রবীন্দ্রনাথের গানে বাউলের প্রভাব

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মজীবনে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের বিভিন্ন ঘরানার সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। কিন্তু বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাউলগানের সঙ্গে তাঁর প্রতিভার মিশ্রণে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তিনি চালিয়েছেন, তার ফসল একজন গীতিকার ও সুরকার হিসেবে তাঁকে এক নতুন উচ্চতায় বসিয়ে দিয়েছে। রবিঠাকুর বাউলসংগীতের ১০০টি গান নিয়ে সংগীত পরিবেশন করেন। আগেই বলেছি, সংগীত শৈলীর মূল উপজীব্য বাউলপ্রধান হলেও, সেগুলোর ওপর নোবেল বিজয়ী কবির নিজের সৃজনশীলতার প্রভাব ছিল। তাঁর সৃজনশীলতা মেশানো বাউলের প্রভাব সংগীত ছাড়াও অনেক কবিতা ও ছোটগল্পের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে স্বীকার করেছেন, বাউলগান আর এই গানের দর্শন তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। ১৯৩০ সালে তিনি হিবার্ট ট্রাস্ট আয়োজিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক অ-গোষ্ঠীগত, আধ্যাত্মিক বিষয়ের ওপর ধারাবাহিক ভাষণ প্রোগ্রামের অন্যতম বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন। ওই বক্তব্যেই তিনি এ সত্যটি স্বীকার করেছেন। 

পরে এই লেকচারগুলো ‘মানুষের ধর্ম’ বা ‘রিলিজিয়ন অব ম্যান’ নামে একটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে তিনি লিখেছেন, ‘দেখেশুনে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথায় উল্লেখ করেছি যে, একেবারে পাড়া গাঁয়ে কিছু লোক নিজের মনে গান গেয়ে চলেছেন। এঁরা একটি গোত্রের লোক, বাংলার জনপ্রিয় এক সম্প্রদায়, যাঁরা বাউল নামে পরিচিত। তাঁদের কাছে কোনো মূর্তি নেই, মন্দির নেই, শাস্ত্র বা তা নিয়ে অনুষ্ঠান নেই। তাঁরা গানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যকার দেবত্বকে প্রকাশ করে এবং সেই মানুষকে ভালোবাসার প্রতি এক তীব্র অনুভূতি ব্যক্ত করে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউলগানের এই ‘লিরিক্যাল বিউটি অ্যান্ড টিউন’-এ গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বাউল দর্শনের আধ্যাত্মিক রোমান্টিকতায় রবীন্দ্রনাথ এতটা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি নিজেকে রবীন্দ্র-বাউল বলে সম্বোধন করা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁর ‘ফাল্গুনী’ নাটকে নিজেই এক অন্ধ বাউল চরিত্রে অভিনয় করেন। এ কথা অনেক খ্যাতিমান রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর কাছ থেকে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর বাউল প্রভাবিত গানগুলোকে ‘রবীন্দ্র-বাউলের গান’ হিসেবে অভিহিত করেন। এ ধরনের অসংখ্য গান আছে। কিছু উদাহরণ দিতে গেলে যেসব গানের নাম চলে আসে, সেগুলো হলো—
‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’; ‘তুমি যে সুরের আগুন জ্বালিয়ে দিলে’; ‘সে দিনে আপদ আমার যাবে কেটে’; ‘সবাই যারে সব দিতেছে’; ‘রইল বলে রাখলে কারে’; ‘ফিরে চল মাটির টানে’; ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়’; ‘কান্না হাসির দোল দোলানো’; ‘আমি তারেই খুঁজে বেড়াই’; ‘ও আমার মন যখন’; ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ’; ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’; ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’; ‘যে তোরে পাগল বলে’; ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’; ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’; ‘ও আমার দেশের মাটি’; ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন হবেই হবে’; ‘মালা হতে খসে পড়া’; ‘আমি যখন ছিলাম অন্ধ’; ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’; ‘ডাকব না ডাকব না’ ধরনের অনেক গান। এসব গান শত বছর পর আজও সমান জনপ্রিয়। এমনকি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতটিও বাউলসংগীত, যা ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটি দ্বারা প্রভাবিত।
বাউলগানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় ১৮৯০ থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে। তখন তিনি কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ প্রভৃতি এলাকায় তাঁর বাবার জমিদারি দেখাশোনা করতেন। এ সময় সাধারণ গ্রাম্য মানুষদের সঙ্গে তাঁর চিন্তার আদান-প্রদান হয়। এর ফলে পাশ্চাত্যের সাহিত্য, সভ্যতা প্রভাবিত রোমান্টিক কবি, রবিঠাকুরের চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি রোমান্টিক কবি থেকে প্রকৃত মিস্টিক কবিতে রূপান্তরিত হন।
প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ বলেন, ‘যখন রবিঠাকুর তখনকার পূর্ব বাংলায় থাকতেন, সে সময় তিনি সেখানকার বাউলদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। এই বাউলেরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন এবং গান দিয়ে মানুষকে মুগ্ধ করতেন। সেই সব গানের কথা অতি সাধারণ অথচ এর সুর এতই চিত্তাকর্ষক ছিল যে, সাধারণ জনগণ সেসব গান শুনে একেবারে বিমোহিত হয়ে পড়ত।’
১৯১২ সালে লন্ডনে রবীন্দ্রনাথের কাব্য সংকলন ‘গীতাঞ্জলি’ প্রকাশিত হয় এবং ১৯১৩ সালে তিনি এই ‘গীতাঞ্জলি’র জন্য নোবেল পুরস্কার পান। তিনিই প্রথম অ-ইউরোপিয়ান, যিনি অতীব মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কারটি জিতেছিলেন। সে সময় একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম সংবাদটি এভাবে প্রকাশ করেছিল যে, ‘ইস্ট থেকে এক সাধুবাবা এসে নোবেল পুরস্কারটি জয় করে নিয়ে চলে গেল।’
বাউলগানের জন্য রবীন্দ্রনাথের মোহ এতটাই ছিল যে, তিনি কলকাতা-ভিত্তিক মাসিক প্রবাসী পত্রিকাতে মৌখিকভাবে প্রচলিত লোকসংগীত মৌখিক সংগীতধারা হিসেবে নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা করেন। অনেক গবেষকের মতে, সেটাই ছিল বাউলগানের প্রথম ডকুমেন্টেশন। এ সময় তিনি কবি কালীমোহন ঘোষের গাওয়া ‘ফকির লালন শাহ’-এর গানের কপি করারও ব্যবস্থা করেন। তিনি কাশীতি মোহন সেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাউলসংগীত ইংরেজিতে অনুবাদ করে একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক পাঠককুল ও বাউলসংগীতের শ্রোতা তৈরি করার কাজও করেন। এসব কথা বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থার সভাপতি তপন মাহমুদের মতামত থেকে জানা যায়।
বস্তুত বাউল গানের শীর্ণ নদী বেয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সারা জীবনে নানা আধ্যাত্মিক উৎকণ্ঠার অনেক সন্তোষজনক সূত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর জীবনদর্শন ও ধর্মচিন্তায় বাউল গানের প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট।