হাওয়াই জাহাজ

রমজান মাস শুরু। রোজার পরেই ঈদ। রোজা ও ঈদ মিলিয়ে দীর্ঘ এক মাস আট দিন স্কুল ছুটি। ছুটির ঘণ্টা পড়তেই ছেলেমেয়েরা হই হল্লা করে বেরিয়ে পড়ল। যেন একটা দৌড়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল কে আগে বাড়ি পৌঁছতে পারে!
সায়মা যখন বাড়ি পৌঁছাল তখনো হাঁপাচ্ছিল। বাড়ি এসে তার সামনে পড়ল কাজের মেয়ে রহিমা। মাকে সামনে না পেয়ে তার কাছে জিজ্ঞেস করল, রহিমা খালা মা কোথায়? সায়মার কণ্ঠ শুনে মা সাড়া দিলেন, আমি এই, এখানে। তোর ভাইয়াকে ঘুম পাড়াচ্ছি। মায়ের সাড়া পেয়ে তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল।
—মা আমাদের স্কুল রোজা ও ঈদের জন্য এক মাস আট দিন ছুটি! অনেক দিন স্কুল নেই, লেখাপড়ার চাপ নেই। সারা দিন শুধু খেলা আর খেলা। রোজার ছুটিতে আমরা কিন্তু মামা বাড়ি বেড়াতে যাব, ঠিক আছে?
সায়মার উৎফুল্ল দেখে ছোট ছেলেটাও দুধ খাওয়া ছেড়ে ডাগর ডাগর চোখে তার দিকে চেয়ে রইল। সায়মা তাকেও বলল, যেন সেও সবকিছু বোঝে, ‘রোজার ছুটিতে আমরা মামা বাড়ি যাব, তাই না ভাইয়া?’
—ঠিক আছে যাবি। আগে হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নে। একা একা পুকুর ঘাটে যাসনে, পড়ে যাবি। টিউবওয়েলে যা।
—আমি টিউবওয়েল চাপতে পারি না, ভারী শক্ত।
—দেখ রহিমা কই? তাকে ডেকে নে। সে চেপে দেবে।
কলপাড় থেকে সায়মা হাত মুখ ধুয়ে আবার মায়ের কাছে ফিরে এসেছে। ছোট ভাইটিও ঘুমিয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। এসেই মাকে বলল, খুব ক্ষুধা পেয়েছে, খেতে দাও। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে রোজা আর ঈদ নিয়ে এ-কথা সে-কথা জিজ্ঞেস করে সায়মা। মা বললেন, ‘তোর এত কথার জবাব দিতে পারব না। তাড়াতাড়ি খেয়ে দাদির কাছে গিয়ে শোন। খুশির খবরও আছে একটা তোর চাচু আজ সকালে মোবাইল করেছিল।’
চাচু নামে পাগল মেয়ে। সে যখন ছোট্ট শিশু কেবল এক পা, দুই পা হাঁটতে শিখেছে তখন চাচু আমেরিকা চলে যায়। দেশে থাকতে চাচু তাকে সারা দিন কোলে কাঁধে রাখত, কাছে নিয়ে ঘুম পাড়াত, আদর করত। প্রবাসে গিয়েও আদর অব্যাহত রেখেছেন। মোবাইল করলে তার সঙ্গেই বেশি কথা বলে। আজ চাচু যখন কথা বলেছে সে তখন স্কুলে থাকায় তার সঙ্গে কথা হয়নি।
খাওয়া শেষ করে সায়মা যখন চেয়ার থেকে নেমেছে তার বিড়াল ছানাটা কাছে এসে মিউমিউ করছে। সায়মা তাকে কোলে নিয়ে দাদির ঘরে ছুটে গেল। দাদি তখন কেবল আসরের নামাজ আদায় করে জায়নামাজ গুটিয়ে তুলে রাখছিলেন। সায়মা তার ঘরে ঢুকেই ডাক দিল—‘দাদি, ও দাদি কী করেন?
—এইতো নামাজ পড়ে উঠলাম। তুমি স্কুল থেকে কখন ফিরেছ? দাদু!
একটু সুর টেনে টেনে উত্তর দিল সায়মা, ক-খ-ন। জানেন দাদি কাল থেকে আমাদের স্কুল এক মাস আট দিন ছুটি।
—তাই নাকি?
—হ্যাঁ। রোজা ও ঈদের ছুটি। সায়মার কোলে বিড়াল ছানার দিকে তাকিয়ে দাদি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কোলে ওটা কী দাদু?
—মিনি, আমার লক্ষ্মী মিনি। সে উত্তর দিল।
—ওকে ছেড়ে দাও। পেটে লোম যাবে। পেটে লোম গেলে অসুখ হয়।
—না, যাবে না বলতে বলতে সায়মা দাদির খাটের ওপর উঠে দাদির গা ঘেঁষে বসল। দাদির কাছে বসলে এ সময়ে দাদি তর্জনী উঁচিয়ে ঘরের কোণে টেবিল দেখিয়ে বললেন, ওখান থেকে আমার পান সুপারির থালাটা আনতে পার দাদু?
সায়মা উঠে গিয়ে পান সুপারির থালা এনে আবার দাদির কাছ ঘেঁষে বসে জিজ্ঞেস করল, দাদি, ও দাদি আজ সকালে চাচু না কি মোবাইল করেছিল?
—হ্যাঁ করেছিল।
—কী বলেছে?
—সে কথা তোমায় বলার জন্যই তো তোমার স্কুল ফেরার পথ চেয়ে বসে আছি। চাচু এই রোজায় দেশে আসবে এবং দেশেই ঈদ করবে।
খুশিতে সায়মা দাদিকে আবারও জিজ্ঞেস করল, সত্যিই দাদি!
—হ্যাঁ, সত্যি।
—তা হলে তো খুব মজা হবে, তাই না দাদি?
—খুব মজা হবে। আমিও ভাবছি তোমার চাচু দেশে এলে সুন্দরী একটা ফুটফুটে বউ আনব ঘরে। সে বেশি দিন দেশে থাকবে না। ঈদের পর পরই এ কাজটা করতে চাই। তোমার বাবা স্কুল থেকে ফিরলে কথা বলব এ নিয়ে।
—আমেরিকা আমাদের ঠিক উল্টো দিকে তাই না দাদি?
—হ্যাঁ, উল্টো দিকে। সে দেশে যখন দিন আমাদের দেশে তখন রাত।
—অনেক দূরের পথ। চাচুর তো আমেরিকায় নিজের গাড়ি আছে। সে কি সেই গাড়ি চড়ে আসবে?
—অত দূরের পথ কি গাড়িতে আসা যায়? আসবে হাওয়াই জাহাজে।
‘হাওয়াই জাহাজ’ কথাটা সায়মার কাছে যেন বিস্ময় লাগল। হাওয়াই জাহাজ এ কথাটা সে আর কোনো দিন শোনেনি। কথাটা নতুন মনে হলো। তাই সে দাদিকে বলল, হাওয়াই জাহাজ না, এয়ার প্লেন।
—আর হলো, এয়ার প্লেন আর হাওয়াই জাহাজ ওই একই কথা।
দাদির মুখে আবারও হাওয়াই জাহাজের নাম শুনে খিল খিল করে হেসে উঠল। এই ফাঁকে ওর কোল থেকে বিড়াল ছানাটা ছুটে পালাল। —এই মিনি, এই মিনি দাঁড়া। চিৎকার দিতে দিতে সায়মাও তার পিছু নিল।
ঠিক এমন সময় তার বাবা শফিক স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই দেখছে সায়মা বিড়াল ছানার পিছে পিছে ছুটছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সায়মা ছুটছিস কেন?
সায়মা সে প্রশ্নের জবাব না দিয়েই বলল, শুনেছ, বাবা? ঈদের আগে চাচু দেশে আসবে।
—চাচু দেশে আসবে? কে বলল তোকে?
—দাদি বলেছেন।
সায়মার বাবার সাড়া পেয়ে দাদি ডাক দিলেন, শফিক এসেছিস? কাপড়-চোপর ছেড়ে এদিকে আয়, তো বাবা! তোর সঙ্গে কথা আছে।
শফিক কাপড় ছেড়ে মায়ের ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওমা সায়মা কি বলছে?
—হ্যাঁ ঠিকই বলেছে। আয়, এখানে বস।
শফিক মায়ের পাশে গিয়ে বসল।
—আজ সকালে রফিক মোবাইল করেছিল। ঈদের আগে সে বাড়ি আসছে এবং ঈদ দেশেই করবে। মাস তিনেক থাকবে বলেছে। বেশি দিন যখন থাকবে না তাই ভাবছি তোমরা রোজার মধ্যেই ওর জন্য একটা মেয়ে দেখ। ঈদের পর পরই শুভ কাজটা সম্পন্ন করতে চাই।
—মেয়ে তো একটা ঠিক করা আছে, মা।
—কোথায়?
—তোমার বড় বউমা বলছিল তার বাবার বাড়ির পাশে শেলী নামের কোন একটা মেয়ে রফিকের পছন্দ। সে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। রফিক মাঝে মাঝে শেলীর সঙ্গে মোবাইলে কথাও বলে। রফিকই শেলীর কথা তার ভাবির কাছে বলেছে।
—বেশ তো, রফিকের নিজের যখন পছন্দ তা হলে তোমরা মেয়ের পরিবারের সঙ্গে কথা বলো।
—আমি আপনার বড় বউমাকে সেখানে পাঠিয়ে শেলীদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে বলি?
—আচ্ছা, তাই করো। মা সম্মতি দিল।
শফিক ও রফিক দুই ভাই। রফিক যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র শফিক তখন মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। সে সময় হঠাৎ স্ট্রোক করে তাদের বাবা মারা গেলেন। স্বামীর অবর্তমানে শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরলেন রাজিয়া বেগম। মায়ের আদরে শাসনে বড় হতে থাকে দুই ভাই। শফিক যে বছর স্নাতক হয়ে একটা হাইস্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিল সে বছরই রফিক ডিভি পেয়ে আমেরিকা চলে যায়। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর প্রথমবারের মতো দেশে ফিরছে রফিক।
আজ ২১ রোজা। ২৫ রোজায় রফিক দেশে ফিরছে। সাহরি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে রফিককে নিয়ে আলোচনা। সায়মা বিছানা ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। চোখ মুছতে মুছতে ভেজান দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল খাওয়ার ঘরে। তাকে দেখেই দাদি বলে উঠলেন, তুমি উঠেছ কেন দাদু?
আমিও রোজা রাখব—বলতে বলতে ঘুমের চোখ ডলতে থাকে। সায়মার মা বললেন, না তোমার রোজা রাখার দরকার নেই।
মা না বলতেই সে কান্না জুড়ে দিল, না আমি রাখব।
—আচ্ছা ঠিক আছে আয়, নে ওঠ। তোর বাবার পাশের চেয়ারে বস।
ভাত খেতে খেতে সায়মা তার বাবার কাছে জিজ্ঞেস করল, চাচুকে আনতে ঢাকা এয়ারপোর্টে কে কে যাবে বাবা?
—কেন আমি? তোমার বড় মামাকে আসতে বলেছি সেও যাবে।
—আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে।
পিচ্চি মেয়ে সব জায়গায় মাতব্বরি। তোর যাওয়া লাগবে কেন? দেশে আসলে সে কি বাড়ি আসবে না, না কি শ্বশুর বাড়ি গিয়ে উঠবে?— বললেন মা।
শ্বশুরবাড়ি যাক, আর মামুবাড়ি যাক, চাচুকে আনতে আমি এয়ারপোর্টে যাবই যাব। জেদ ধরে পা দাপাতে দাপাতে আবার সেই আদুরে কান্না।
তুমিও যাবে আমাদের সঙ্গে। সায়মার মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বলল, লক্ষ্মী মেয়ে কাঁদে না। খেয়ে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। যখন সময় হবে সবাই মিলে যাওয়া যাবে, ঠিক আছে।
বাবার সম্মতি জেনে সায়মা কান্না থামিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, চাচু হাওয়াই জাহাজে চড়ে দেশে আসবে তাই না বাবা?
—তুই আবার হাওয়াই জাহাজ পেলি কই? মা জিজ্ঞেস করলেন।
—দাদি বলেছেন। তুমি বাবার কাছে শোনো?
বাবা বললেন, ঠিক আছে। খাওয়া শেষ করে এখন ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে তো আবার কোরআন পড়তে মসজিদে যাবে।
চাচুকে অভ্যর্থনা জানাতে সবার সঙ্গে সেও এয়ারপোর্টে যাবে সেই খুশিতে ডগমগ হয়ে সায়মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।