খান সাহেবের ইফতার মাহফিল

রমজান মাসের প্রথম শুক্রবার সকালবেলা, খান সাহেব মনের ভেতরে খুব একটা পেরেশানি ভাব নিয়ে হাঁটাচলা করছেন। রমজানের প্রথম শুক্রবারে তাঁর তৃতীয় ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে ইফতারি আসবে। এ উপলক্ষে তাঁর বাড়িতে বিশেষ ইফতার মাহফিলের আয়োজন হবে। জুমার নামাজের পর মিম্বরের পাশে দাঁড়িয়ে গ্রামের উপস্থিত সবাইকে তিনি বেশ ঘটা করে, মনে শান নিয়ে ইফতারের দাওয়াত দেবেন আজ। খান সাহেবের নামের আগে এখন আলহাজ শব্দটা যুক্ত হয়েছে। গ্রামের সবাই এখন তাঁকে একজন পরহেজগার মুসল্লি হিসেবে বেশ সমীহ করেন। বিশেষ করে প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পরে মোনাজাতের সময় ইমাম সাহেব এলাকার বিশিষ্ট মুরব্বি খান সাহেবের কল্যাণের জন্য দু-একটা বাক্য বলতে কখনো ভুল করেন না।
কর্মজীবনে খান সাহেব ছিলেন উপজেলা ভূমি অফিসের প্রভাবশালী কর্মচারী। কর্মজীবনে বাড়তি উপার্জনের ব্যাপারে খান সাহেবের তেমন কোনো কুণ্ঠাবোধ ছিল না। মাঝেমধ্যে যখন মনে পড়ে, তখন শুধু ভাবেন তিনি তো আর জোর-জবরদস্তি করে কারও কাছ থেকে কিছু আদায় করেননি। মানুষজন তাঁদের নিজস্ব প্রয়োজনেই তাঁর কাছে আসতেন এবং নিজেদের খায়েশে কাজ করিয়ে খুশি হয়ে তাঁর পকেট ভরিয়ে দিতেন। বাড়তি উপার্জনের টাকায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার পর নিজ দায়িত্বে তিনি দুবার হজ করে এসেছেন। প্রতি বছর বেশ বড় আয়োজন করেই জাকাত বিতরণ করেন, কোরবানি দেন। এদিকে রমজান মাসে ইফতার মাহফিলের আয়োজন তো করেনই। উপার্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে যদি কোনো পাপ হয়েও থাকে, সেগুলো তো পুণ্যের সঙ্গে কাটাকাটি হয়ে গেছে অনেক আগেই। এই শেষ বয়সে এসে তিনি শুধু খান পরিবারের দানশীল-পরহেজগারি পরিচয়টা পাকাপোক্ত করে যেতে চান।
খান সাহেবের চার ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে পরিবার নিয়ে বিলেতে থাকেন। দ্বিতীয় ছেলে শহরে থেকে ব্যবসা করেন, মাঝেমধ্যে বউ-বাচ্চা নিয়ে গ্রামে বেড়াতে আসেন। তৃতীয় ছেলে পড়াশোনা শেষ করে বেশ নামকরা একটা ব্যাংকে চাকরি করেন। আর ছোট ছেলে ইউনিভার্সিটিতে পড়েন, থাকেন ঢাকায় খান সাহেবের বড় ছেলের শ্বশুরের বাসায়। ছোট ছেলের এই থাকাটাকে খান সাহেব লজিং থাকা বলে মনে করেন না। আত্মীয়তার খাতিরে একটা অধিকার নিয়েই তিনি তাঁর ছোট ছেলেকে বেয়াইয়ের বাসায় থাকতে পাঠিয়েছেন; এ আর এমন কী। আর বড় ছেলের শ্বশুর ইচ্ছা করলেই মেয়ের বিয়ের সময় ঢাকা শহরের একটা ফ্ল্যাট নিজের বিলাতি জামাইয়ের নামে লিখে দিতে পারতেন। এ রকম গুণধর বিলাতি জামাই কজন মেয়ের কপালে জোটে? যা হোক, খান সাহেবের তৃতীয় ছেলের বিয়ে হয়েছে শায়েরের দিদির সঙ্গে। শায়েরদের বাড়ি থেকেই আজকে খান সাহেবের বাড়িতে ইফতারি আসবে। শায়েরের অবসরপ্রাপ্ত বাবা নিজের শরীরের ওপর তেমন একটা ভরসা রাখতে পারেন না। তাই রমজান শুরুর আগেই তিনি খান সাহেবকে ফোন করে ইফতারি পাঠানোর দিন-তারিখ ঠিক করে রেখেছেন।
অন্য শুক্রবারের চেয়ে আজকের শুক্রবারটা একটু অন্য রকমের। খান সাহেব সকাল থেকেই অনেক পেরেশানি করে দাড়ি-গোঁফ ছেঁটে ঠিক করে, গোসল সেরে, চোখে সুরমা দিয়ে, গায়ে আতর মেখে মসজিদে গেলেন। জুমার জামায়াতের পরে সামনের কাতারে মিম্বরের পাশে দাঁড়িয়ে বেশ উন্নত বক্ষে গ্রামের সবাইকে ইফতার মাহফিলের দাওয়াত দিয়ে আসলেন। বাড়িতে ফিরে গরম সহ্য হচ্ছিল না বলে বাইরের ঘরের বারান্দায় ইজিচেয়ার পেতে বসে আছেন। দুজন কাজের লোক হাতপাখা দিয়ে সমানে খান সাহেবের মাথায় বাতাস করে যাচ্ছেন। তারপরও খান সাহেবের মন থেকে পেরেশানি দূর হচ্ছে না। বারবার মাথায় চিন্তা আসছে, তাঁর বেয়াই, মানে শায়েরের বাবা কী পরিমাণে ইফতারসামগ্রী পাঠাচ্ছেন? যতটুকু পাঠাবেন ততটুকু দিয়ে গ্রামের লোকজনের কাছে খান সাহেবের মুখ রক্ষা হবে তো? শায়ের ইফতারির সবকিছু নিয়ে সময়ের আগে এসে পৌঁছাতে পারবে তো? এসব ভাবতে ভাবতে মনে মনে ঠিক করে নিলেন, শায়ের এসে পৌঁছামাত্র তিনি নিজে গিয়ে সবগুলো প্যাকেট গুনে দেখবেন, বিরিয়ানির হাঁড়ি নিজ হাতে খুলে পরখ করে নেবেন, খান বাড়ির ইফতার মাহফিল বলে কথা। যদিও তিনি আগে থেকেই তাঁর বেয়াইকে গ্রামের লোকজনের সংখ্যা সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে রেখেছেন। এসব ভাবতে ভাবতেই খান সাহেবের মাথায় নতুন আরেক চিন্তার উদয় হলো। এবারের রমজান মাসে তো শুক্রবার চারটা। তিন বেয়াইয়ের বাড়ি থেকে যা ইফতারি আসবে, তাতে তিন শুক্রবারের মাহফিলের আয়োজন হয়ে যাবে। চতুর্থ শুক্রবারে তিনি কী করবেন?
নতুন চিন্তা মাথায় আসাতে তিনি লতিফা বেগমকে কাছে ডাকলেন। লতিফা বেগম খান সাহেবের স্ত্রী। লতিফা বেগমের মা-বাবা অনেক আগেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর এক মামা ছিলেন, সেই মামা প্রতি বছর ভাগনির বাড়িতে ইফতারি নিয়ে আসতেন। লতিফা বেগমের মামাও গত বছর কোরবানি ঈদের পরের দিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। লতিফা বেগম কাছে এসে সালাম দিয়ে খান সাহেবের পাশের চেয়ারে বসলেন এবং কাজের লোকের হাত থেকে পাখা নিয়ে, নিজেই তাঁর স্বামীকে বাতাস করতে লাগলেন। খান সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে লতিফা বেগমের সঙ্গে আলাপ শুরু করলেন। ‘তোমার যে দুইটা মামাতো ভাই আছে, ওরা তো দেখি তোমার কোনো খোঁজই রাখে না। মামা মারা যাওয়ার পর থেকে একবার কি দুইবার বড়টা এসেছিল, তারপর আর কোনো খবর পাই না ওদের। এই যে রমজান মাস আসল, ওদের তো উচিত ছিল একবার এসে আমার কাছ থেকে জেনে নেওয়া যে, কবে কোনদিন তোমার ইফতারি নিয়ে আসলে আমার সুবিধা হবে। মামা মারা গেছেন বলে তো আর আমাদের আত্মীয়তা শেষ হয়ে যায়নি। মামা নেই, তাই এখন এসব দায়িত্ব তো ওদেরকেই নিতে হবে, তাই না?’
এবার লতিফা বেগম মৃদু স্বরে বলতে শুরু করলেন, ‘দেখুন, মামা থাকতে ওদের অবস্থাটা একটু ভালো ছিল। মামার পেনশনের টাকা আর খেত গৃহস্তি দিয়েই ওদের ভালোই চলে যেত। এখন মামার পেনশনের টাকাটা তো বন্ধ হয়ে গেছে, আর ভাই দুইটাও তেমন কিছু করে না। ছোটটা তো এখনো পড়াশোনা করছে। বড়টা খেত গৃহস্তি দেখে। ওই করে কোনোমতে ওরা চলছে। মাঝে দুইবার বড়টা আমার কাছে সাহায্যের জন্যই এসেছিল। তখন তো কিছু দিতে পারিনি। এখন আবার ওদের এই অবস্থার মধ্যে ইফতারি পাঠানোর কথাটা বলি কী করে?’
লতিফা বেগমের কথা শুনে খান সাহেব তেলে-বেগুনে রেগে গেলেন। বললেন, ‘তোমার এত কিছু বুঝার ধৈর্য আমার নেই। তোমার মামাতো ভাই দুটাকে বলে দিয়ো, রমজান মাসে নিজের একমাত্র ফুপাতো বোনের বাড়িতে যদি একদিন ইফতারি নিয়ে আসার মুরোদ না থাকে, তাহলে তারা যেন আমাদের আত্মীয় বলে পরিচয় না দেয়। শবে কদরের পরের দিন যখন আমি, জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করব, সেদিন যেন থালা নিয়ে এসে আমার উঠানে বসে...। আমি তো আগেই ঠিক করে রেখেছি, এবারের রমজানে প্রতিটা শুক্রবারে আমার বাড়িতে ইফতার মাহফিল আয়োজন করে, গ্রামের সবাইকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াব। তিন বেয়াইয়ের বাড়ি থেকে তো তিন শুক্রবারে ইফতারি আসবেই। এখন শেষ শুক্রবারটা কি আমি আমার গাঁটের পয়সা দিয়ে লোকজনকে খাওয়াব নাকি?’
খান সাহেবের রাগ দেখে লতিফা বেগম কোনো কিছু বলার ভাষা ও সাহস দুটোই যেন হারিয়ে ফেলেছেন। শাড়ির আঁচলের কোনা মুখে গুঁজে দিয়ে শক্ত কামড়ে নিজের বুক ফাটা কান্না থামানোর চেষ্টা করতে করতে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।
এদিকে শায়েরের বাবা, ইফতারির সব পদের ঠিকঠাক আয়োজন করে সবকিছু শায়েরকে নিয়ে গাড়িতে তুললেন। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আগে ড্রাইভারের সঙ্গে সব কথাবার্তা শেষ করে, গাড়ির জ্বালানি ও ভাড়ার টাকা মিটিয়ে দিলেন। শায়েরের পকেটে দু শ টাকা দিয়ে বললেন, ‘ভাড়ার টাকা দিয়ে দিয়েছি। তুই শুধু ব্রিজ পার হওয়ার টোলের টাকাটা দিস। আর আসার সময় আমার জন্য সামান্য পান, আর তোর মায়ের প্রেশারের ওষুধটা নিয়ে আসিস। বেয়াই-বেয়াইনকে আমাদের সালাম দিস। ফি আমানিল্লাহ।’ বাবার কথা শুনে আর পেরেশানি দেখে, শায়ের নিজের অজান্তেই মনে মনে হাসে আর ভাবে, কী লাভ হলো দিদিকে এতটা পড়াশোনা করিয়ে, আর শিক্ষিত চাকরিজীবীর কাছে বিয়ে দিয়ে? সেই তো মহল্লার আর দশটা কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার মতোই, আমার বাবাকেও ট্রাকভর্তি যৌতুক দিয়েই দিদিকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে হলো। আর বছরের একেক মৌসুমে একেক আয়োজনের যৌতুক প্রথা বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে বাবাকে। বাবাকে শুধু ‘বাবা’ বলেই হয়তো সবকিছু নীরবে মেনে নিতে হচ্ছে। দিদির জামাইটাও যেন কেমন। একজন শিক্ষিত মানুষ, নামকরা একটা ব্যাংকে চাকরি করেও নিজের পরিবারের যৌতুকি লোভ সামাল দিতে পারেন না? কী আজব আমাদের সামাজিক সংস্কৃতি! গাড়িতে বসে বসে শায়ের সিদ্ধান্ত নেয়, নিজের জীবনে আর কিছু করতে পারুক আর না পারুক, যৌতুকের অভিশাপ আর ভণ্ডামি থেকে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে সে মুক্ত রাখবেই। আর শায়ের জানে, তার এ রকম সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তার পক্ষে সবচেয়ে বড় সমর্থন হবেন তার বাবাই। শায়ের মনে মনে খুশি হয়। বাবার প্রতি পরম শ্রদ্ধা অনুভব করে সে।
কিছুক্ষণ পর, খান সাহেব দেখতে পেলেন একটা সাদা রঙের মাইক্রো তাঁর বাড়ির রাস্তা দিয়ে ঢুকছে। শায়ের ইফতারসামগ্রী নিয়ে এসে গেছে বুঝতে পেরে, খান সাহেব পাঞ্জাবি গায়ে দেওয়ার উদ্দেশে ঘরের দিকে রওনা হলেন। কাজের লোক দুজন হাতপাখা রেখে দিয়ে, হাঁকডাক দিয়ে বাকি দুজন কাজের লোককে এনে হাজির করলেন। শায়ের গাড়ি থেকে নেমে তালই সাহেবকে সালাম দিতেই খান সাহেব দ্রুত গাড়ির পাশে চলে আসলেন। গাড়ি থেকে একে একে সব উপকরণ নামানো হচ্ছে, আর খান সাহেব নির্লজ্জ চোখে তা দেখছেন আর মনে মনে হিসাব কষছেন। শায়ের খান সাহেবের অনুমতি নিয়েই দিদির সঙ্গে দেখা করার জন্য বাড়ির ভেতরের দিকে গেল। শায়ের মাওইমাকে দেখে সালাম দিল। দিদি এসে শায়েরকে জড়িয়ে ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল।
মা-বাবার কুশলাদি জিজ্ঞেস করেই দিদি খুব তাড়াতাড়ি কাজের কথায় চলে আসলেন। ইফতার মাহফিলে অনেক মেহমান আসবেন, দিদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে অতিথি আপ্যায়নে। তাই তড়িঘড়ি করে কাজের কথা সব শায়েরকে আগেই বলে রাখছেন। ঈদের উপহার হিসেবে দিদির শ্বশুরবাড়ির কার জন্য কী কিনতে হবে, ঈদের দাওয়াত খান সাহেবের কাছে কীভাবে পৌঁছাতে হবে, কজন কাজের লোক আজকের মাহফিলে কাজ করছে, কাজের লোকদের শায়েরকে কত টাকা করে বকশিশ দিতে হবে ইত্যাদি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো দিদি এক নিশ্বাসে বলে গেলেন। শায়ের শান্ত বাচ্চার মতো সব কথা শুনল। সব বলার পর শায়েরের সবকিছু ঠিকঠাক মনে থাকবে কি না তাও জিজ্ঞেস করলেন দিদি। শায়ের খুব আলতোভাবে বলল, ‘খুব ভালো করেই মনে থাকবে দিদি।’
দিদি শায়েরকে বেডরুমে বসিয়ে রেখেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। শায়ের মনে মনে ভাবতে লাগল, আসার পথে ব্রিজের টোল পরিশোধ করার পর তার পকেটে এখন মাত্র ১৮৪ টাকা আছে। ১৮৪ টাকা থেকে ফিরতি পথের গাড়ি ভাড়া, বাবার জন্য পান, আর মায়ের ওষুধ কেনার বাজেট আগে থেকেই করা। এখন এখানে বসে চারজন কাজের লোকের বকশিশের টাকার হিসাবটাও তাকে মিলাতে হবে। এদিকে এরা আবার দিদির শ্বশুরবাড়ির কাজের লোক, যেনতেন পরিমাণে বকশিশ দিলে কিন্তু দিদির ইজ্জত একদম মাটিতে মিশে যাবে। দিদি খুব গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপারটা শায়েরকে বুঝিয়ে বলে গেলেন।
ইফতারের আগে আগে, ইমাম সাহেব মোনাজাত ধরলেন। মাহফিলের আয়োজনের জন্য খান সাহেবের খুব করে প্রশংসা করলেন আল্লাহর কাছে। বেশ লম্বা সময় নিয়ে খান সাহেবের সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু আর উত্তরোত্তর মঙ্গল কামনা করলেন। শায়ের মনে মনে ভাবল, খান সাহেবের জন্য ইমাম সাহেব অনেক লম্বা সময় নিয়ে আল্লাহর কাছে অনেক কিছুই চাইলেন, কিন্তু এই ইফতার মাহফিলের জন্য তো শায়েরের বাবা, নিজের শরীরের ঘাম আর জমানো টাকা সব ব্যয় করে বসে রইলেন। ইমাম সাহেব তো শায়েরের বাবার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে কিছু বললেনই না। যা হোক, এতে শায়েরের মন খারাপ করার মতো কিছু হয়নি। কারণ, আল্লাহ তো নিজে থেকেই সবকিছু জানেন এবং বোঝেন। খান সাহেবের জন্য তোষামোদি এই মোনাজাতে নিজের বাবার নাম না শুনেই বরং শায়েরের বেশি ভালো লাগছে। আর ইমাম সাহেবই বা কী দোয়া করবেন শায়েরের বাবার জন্য? নিজের দিদিই এখন আর তার বাবার কষ্টের কথা ভাবতে পারেন না। ইফতারি নিয়ে আসতে না আসতেই, শায়েরের কাছে নিজের শ্বশুরবাড়ির পরবর্তী ডিমান্ড-লিস্টটা খুব অকপটেই পেশ করে দিলেন তিনি!
ইফতার মাহফিল, নামাজ, দোয়া-কালাম সব শেষে এবার শায়েরের বিদায় নিয়ে বাড়ি ফেরার পালা। চলমান রীতিনীতির অংশ হিসেবে শায়েরের দুলা ভাই শায়েরকে নিয়ে তাঁর রুমে গেলেন, শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে সালাম পৌঁছানোর দায়িত্ব শায়েরকে দিয়ে এক শ টাকার পাঁচটা চকচকে নতুন নোট শায়েরের পকেটে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোমার ঈদ উপহার, কিছু কিনে নিয়ো।’ শ্যালক-বোনজামাইয়ের আলাপ পর্ব শেষে, শায়ের মাওইমাকে সালাম করে খান সাহেবের বৈঠকখানার দিকে রওনা দিল। তালই সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দেবে বাড়ির পথে। দিদি পেছন থেকে দৌড়ে এসে শায়েরের কানে কানে মনে করিয়ে দিলেন, কাজের লোকদের বকশিসের টাকাটা যেন শায়ের খান সাহেবের সামনে বসেই দেয়, বলেই আবার হাঁকডাক দিয়ে কাজের লোকদের খান সাহেবের বৈঠকখানায় হাজির করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শায়ের চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে বৈঠকখানার দিকে, আর মনে মনে বলল, ‘হ্যাঁ দিদি, তোমার ইজ্জতটা মাটিতে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আল্লাহ পাক তাঁর নিজ হাতে তা লুফে নিলেন এবং তাঁর একজন শিক্ষিত বান্দার মাধ্যমে সেই ইজ্জত তিনি একটু আগেই আমার পকেটে ভরে দিয়েছেন। তুমি চিন্তা কোরো না, আমি তোমার ইজ্জত ঠিকমতো সামলে নিয়েই বিদায় হব...।’