে যায় দেশব্যাপী, পৌঁছে যায় বিশ্বব্যাপী। তা থেকে দাবানলের মতো গণ-আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন হয়ে যেতে পারে, ক্ষণে ক্ষণে যার গতিপ্রকৃতি বদলায়। এ কারণে কোনো সংবাদই এখন স্থায়ী নয়, আবার উপেক্ষণীয়ও নয়। প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনযাপন নির্বিঘ্ন রাখতে সব সময় চোখ-কান খোলা রাখায় দায়টি আমাদের এখন নিতেই হয়।

এই পরিবর্তনটি ঘটেছে, কারণ এখন প্রচারযন্ত্র ও প্রচারমাধ্যম-এই দুইয়ের গণতন্ত্রায়ণ ঘটেছে। এখন হাতে হাতে ফোন, ফোনে ফোনে ইন্টারনেট, আর ইন্টারনেটে শত শত পত্রিকা, সংবাদের অগুনতি মাধ্যম হাতের মুঠোয়। পাঠকের এখন বিচরণের স্বাধীনতা উন্মুক্ত। আবার পাঠকও এখন অনেক, নানান বয়স ও শ্রেণিভিত্তিক। এটি ট্র্যাডিশনাল সংবাদপত্র প্রকাশনা শিল্পের জন্য একাধারে চ্যালেঞ্জিং এবং একই সঙ্গে সম্ভাবনাময়। প্রবাসে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকাগুলোর জন্য সে কথা আরও বেশি প্রযোজ্য। মানুষ এখন নিজেই গ্রাহক, নিজেই প্রচারক। যে কেউ এখন সংবাদ, ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রচার করতে পারে।

এর ফলে বিজ্ঞাপন জগতে পরিবর্তন এসেছে, বিজ্ঞাপনদাতাদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। আর বিজ্ঞাপন জগতে পরিবর্তন আসার অর্থ সংবাদপত্র শিল্পের আয়কে তা ছুঁয়ে যাবেই। আজকের এই পরিবর্তিত সময়ে বিজ্ঞাপনদাতা ও সংবাদপত্র কখনো হাত ধরাধরি করে চলে, কখনো হাত ছেড়ে দেয়। টিকে থাকতে হলে এই পরিবর্তনের প্রভাবকগুলোকে বুঝতে হবে। আগে ‘হারিয়ে গেছে’ বা ‘ধরিয়ে দিন’ ধরনের বিজ্ঞাপনও বড় বড় পত্রিকায় ছাপা হতো। এখন তেমন বিজ্ঞাপন সেকেন্ডের ব্যবধানে যে কেউ নিজেই ছাপাতে পারে এবং মুহূর্তে ছড়াতে পারে অগুনতি মানুষের কাছে। এখন বাংলাদেশের পত্রিকায় আর ঢাকাই সিনেমার ছবিসহ বিজ্ঞাপন ছাপা হয় না, ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার প্রভাবে সংবাদপত্র শিল্প যেমন হুমকির মুখে, চলচ্চিত্রশিল্পও চরম অস্তিত্বসংকটে। এক নীরব বিপ্লব ঘটেছে সংবাদ ও সার্বিক যোগাযোগমাধ্যমে।

তাহলে কি সংবাদপত্র ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে? মানুষ পত্রিকা পড়বে না? আমার মতে, প্রিন্ট হোক বা ডিজিটাল-সংবাদপত্র ও পেশাদারি সাংবাদিকতার মূল্য অবশ্যই থাকবে। অনেকে মনে করেন, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পাঠকের আনুগত্য আর আগের জায়গায় নেই। কথাটি সত্য নয়, কেননা ‘মান’ বলতে একটি কথা আছে, যা সর্বত্র প্রযোজ্য। প্রচারমাধ্যমের আধিক্যের কারণে সংবাদের সঙ্গে এখন অনেক অসংবাদ ও গুজব প্রচার হয়। ভালো সংবাদপত্রের দায়িত্ব সেসব পরিহার করে, শোধন করে সংবাদমূল্য আছে এমন সংবাদ ছাপানো। যে পত্রিকা মানসম্পন্ন, যার সংবাদ বস্তুনিষ্ঠ, বিশ্লেষণ জীবনঘনিষ্ঠ-পাঠক নিজের প্রয়োজনেই তার কাছে বারবার ফিরে যাবে। চ্যালেঞ্জ হলো, মান নিশ্চিত করতে পেশাদার সাংবাদিক লাগে, মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করতে হয় এবং এর জন্য পয়সা খরচ হয়। দীর্ঘ মেয়াদে এসবের জোগান অব্যাহতভাবে নিশ্চিত করা সংবাদপত্রশিল্পের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।

আবার মান নিয়ন্ত্রণ নিয়েও সমস্যা আছে প্রকট। সংবাদপত্র যদি ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের হুমকি-ধমকি, চোখরাঙানিতে থাকে, যদি এভাবে তার গলা টিপে ধরা হয় তাহলে অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রকাশ ব্যাহত হয়। পাতা ভরার জন্য সংবাদপত্র তখন কোন ‘নায়িকা শুটিং করতে গিয়ে আছাড় খেয়েছে’ ধরনের সংবাদকেও প্রথম পাতায় স্থান দেয়। অবধারিতভাবে সে ক্ষেত্রে পাঠক ঠকবে। এই চ্যালেঞ্জটি এখন বিশ্বে অনেক দেশে দেখা যাচ্ছে। নানান প্রান্তে গণতন্ত্রে বৈকল্য দেখা দিয়েছে, জাতীয় সমস্যাগুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। এর পেছনে থাকে স্বার্থান্বেষী মহলের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কূটকৌশল। সমাজের দর্পণ তথা সংবাদপত্রই পারে সেটিকে উন্মোচিত করে সবার সামনে তুলে ধরতে। কিন্তু তাতে প্রায়ই ক্ষমতালিপ্সুদের নানাবিধ নিয়ন্ত্রণ, অসহযোগিতা ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন সাংবাদিকেরা কিংবা পুরো সংবাদ-প্রকাশনা শিল্প। এ কারণে মেধাবী অনেকে এই সম্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, আমেরিকায় বাংলা সংবাদপত্রগুলো কাকে প্রতিনিধিত্ব করে? সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকাগুলো কার সংবাদ ছাপে? কারা পাঠক? পাঠকেরা কেন এসব পত্রিকা পড়েন? এই বৈরী সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে পত্রিকাগুলোর ভবিষ্যৎ কী? খুব সাধারণ জ্ঞানে বলা যায়, একটি পত্রিকা সে-ই পড়বে, যে তাতে নিজেকে খুঁজে পায়। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার অর্থ হলো, যে তার আগ্রহের বিষয়টি সেখানে খুঁজে পায়, চিন্তাধারার মিল পায়, ভাবনার খোরাক পায়। প্রবাসে বাংলা পত্রিকাগুলো কি সে ভূমিকা পালন করে? এর কোনো সরাসরি উত্তর নেই, কারণ প্রবাসজীবন বেশ গতিময়। পত্রিকাগুলো তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রবাসের বাংলা পত্রিকাগুলোর জন্য কিছু অনন্য চ্যালেঞ্জ আছে, আছে কিছু অনন্য সম্ভাবনাও। এখানে বিনা মূল্যে পাঠককে পত্রিকা দেওয়া কারণ, গ্রাহকের চাহিদার তুলনায় রয়েছে পত্রিকার আধিক্য। এটি নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জ। পত্রিকার মূল আয় হলো বিজ্ঞাপন। বাংলাদেশি কমিউনিটিতে উল্লেখযোগ্য হারে ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করেছে। তার সঙ্গে বেড়েছে প্রকৃত ও সম্ভাব্য বিজ্ঞাপনদাতার সংখ্যাও। তাঁরা অবগত আছেন, কোন পত্রিকাগুলো পাঠকমহলে যথেষ্ট আদৃত। প্রচারসংখ্যা উচ্চ রাখতে পত্রিকাগুলোও বিনা মূল্যে বিতরণ চালু রেখেছে। সব পত্রিকায় একই বিজ্ঞাপন ছাপা হয়, তাই পত্রিকান্তরে এতে মানের কোনো হেরফের হয় না। প্রবাসের বাংলা পত্রিকাগুলোর ভেতর মূল পার্থক্য বা প্রতিযোগিতার আসল জায়গাটি হলো সংবাদের মান, সৃজনশীল লেখার মান, অঙ্গসজ্জা ও বিন্যাস ইত্যাদিতে। পাঠক কোন পত্রিকাটিকে বাজার থেকে লাউ, আনাজ, তরকারি পেঁচিয়ে আনার কাজে ব্যবহার করবে, দ্বিতীয়বার ভাববে না, আর কোনোটিকে পড়া ব্যতীত অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করতে সংকোচ বোধ করবে, তা নির্ভর করবে এর ভেতর কী ছাপা হয়েছে তার ওপর।

প্রশ্ন রয়ে যায়, মানুষ কি পড়ে? কী পড়ে? প্রথমটির উত্তর, অবশ্যই হ্যাঁ। মানুষ পড়ে এবং পড়ার পরিমাণ শুধু বাড়ছেই। এখানে ভাষা একটি সমস্যা। কারণ, প্রবাসে এলে কাজ আর জীবনযাত্রার চাপে মাতৃভাষায় পড়ালেখা সবার আগে সংকটে পড়ে। সেটি কাটিয়ে উঠতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর বিবিধ। এখানেই লুকিয়ে আছে প্রবাসের বাংলা পত্রিকার সম্ভাবনার জায়গাটি, পত্রিকার মানের জায়গাটি।

পত্রিকার যেমন প্রোপাগান্ডা উসকে দেওয়ার ক্ষমতা আছে, এর আছে ক্যাম্পেইন বা সামাজিক আন্দোলন করার অনন্য সুযোগ। যেকোনো সামাজিক সমস্যা নিয়ে মানুষের সচেতনতা সৃষ্টি, বৃদ্ধি কিংবা একটি ধারায় পরিচালিত করতে পারে কমিউনিটি সংবাদপত্রগুলো। যেসব সামাজিক সংকট প্রবাসে বাঙালিদের জীবনযাত্রাকে ছুঁয়ে যায়, ‘ঘরকুনো’ বাঙালির সেই সংকটগুলোকে তুলে আনতে পারলে, ডায়ালগ উসকে দিতে পারলে অবধারিতভাবে সংবাদপত্রগুলো কমিউনিটির মুখপাত্রের মর্যাদা পাবে। একধরনের নেতৃত্বের জায়গায় চলে আসবে। মানুষ তার ওপর নির্ভর করবে। কমিউনিটির নতুন প্রজন্ম যতই ইংরেজি ভাষাভাষী হোক না কেন, বহির্বিশ্ব তাদের বাঙালি হিসেবে দেখে ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করে। নতুন প্রজন্ম ও তার অভিভাবকদের সেটি স্মরণে রাখতে হবে।

ওপরের এই বিষয়টি আমাদের অনেকের অজান্তেই অনেক আগে ভিন্ন স্তরে প্রবেশ করেছে। আমেরিকায় বসবাসরত অভিবাসী মানুষেরা উঠে আসে জটিল ও মিশ্র সব জাতি, গোত্র, ভাষা, ধর্ম, পরিপার্শ্ব, ভাবধারা ও সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে। এ দেশের শীর্ষ নীতিনির্ধারক মহল অনুধাবন করেছে যে, তাদের কাউন্টার টেররিজম সংস্থার লোকেরা শুধু ইংরেজি পত্রিকা পড়েই বাইরের এই জটিল পৃথিবী সম্পর্কে জানার যে চেষ্টা করত, সেটি মোটেই কার্যকর নয়। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের চৈতন্যপ্রবাহ সম্পর্কে জানতে হলে স্থানীয় ভাষায় প্রকাশিত তথ্য ও সংবাদপ্রবাহের যে স্রোত সেদিকে নজর দিতে হবে, তার ভেতর তাদের প্রবেশ করতে হবে। ২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে এ প্রসঙ্গে একটি নিবন্ধ ছাপা হয় যার শিরোনাম ছিল, “Why We Can’t Just Read English Newspapers to Understand Terrorism”.

শুধু নিউইয়র্কেই বিভিন্ন এলাকায় বাঙালি কমিউনিটির নানান সংকট ও চ্যালেঞ্জ আছে, আছে সাফল্যের গল্প। একইভাবে, এ দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালিদের ক্ষেত্রে তা আরও অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। সেসব মানুষ যেন পত্রিকায় তার জীবনের ছবি দেখতে পায়। যেমন, প্রবাসে বাঙালি অভিভাবক এবং তাদের সন্তানেরা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, বিয়েগুলোর স্থায়িত্ব কেমন হচ্ছে, কী কী কারণে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে ইত্যাদি বিষয় অনেকেই জানতে চায়। জানতে চায়, নগর কোনদিকে বিস্তার লাভ করছে, কোথায় বাড়িঘর আবাসস্থল ক্রয় করা ভালো, বসবাস করা ভালো। পেশাগত পরামর্শ, আইনগত পরামর্শ-দুটিই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন পেশায় কী দক্ষতা প্রয়োজন এবং তা কোথায় শেখা যাবে, কোনটি ভবিষ্যতের জন্য আকর্ষণীয় পেশা, প্রবাসে চাকরিবাকরি ও জীবনধারণের জন্য কী কী আইনি সমস্যা ও প্রশ্ন মোকাবিলা করতে হয় এবং এর সমাধান ইত্যাদি।

প্রবাসে বাংলা পত্রিকাগুলোর আরেকটি সম্ভাবনার জায়গা হলো পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা। এই পত্রিকাগুলোই পারে প্রবাসে পূর্ব-পশ্চিমের বাধা দূর করতে। নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকাগুলো প্রধানত বাংলাদেশকে তুলে ধরে এবং বাংলাদেশি লেখক ও পাঠকদের ওপর নির্ভরশীল। এ দেশে পশ্চিমবঙ্গের যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি বাস করেন, এখন সময় তাঁদের আকৃষ্ট করার, তাতে পত্রিকাগুলো আরও বেশি নতুন লেখক ও পাঠক সমাদৃত হবে। পশ্চিমবঙ্গের লেখক ও পাঠকদের সম্পৃক্ত করতে পারলে পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে পৃথিবীর অন্যত্র বসবাসরত সব বাংলা ভাষাভাষীর কাছে পৌঁছার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি বড় উদাহরণ বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগ। বিদেশি এসব সংবাদ সংস্থা এ দেশের সংবাদ প্রচার করে এ দেশে এখনো গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখেছে এবং দেশের অনেক সংবাদমাধ্যমের চেয়ে দেশের মানুষের কাছে নানান সময়ে এরা বেশি গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে। পৃথিবীর আর কোন দেশে এমন নজির আছে কি না, আমার জানা নেই। প্রবাসের বাংলা পত্রিকাগুলো বিশেষ করে যাদের অনলাইন পোর্টাল আছে, তাদের পক্ষে সেই সাফল্যের অনুরূপ অর্জন করা কঠিন কিছু নয়।

প্রবাসে বাংলা পত্রিকাগুলোর আরেকটি আকর্ষণীয় ও সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হতে পারে ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’। নিউইয়র্কে বসবাস করে পৃথিবীর যেকোনো গ্রন্থ হাতের নাগালে পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। বাংলা ও বিদেশি ভাষার সমসাময়িক ভালো বইগুলো নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা হলে সেটি নিঃসন্দেহে অনেক পাঠককে আকৃষ্ট করবে। আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রবেশের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো কী এবং তা কীভাবে অতিক্রম করা যায়, সে ব্যাপারে পত্রিকাগুলোতে আলোচনা হওয়া উচিত।