নতুন রূপে ফ্রিদা কাহলো

বিংশ শতাব্দীর বিস্ময় ফ্রিদা কাহলো যেন আবার ফিরে এসেছিলেন নিউইয়র্কে। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে একটি প্রদর্শনী হয়ে গেল ব্রুকলিন জাদুঘরে। এটি ছিল আমেরিকার এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী। যা শিল্পীর বিখ্যাত সব চিত্রকর্মসহ দর্শকদের প্রথমবারের মতো শিল্পীর নিজের জন্ম, শৈশব ও মৃত্যুর স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি ‘লা কাসা আসুল’ বা নীল ঘরে নিয়ে যায়। প্রদর্শনী তাঁর ব্যক্তিগত হস্তনির্মিত দ্রব্যাদি, সাজগোজের সামগ্রী ও পোশাক-আশাক দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল। ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ১২ মে পর্যন্ত এই প্রদর্শনীটি ফ্রিদা ভক্ত তথা নিউইয়র্কবাসীকে বিস্মিত ও আনন্দিত করে তুলেছিল। ‘অ্যাপিয়ারেন্সেস ক্যান বি ডিসিভিং’—বাইরে থেকে দেখেই কাউকে বিচার করো না, এমনি ধরনের একটি শিরোনাম দিয়ে সংজ্ঞায়িত প্রদর্শনীটি মূলত ‘ফ্রিদা কাহলো মিউজিয়াম’ এবং আরও অনেকের সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

২০১৫ সালে নিউইয়র্কের বোটানিক্যাল গার্ডেনে ফ্রিদার শেষ বড় প্রদর্শনী হয়েছিল। ২০১৯ সালে এবারের ব্রুকলিন জাদুঘর প্রদর্শনীটি ফ্রিদার জীবনকে নানা পর্যায়ে বিভক্ত করে তুলে ধরেছিল। এই প্রদর্শনীতে ফ্রিদার ৩০০ টি স্কেচ, পেইন্টিং, তার ঘটনাবহুল জীবন এবং তার ব্যবহৃত সংবেদনশীল ব্যক্তিগত অন্যান্য জিনিসপত্র প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত হয়েছিল। ফ্রিদার প্রিয় মেক্সিকোর মাতৃতান্ত্রিক আদিবাসী নারীদের পোশাক তেহুয়ানা থেকে শুরু করে তার ব্যবহৃত হস্তনির্মিত কাঁচুলি, জুয়েলারি, বিশেষভাবে নির্মিত চামড়ার ছোট্ট জুতো যা তার শরীরের ভারসাম্য রক্ষা ও মেরুদণ্ডকে সোজা রাখতে সাহায্য করার জন্য পুনর্নির্মিত এবং তার ভঙ্গুর শরীর ধরে রাখার জন্য একধরনের ব্রেস যা ‘দ্বিতীয় ত্বক’ হিসেবে তাঁকে সাহায্য করত, তাও প্রদর্শনীতে ছিল। উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর ব্যবহার্য জিনিসপত্র দিয়ে মানুষ ফ্রিদাকে যাতে সবাই অনুভব করতে পারে। ফ্রিদার প্রিয় রেভলনের লাল নেইল পলিশের সংগ্রহ দেখলেই বোঝা যায়, তিনি সাজতে কত ভালোবাসতেন! কিউরেটর হেনেসত্রোসা মনে করেন, ‘সেই সময়ে যখন সাজপোশাকের বিষয়ে সবাই হলিউডকে অনুকরণ করত, তখন তিনি দেশীয় পোশাককে নিজের লোগো বানিয়ে ফেলেছিলেন। এই প্রদর্শনীটি নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে নারীদের অনুপ্রাণিত করবে, সন্দেহ নেই। তারা নতুন করে একজন চিন্তাশীল কমিউনিস্ট নারী ও শিল্পীকে জানতে পারবে।’

প্রদর্শনীর গ্যালারিতে দর্শক যেন বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত বিভিন্ন কক্ষের মধ্য দিয়ে ফ্রিদার অতীতে হেঁটে গেছেন। যার মধ্যে ছিল ‘শিল্প ও বিপ্লব’, যা তাঁর জীবদ্দশায়ে সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। ‘ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড ক্রিয়েটিভিটি’ দেখায়, কীভাবে ফ্রিদা শিশু বয়সে পোলিও এবং বাস দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। ‘দ্য ব্লু হাউস’, ‘মি অ্যান্ড মাই ডল, ‘প্রট্রেট অফ ডিয়েগো রিভেরা’, এবং ‘সেল্ফ প্রট্রেট উইথ মানকিস’। রিভেরার সঙ্গে টুকরো টুকরো স্মৃতিসহ তাকে লেখা অনেক রোমান্টিক চিঠি ও তার বাবার তোলা শৈশবের বেশ কিছু ছবিও প্রদর্শিত হয়। ‘গ্রিংলান্ডিয়া’ যা আমেরিকার তিনটি ভিন্ন শহর সানফ্রান্সিসকো, ডেট্রয়েট এবং নিউইয়র্কের সঙ্গে তার সম্পর্কের অনুসন্ধান করে।


নিউইয়র্ক সম্পর্কে ফ্রিদার বক্তব্য ছিল, ‘এটি বিশ্বাস করা কঠিন, যে শহরটি মানুষের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, এটি জাদু বলে মনে হচ্ছে।’ প্রদর্শনীর এক অংশ নিউইয়র্কে ফ্রিদার একটি প্রধানতম সময়কে উৎসর্গ করেছে। যেখানে তিনি বিশেষত হারলেমের প্রেমিক ছিলেন। ১৯৩০–এর দশকে ফ্রিদা তার স্বামী ডিয়েগো রিভেরার সঙ্গে এখানে সময় কাটিয়েছিলেন।
ফ্রিদা কাহলো ডি রিভেরার জন্ম ১৯০৭ সালের ৬ জুলাই। তিনি মারা যান ১৯৫৪ সালের ১৩ জুলাই। জন্ম নাম ছিল মাগদালেনা কারমেন ফ্রিদা কাহলো ই ক্যালদেরোন। তার মা মাটিলডা ক্যালদেরন ই গঞ্জালেজ ছিলেন স্প্যানিশ-নেটিভ আমেরিকান ক্যাথলিক। জার্মান ফটোগ্রাফার গিলেরমো কাহলো ছিলেন তার বাবা। এই ম্যাক্সিকান চিত্রশিল্পী তার ‘আত্মপ্রতিকৃতি’ ঘরানার চিত্রের জন্য বহুল আলোচিত। মেক্সিকো শহরের ‘লা কাসা আসুল’ বা নীল ঘর নামে পরিচিত বাড়িটিতেই শিল্পী তাঁর জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর শিল্পকর্ম আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত। তিনি নিজে মেক্সিকোর জাতীয় ও দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতীকস্বরূপ। তাঁর জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতা ও রূপের আপসহীন প্রকাশের ফলে নারীবাদীদের কাছে তার চিত্রকর্ম খ্যাতি পেয়েছে।

ফ্রিদা ম্যাক্সিকান চিত্রকর দিয়েগো রিভেরাকে বিয়ে করেন।এ সময়ই ফ্রিদার ছবি আঁকার ভঙ্গিতে অনেক পরিবর্তন আসে। তার প্রিয় তিহুয়ানা পোশাকটি হয়ে ওঠে তার ট্রেডমার্ক। এই ঐতিহ্যবাহী পোশাকের বৈশিষ্ট্য হলো ফুলেল পাগড়ি, ঢোলা ব্লাউজ, স্বর্ণালংকার এবং এলোমেলো ফোলা স্কার্ট। ফ্রিদা খুব গভীরভাবে আদিবাসী ম্যাক্সিকান সংস্কৃতিতে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর কাজে উজ্জ্বল রং এবং নানা নাটকীয় প্রতীক ব্যবহারেই তা ফুটে ওঠে। ম্যাক্সিকান পৌরাণিক কাহিনিতে বানর হলো কামের প্রতীক; ফ্রিদার ছবিতেও বানর প্রায়শই প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্মীয় বহু বিষয়ই তার কাজে চিত্রিত হতে দেখা গেছে।
আজীবন তিনি বিভিন্ন স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভুগেছেন, যার কিছু জন্মগত। তার ‘স্পাইনা বাইফিডা’ নামের একধরনের জন্মগত রোগ ছিল, যা তার মেরুদণ্ড আর পায়ের বৃদ্ধি ব্যাহত করেছে। ছয় বছর বয়সে পোলিওর আক্রমণে তার ডান পাটি সরু আর খাটো হয়ে যায়। এ কারণে তিনি সব সময় লম্বা স্কার্ট পরতেন। এ ছাড়া শৈশবের তিনি একবার মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। এতে মোট ৩০ বার তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচার করতে হয়। তার এই নানা অসুস্থতার কারণে সৃষ্ট একাকিত্ব তার কাজে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। আরোগ্য লাভের সময়ে ফ্রিদা ছবি আঁকতে শুরু করেন। অচলাবস্থায় আঁকা নিজের প্রতিকৃতিগুলো তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। তুলির অনবদ্য আঁচড়ে ফ্রিদা নিজেকে এঁকেছেন; ফুলেল পোশাকে সজ্জিত, কালো চুল, জোড়া ভ্রু আর পুরুষালি গোঁফ তাকে ঘিরে একধরনের রহস্যময়তা তৈরি করেছে।

নিজের সম্পর্কে ফ্রিদা বলে গেছেন, ‘আমি নিজেকেই আঁকি, কারণ প্রায়শই আমি খুব একা থাকি। আর বিষয়বস্তুগুলোর মাঝে শুধু নিজেকেই সবচেয়ে ভালো জানি।’